মেহেরপুর জেলায় মাদ্রাসা শিক্ষা মান বেহাল অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। দাখিল পরীক্ষায় গত বছরের তুলনায় এ বছর পাশের হার কমেছে ৪২ শতাংশ। ৩৩ পেয়ে পাশ করার মত ফলাফলও হয়নি ২০২৫ সালের দাখিল পরীক্ষায়। জেলায় ২৫টি মাদ্রাসা থেকে ৬৯০ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ২২৭ জন। পাশের হার মাত্র ৩২.৮৯ শতাংশ। যেখানে পাশ মার্ক নির্ধারণ হয় ৩৩ এ।
এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১১টি মাদ্রাসা থেকে ৩২৬ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ১০৫ জন। জিপিএ ৫ পায়নি কেউ। এ উপজেলায় পাশের হার ৩২ শতাংশ। গাংনী উপজেলার ১০ টি মাদ্রাসা থেকে ২৮০ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ৮৮ জন। এ উপজেলায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ জন। পাশের হার আর কম ৩১.৪২ শতাংশ। এ উপজেলায় শতভাগ ফেল করেছে এমন মাদ্রাসাও আছে একটি। তুলনামূলক ভালো অবস্থানে মুজিবনগর উপজেলা। এ উপজেলায় ৪টি মাদ্রাসা থেকে ৮৪ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ৩৪ জন। জিপিএ ৫ না পেলে পাশের হার ৪০.৪৭ শতাংশ।
গত বছর ২০২৪ সালের দাখিল পরীক্ষায় জেলা থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলো ৬৫৩ জন। পাশ করেছিলো ৪৮৫ জন। পাশের হার ছিলো ৭৪.২৩ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছিলো ১১ জন।
মেহেরপুর জেলার ২০২৪ ও ২০২৫ সালের দাখিল পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। ফলাফল বিপর্যয় ঠেকাতে শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ, অভিভাবকদের সচেতনতা ও শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাদ্রাসা ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৫ সালে সদর উপজেলার মেহেরপুর দারুল উলুম আহম্মদিয়া কালিম মাদ্রাসায় ৪৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ জন পাশ করেছে। পাশ এর হার ৪৪ শতাংশ। আমঝুপি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসায় ৪৫ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ২৭ জন। পাশের হার ৬০ শতাংশ। গোভীপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২৮ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ৮ জন। পাশের হার মাত্র ২৯ শতাংশ। নতুন দরবেশপুর দাখিল মাদ্রাসায় ৩৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৫ জন। পাশের হার মাত্র ১৩ শতাংশ। রাজনগর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৩৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৬ জন। পাশের হার ১৭ শতাংশ। তাঁতীপাড়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৩ জন। পাশের হার ১৩ শতাংশ। ইসলামনগর হোসাইনিয়া দাখিল মাদ্রাসা ২০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১৩ জন। পাশের হার ৬৫ শতাংশ। কুলবাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসায় ২১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৩ জন। পাশের হার ১৪.২৯ শতাংশ। কোলা দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৮ জনের মধ্যে পাস করেছে ২ জন। পাশের হার ১১ শতাংশ। পিরোজপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৩৩ জনের মধ্যে পাস করছে ১৪ জন। পাশের হার ৪২ শতাংশ। আশরাফপুর দারুল সুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৫ জন। পাশের হার ২৪ শতাংশ।
মুজিবনগরের মানিকনগর ডিএসএ আলিম মাদ্রাসা থেকে ২৯ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ১৩ জন। পাশের হার ৪৪.৮২ শতাংশ। দারিয়াপুর গাওছিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২৭ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ১৪ জন। পাশের হার ৫১.৮৫ শতাংশ। শিবপুর দারুল কুরআন দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৯ জনের মধ্যে পাশ করেছে ৩ জন। পাশের হার ৩৩.৩৩ শতাংশ। আয়েশা নগর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৯ জন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে ৪ জন। পাশের হার ২১.০৫ শতাংশ।
গাংনী উপজেলার কাজীপুর দাখিল মাদ্রাসায় ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৬ জন। পাশের হার ২০ শতাংশ । সাহারবাটি কলোনিপাড়া আল মারকাজুল মাদ্রাসায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ২১ জন। পাশের হার ৫৬.৭৫ শতাংশ । গাংনী সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় ৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৫ জন। পাশের হার ৩৭.৫ শতাংশ । হাড়াভাংগা দারুল হাদি ফাজিল মাদ্রাসায় ৩১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৬ জন। এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ১ জন। পাসের হার ১৯.৩৫ শতাংশ। করমদি দারুস সুন্নাত নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ২১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১০ জন। পাশের হার ৪৭.৬১ শতাংশ। বাদিয়াপাড়া মহসিনা দাখিল মাদ্রাসায় ২১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৬ জন। পাশের হার ২৮.৫৭ শতাংশ। মানিকদিয়া আগারপাড়া আলিম মাদ্রাসায় ৩২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১৫ জন। পাশের হার ৪৬.৮৭ শতাংশ । পীরতলা দাখিল মাদ্রাসায় ১৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কেউ পাশ করে নি। আইদা কলিম দাখিল মাদ্রাসায় ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৮ জন। পাশের হার ২৬.৬৬ শতাংশ। বামুন্দী দাখিল মাদ্রাসায় ২০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১ জন। পাশের হার ৫ শতাংশ।
শতভাগ ফেল করা গাংনীর পীরতলা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী শরিফুল ইসলাম বলেন, “কেন যে কেউ পাশ করলো না বুঝতে পারছি না। গতবছর ১৮ জন পরীক্ষা দিয়ে ৭ জন পাশ করেছিলো। আমাদের আশা ছিলো এবারও ৬/৭ জন পাশ করবে। ”
সদর উপজেলা মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আমঝুপি দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী মোহাম্মদ আলী লাল্টু বলেন, “সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত, দুর্বল সন্তানকে অভিভবাবকরা মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়ে অভিভাবকরা অসচেতন। এছাড়া সাধারণ শিক্ষার থেকে মাদ্রাসার শিক্ষার সিলেবাস বেশি। ফলে একেতো দুর্বল শিক্ষার্থী তার উপরে সিলেবাসের চাপ যে কারণেই মাদ্রাসার দাখিল পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এর মধ্যে থেকেও শিক্ষকরা দুর্বল শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়ে চেষ্টা করছেন তাদের লেখাপড়ার মান উন্নয়ন করার। তবে কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর রেজাল্ট বেশি খারাপ বলেও তিনি স্বীকার করেন।”
মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিন বলেন, “ যশোর বোর্ডে সবনিম্ম পাশের হার মেহেরপুরে। মাদ্রাসার অবস্থা আরও খারাপ। যা দেখে মেহেরপুর জেলার সার্বিক শিক্ষার মানের অবস্থা প্রতিফলিত হচ্ছে। শুধু শিক্ষকদের দায়ই নয়, অভিভাবক এবং শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ তৈরিতে আমাদের সমাজকেও এর দায় নিতে হবে। না হলে শিক্ষার এ বিপর্যয় থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো না। পাশের জেলাগুলোতে ভাল ফলাফল হচ্ছে অথচ মেহেরপুরে কেন হচ্ছে না, তা অবশ্যই খতিয়ে দেখে সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে, তবেই মাদ্রাসাসহ সবক্ষেত্রে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে।”
মেহেরপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: হযরত আলী বলেন,“শুধু মাদ্রাসা না জেলাতেই এবার এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে। আমি সকল মাদ্রাসা ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সুপারদের ডাকবো। কিভাবে আগামী বছর থেকে ভালো ফলাফল করা যায় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।”