মেহেরপুরের গাংনী উপজেলাতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে টিআর, কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দের অধিকাংশ টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে।
কাবিটা-কাবিখা প্রকল্পের ১ম ও ২য় কিস্তির কাজ চলতি বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এবং ৩য় কিস্তির কাজ চলতি বছরের ১৫ মে’র মধ্যে বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু গেল অর্থবছরে কোন কাজ না করে ১ম ও ২য় কিস্তির পুরোটাকা উত্তোলন করেছেন। তবে ৩য় কিস্তির টাকা উত্তোলন করার চেষ্টা করলেও ইউএনও’র হস্তক্ষেপে ৬৭টি প্রকল্পের টাকা পিআইসি সভাপতিদের নামে পে অর্ডার করে রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির টাকার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ টাকা কেটে নিয়ে পিআইসির কাজ করতে দিয়েছেন। এছাড়া অফিসের দুই স্টাফকেও পিআইসির সভাপতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের খবর মেহেরপুর প্রতিদিনের কাছে আসলে, ‘মেহেরপুর প্রতিদিন’ এ প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প এলাকাগুলো পরিদর্শন ও অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানের ১ম পর্বে শুধুমাত্র ভাটপাড়া ডিসি ইকোপার্কের ৬টি প্রকল্পে সাড়ে ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি প্রকল্পগুলোর নিয়ে পর্ব আকারে প্রকাশ করা হবে।
গাংনী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কাবিটাতে ৭৮টি প্রকল্পের অনুকুলে ২ কোটি ৪০ লাখ ৫৩৭২ টাকা, টিআরের ১২৫টি প্রকল্পের অনুকুলে ২ কোটি ১৬ লাখ ৬৭২৪ টাকা এবং কাবিখার ৪৭টি প্রকল্পের অনুকুলে ১৩৬ মেট্রিক টন চাল এবং ১৩৬ মেট্রিক টন গম, যার বাজার মূল্য প্রায় ৯০ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে গাংনী উপজেলায় তিন প্রকল্পে বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
বরাদ্দের মধ্যে গাংনী ডিসি ইকো পার্কে ১ম ও ২য় কিস্তির বরাদ্দের মধ্যে রয়েছে ডিসি ইকোপার্কের শিশু পার্ক হতে বধ্যভ’মি পর্যন্ত ও কাজলা নদীর পাড় হতে আশ্রয়ণ মুখি রাস্তা এইচবিবিকরণ এবং দোকানের সামনে মাটি ভরাট বাবদ ৮লাখ টাকা, ডিসি ইকোপার্কের প্রধান গেট নির্মাণ ও গেটের পাশে মাটি ভরাট বাবদ ৭ লাখ টাকা, ডিসি ইকোপার্কের ভিতরে শিশু পার্কের রাইড স্থাপন, ফেন্সিকরণ ও রংকরণ বাবদ ২লাখ ৫০ হাজার টাকা, ওয়াশরুম সংস্কার ও পিকনিক সেড মেরামত বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পার্কের অস্থায়ী দোকান সেড নির্মাণ বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৩য় পর্যায় প্রকল্পের টিআর প্রকল্পের ডিসি ইকোপার্ক ওয়াল প্লাস্টার ও পয়েন্টিং করণ বাবদ ৩লাখ ৯৮ হাজার ২৭৮ টাকা। গত রবিবার ভাটপাড়া ডিসি ইকোপার্ক সরেজমিন পরিদশনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়াল প্লাস্টারের কাজ চলমান রয়েছে।
ওয়াল প্লাস্টারের দায়িত্বরত রাজমিস্ত্রি সরদার হিরক আলী বলেন, সাড়ে ৩শ ফুট লম্বা, ৭ফুট উচু ওয়ালের দুই পাশ প্লাস্টার করতে মিস্ত্রি খরচ, বালি ও সিমেন্ট মিলিয়ে পৌনে ২ লাখ টাকা খরচ হবে।
ডিসি ইকোপার্কের প্রধান গেট নির্মাণ ও গেটের পাশে মাটি ভরাট বাবদ বরাদ্দ ৭ লাখ টাকা থাকলেও শুধুমাত্র এসএস পাইপের গেট সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কোন মাটি ভরাটের চিহৃ পাওয়া যায়নি। এসএসপাইপের যে গেটটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
এ প্রকল্পের পিআইসি সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য জরিমন নেছা বলেন, গেটের কাজ করা হয়েছে। মিথ্যা কথা বলবো না একবার টাকা তুলে ৫ হাজার দিয়েছে, আর কিছু দিবে কিনা জানিনা।
পাকের্র অস্থায়ী দোকান সেড নির্মাণ বাবদ সাড়ে ৩লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলে কোন দোকান নির্মাণ করা হয়নি।
ডিসি ইকোপার্কের ভিতরে শিশু পার্কের রাইড স্থাপন, ফেন্সিকরণ ও রংকরণ বাবদ ২লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া থাকলেও।
রবিবার পর্যন্ত কোন রাইড স্থাপন করা হয়নি। পুরাতন রাইডগুলোও ফেন্সিকরণ কিংবা রংকরণ কোনটাই করা হয়নি।
ওয়াশরুম সংস্কার ও পিকনিক সেড মেরামত বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওয়াশরুমের বাইরের অংশ নতুন করে রং করা হয়েছে তবে ভিতরে কোন সংস্কার করা হয়নি, এবং পিকনিক সেড নির্মাণ করা হয়নি।
শিশু পার্ক হতে বধ্যভ’মি পর্যন্ত ও কাজলা নদীর পাড় হতে আশ্রয়ণ মুখি রাস্তা এইচবিবিকরণ এবং দোকানের সামনে মাটি ভরাট বাবদ ৮লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বধ্যভুমি থেকে কাজলা নদী পর্যন্ত এইচবিবি করণ করা হয়েছে। বাইরে থেকে মাটি এনে ভরাটের পরিবর্তে পার্কের উচু স্থানের মাটি কেটে দোকানের সামনে মাটি ভরাটের জন্য ফেলে রাখা হয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ময়না খাতুন বলেন, স্মৃতিসৌধ (বধ্যভ’মি) থেকে ঘাট পর্যন্ত ইটের হিয়ারিং রাস্তা করা হয়েছে ১০ দিন হলো। বিভিন্ন যায়গার উচু মাটি কেটে সমান করছে। বাথরুম (ওয়াশরুম) দুদিন ধরে রং করতে দেখলাম।
ডিসি ইকোপার্কের কেয়ারটেকার সোলাইমান বলেন, আমি সাড়ে ৯ বছর ধরে এই পার্কের দেখাশুনা করছি। ইউএনও স্যার বলেছেন সবকিছু দেখেশুনে রাখতে। প্রধান গেট নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, গেটের কোন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। গেট আগে থেকে আছে। গত বছর ৫ তারিখের পর ছাত্ররা গেটটা ভেঙে দিয়েছিলো। তাই শুধুমাত্র স্টিলের গ্রিল দিয়ে নতুন গেট লাগানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শুনছি অনেক কাজ হবে না হলে তো বলতে পারবো না।
তবে, এ বিষয়ে সরাসরি তাঁর কার্যালয়ে কথা হয় গাংনী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনসুর রহমানের সাথে। কাজ হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করতে পারবো।’
কাজ না করে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জুনের মধ্যে টাকা তোলার নিয়ম আছে তাই ২৬ জুন টাকা উত্তোলন করেছি। ৩য় কিস্তির ৬৭টি প্রকল্পের বিলের চেকও দেখান তিনি। তবে ১ম ও ২য় কিস্তির বিল উত্তোলনের কথা বলতে তিনি পিআইসির মাধ্যমে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। ’
গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আনোয়ার হোসেন মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মে মাসে জয়েন করেছি। তার আগে এ প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় হচ্ছে এমন কিছু অভিযোগ পেয়ে আমি পিআইওকে বলেছি পুরো কাজ বুঝে নেওয়া হবে। ৩য় কিস্তির টাকা উত্তোলন করে পে-অডার করে রাখার নির্দেশে আমি দিয়েছি এবং পিআইসি সভাপতিদের বলেছি সরকারি টাকা তছরুপাত করা যাবে না। তবে, প্রকল্পের কাজ স্টিমেট অনুযায়ী বুঝে নেওয়া হবে। বুঝে না পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ’
(এ বরাদ্দের বাকি প্রকল্পগুলোর অনুসন্ধান চলছে। যেগুলো পরবর্তিতে পর্ব আকারে প্রকাশ করা হবে... )