চলতি মৌসুমে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। চালের মজুতে রেকর্ড গড়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম নিম্নমুখী। এ ছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণসহ সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও চালের বাজার ফের উত্তপ্ত। দাম বৃদ্ধির পেছনে ‘দেশের করপোরেট সিন্ডিকেটকেই’ দুষছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বন্যাকেও অজুহাত হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
তবে এটিকে অস্বাভাবিক বলছেন বাজার বিশ্লেষক ও ক্রেতা-বিক্রেতারা। সবমিলে অনেকগুলো পণ্যের দাম একসঙ্গে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষজন। রাজধানীর কয়েকটি বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে, টানা তিন মাস কমার পর ফের বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন স্বল্প আয়ের মানুষ। সম্প্রতি বোরোর নতুন চাল বাজারে ওঠার পর যে সরু চালের দাম কমে ৭৫ টাকা হয়েছিল, এখন তা বেড়ে ৮০ থেকে ৮২ টাকায় পৌঁছেছে। এটি অস্বাভাবিক। মাঝারি ও মোটা চালের বাজারেও একই চিত্র। এই বাড়তি দামের পেছনে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তারা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন।
বাজারে চালের দামে ঊর্ধ্বমুখী:
মাস দেড়েক ধরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চাল। মোটা চালের দামই এখন ৬০ টাকার বেশি। মাঝারি মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৬৫-৭০ টাকায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া বাকি সব চাল সাধারণত ৭৫-৮৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর খুব ভালো মানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চালের দাম ৯০ থেকে ১০০ টাকার কাছাকাছি। তারা জানান, গরিবের কাবাব মোটা চালের দাম ঢাকায় স্থানভেদে গত ১৫ দিনে খুচরায় কেজিতে দাম বেড়েছে ৪-৬ টাকা। পাশাপাশি অন্য সবধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫-৬ টাকা। শুল্কমুক্ত আমদানি হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে অন্তত ৪০০ টাকা। যার দাম গত বছরে ছিল মাত্র ২৯০০ থেকে ৩১০০ টাকা।
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা। চাল উৎপাদনকারী মিলার ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে ধান-চাল নেই বললেই চলে।
কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী খালেদ বলেন, চালের সরবরাহ ঠিক আছে, তবুও ঈদের পর থেকে দাম বাড়তে শুরু করেছে। একই মার্কেটের মেসার্স নূর রাইস এজেন্সির চাল ব্যবসায়ী বলেন, মোটা চাল এখন কম পাওয়া যায়। তবুও প্রতি কেজি ৫৮ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা, চিকন- সব ধরনের চালের দামই এখন প্রায় ৩৯০০ টাকা। বস্তায় দাম বেড়েছে অন্তত ২০০ টাকা। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। খুব শিগগিরই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। দেশে খাদ্য মজুত বর্তমানে অত্যন্ত সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে।
বিশ্ববাজারে কম, দেশে বাড়ছে:
ট্রেডিং ইকোনমিকস বলছে, বিশ্ববাজারে চালের দাম এক মাসে কমেছে ৩.৮ শতাংশ। চলতি বছরের সাত মাসে কমেছে ৯.১৬ শতাংশ। আর এক বছরে একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৪.১৬ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ীও চলতি বছরে সবধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। সংস্থাটির মতে, সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারতের রেকর্ড উৎপাদন ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে তুলে নেয়ায় বাজারে সরবরাহ বাড়ায় কমেছে চালের দাম। এর পাশাপাশি উৎপাদন বেড়েছে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশগুলোতেও। বিশ্ববাজারে ক্রমেই নিম্নমুখী হলেও বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম বেশি। রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, গত একমাসে নতুন করে চালের দাম না বাড়লেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সরু জাতের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ১৫.৯৪ শতাংশ, মাঝারি জাতের পাইজাম ও আটাশ ১৬.৭ শতাংশ এবং মোটা জাতের স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম ১০.৫৮ শতাংশ বেড়েছে। টিসিবি’র ঢাকা মহানগরীর দৈনিক খুচরা বাজারদরের তথ্য অনুযায়ী, সরু চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা এবং মোটা চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতি:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বলছে, টানা তিন মাস কমার পর ফের বাড়লো মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৫৫ শতাংশ। এর আগে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছিল। জুলাই মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত দুই খাতেই মূল্যস্ফীতি খানিকটা বেড়েছে। সামান্য বেড়েছে গ্রাম ও শহর দুই জায়গাতেই।
চাল আমদানি করবে সরকার:
দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখা ও মূল্যস্ফীতি থেকে ভোক্তাদের স্বস্তি দেয়ার লক্ষ্যে ৪ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত বুধবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অর্থনীতিসংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এদিকে, ভারতের ইকোনমিক টাইমস বলছে, বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত ৫ লাখ টন চাল আমদানির ঘোষণায় ভারতে গত দুই দিনে চালের দাম ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
পর্যাপ্ত মজুত:
চলতি মৌসুমে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের কাছেও চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত ২১ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৭ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৪ টন চাল ও ১ লাখ ১ হাজার ৫৩০ টন ধান মজুত রয়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, উৎপাদন ও মজুতের দিক থেকে চালের তেমন ঘাটতি নেই। তার পরও তিন মাস ধরে অর্থাৎ বোরোর ভরা মৌসুমেই চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জানিয়েছেন, সরকারি হিসাবেই ধানের উৎপাদন খরচ ১২ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে, বোরো ধানের ভরা মৌসুমের আড়াই মাস পার না হতেই চালের বাজারে এমন অস্থিরতার জন্য মিল মালিক ও করপোরেট সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে মিল মালিকদের দাবি চালের দাম বাড়ার জন্য করপোরেট গ্রুপগুলো একমাত্র দায়ী। বাজারে সুষ্ঠু তদারকি নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজারের ইসলাম রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, চালের বাজার করপোরেট হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এ কোম্পানিগুলো চালের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ালে সরকার অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, করপোরেট হাউজগুলোর রহস্যময় ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার যতই উদ্যোগ গ্রহণ করুক না কেন, বাজার স্থিতিশীল হবে না।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, পর্যাপ্ত আমদানি থাকার পরও পরিস্থিতি কারা অস্বাভাবিক করলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট আগের মতোই দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বাজারে কেন মনিটরিং নেই। ‘সরকারের সঠিক মনিটরিং না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছে।
তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ করপোরেট কোম্পানিগুলোর মালিকরা। তাদের মতে, চাল উৎপাদনে দেশ এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ফলে সময়মতো আমদানির অনুমতি না দেয়ায় চাহিদা বেড়ে চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে সংকট তৈরি হবেই। যেখানে আরও দুই মাস আগে ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির অনুমতি দেয়া উচিত ছিল, তা দেয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ বিভাগ) মনিরুজ্জামান বলেন, রেকর্ড পরিমাণ বোরো সংগ্রহ এবং মজুতও ভালো। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। সরকারিভাবেও চাল আমদানি করা হচ্ছে। ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এতে আশা করা যায়, চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
বাংলাদেশ অটো রাইস-মিলমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, চলতি বছর দেশে উৎপাদিত ফলনের প্রায় অর্ধেক ধানই করপোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে মজুত হয়েছে। তারা মূলত ছোট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ধানের হাট থেকে অধিক দরে ধান সংগ্রহ করে মজুত করে। এতে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মহানগরে ১০টি এবং প্রতি জেলায় একটি করে টিম কাজ করছে। সারা দেশের চালের আড়তে অভিযান চালাচ্ছি। কেউ যদি বলে মনিটরিং নেই তাহলে সেটি সঠিক নয়।
সূত্র: মানবজমিন ।