প্রাচীন কাল থেকে রান্নার জ্বালানি, ঘরের বেড়া, পান বরজের বেড়া ও ছাউনি তৈরিতে পাটকাঠির ব্যবহার হয়ে আসছে। এখন গৃহস্থালী সামগ্রী, বাহারী ওয়াল মেট, পার্টিক্যাল বোর্ডসহ বিভিন্ন সৌখিন সামগ্রী তৈরিতে পাটকাটি ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে। পাটকাঠির বহুমুখী ব্যবহারের কারণে আগের তুলনায় এর কদর বেড়েছে কয়েক গুন।
এখন চাষিরা সোনালি আঁশের রুপার কাঠিতে আশার স্বপ্ন দেখছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন পার্টিকেল বোর্ড তৈরি ছাড়াও বিভিন্ন কল কারখানায় পাটকাঠির ব্যবহার হচ্ছে। যার ফলে পাটকাঠির মূল্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এছাড়া ফটোকপির কালি তৈরিতেও এর ব্যবহার বেড়েছে বলে জানা যায়।
একসময় শুধুমাত্র জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হতো এই পাটকাঠি। সরেজমিনে দেখা যায় ঝিনাইদহ সদরের নবগঙ্গা, শৈলকুপার কুমার, গড়াই, ডাকুয়া কালীগঙ্গা , হরিণাকুণ্ডুর নবগঙ্গা, কুমার, কুমরল,ডাকুপার খাল, কাকল বিল, কাপাশাটিয়ার বওড়, কাইতপাড়া বাওড়, কালীগঞ্জের চিত্রা, ভৈরব, বেগবতি, কোটচাঁদপুরের চিত্রা, কপোতাক্ষ ও মহেশপুরের ভৈরব,বেতনা,ইছামতি, কোদলা, কপোতাক্ষ নদ, নস্তীর ও সস্তার বাওড়সহ বিভিন্ন বিল-খাল বেষ্টিত এই অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুপাশে বাশ দিয়ে আঁড়া তৈরী করে তার উপরে পাট ও পাটকাঠি শুকাচ্ছে কৃষকরা।
পাটের আশ ছুড়ানোর সময় কয়েক গুচ্ছ পাটকাঠি একত্রিত করে আটি বেঁধে শুকানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। আলাদা শ্রমিক দিয়ে পানির মধ্য থেকে সেই আটি তুলে চাষিরা আড়ায় শুকাতে দেয়।
ঝিনাইদহের হাটগোপালপুর, বিষয়খালী, ডাকবাংলা, শৈকুপার গাড়াগঞ্জ, দহকুলা, নিত্যানন্দপুর, হরিণাকুণ্ডুর কাপাশহাটিয়া বাওড়ের পাশে ঘুরে দেখা যায়, খাল-বিল ও নদীর ধার দিয়ে পুরুষের পাশাপাশি শত শত মহিলারা পাট থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছেন। দিনশেষে তারা মুজুরি হিসেবে পাটকাঠি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
এমনই এক নারী শ্রমিক আছিয়া খাতুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বাড়িতে জ্বালানি সংকট ও পানের বরজে বেড়া দেবেন এজন্য তিনি পাটের আঁশ ছড়াতে এসেছেন, বিনিময়ে পাটকাঠি সংগ্রহ করছেন।
হাফেজা খাতুন নামের আরেক নারী বলেন, পাট কাঠি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানান কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এজন্য গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পাটকাঠি সংগ্রহ করতে দেখা যায়। তাই তিনি পাট থেকে আঁশ ছাড়ানোর বিনিময়ে পাটকাঠি সংগ্রহ করতে এসেছেন।
বৈডাঙ্গা গ্রামের শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি ৪ টি জাগ দিয়েছি সব জায়গায় পাটের আঁশ ছাড়াতে মহিলারা কাজ করছেন যাদের কাজের বিনিময়ে দেওয়া হবে পাটকাঠি। এতে করে পাট চাষে বিনিয়োগকৃত অর্থ অনেকটাই উঠে আসছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া পান বরজের জন্য চড়া দামে পান চাষিরা কিনছেন পাটকাঠি।
পাটের আঁশ ছাড়াতে অর্থের বিপরীতে পাটকাঠি দিচ্ছেন কেন এমন পশ্নের জবাবে বাদ পুকুরিয়া গ্রামের তোয়াজ আলী বলেন, পাট চাষের ব্যয় লাঘব করতে পাটের আঁশ ছাড়াতে আসা কৃষাণীদের অর্থ না দিয়ে পাটকাঠি দেওয়া হচ্ছে। সরেজমিনগিয়ে দেখা যায়, যেখানেই পাট জাগ দেওয়া হয়েছে সেখানেই ভিড় জমাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার গৃহিণীরা।
চেয়ে নিচ্ছেন পাট, ছাড়িয়ে দিচ্ছেন আঁশ বিনিময়ে নিচ্ছেন পাট কাঠি। দেখে মনে হচ্ছে, পাট কাঠি চাষিদের কাছে বোঝা হলেও তাদের গৃহিণীদের কাছে বেশ দামি।
এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদী, খাল-বিলেই পাট জাগ দিয়ে পাটের রং ভালো হওয়ার পাশাপাশি পাটকাঠির মানও ভালো হয়েছে।
এদিকে, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে পাটকাঠি ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে স্বল্প মূল্যে পাটকাঠি ক্রয় করে ভ্যান যোগে পার্শ্ববর্তী শহরে নিয়ে বিক্রি করছেন চড়া দামে। এমনই একজন পাটকাঠি ব্যবসায়ী সাহেব আলী বলেন, এখন পাটকাঠি বিক্রির মৌসুম। তাই আমরা পাটচাষিদের কাছ থেকে ৫০-৬০ টাকা আটি দরে প্রতি আটি কিনে শহরে গিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে বিক্রি করছি। এতে করে ভ্যানপ্রতি আমাদের ২ থেকে ৩হাজার টাকা আয় হয়।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবছর জেলার ৬টি উপজেলায় ২০,২২৯ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছে। গত বছরে ২১৪৪৬ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছিল। পচাঁনোর সময় ভোগান্তি, শ্রমের মূল্য অধিক এবং ভালো দাম না পাওয়া এবং রোগের আক্রমণে নিরুৎসাহিত হয়ে এবছর ১২১৭ হেক্টর কম জমিতে আবাদ করা হয়েছে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় গতবছর ৫০৬২ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছিল এবার ৪৮১০ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। শৈলকুপায় গতবছর ৮৪৭৭ হেক্টর জমিতে, এবছর ৭৭৯৮ হেক্টর জমিতে, কালীগঞ্জ উপজেলায় গতবছর ৭১০ হেক্টর এবছর ৬৬৫ হেক্টর জমিতে, কোটচাঁদপুরে গতবছর ৪১৫ হেক্টর এবছর ৩৫৪ হেক্টর জমিতে, মহেশপুরে গতবছর ৪০৭০ হেক্টর জমিতে এবছর ৩৮৯০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছে। তবে হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় গত বছর ও এই বছর সমান ২৭১২ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছে।
এবছর ফলন ভাল হয়েছে হেক্টর প্রতি ১৫ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে বলে জানান চাষিরা। পাটকাঠির এত চাহিদা কারণ কি -এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিবিদ ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, পাট এমন একটি কৃষিপণ্য যার কোনো অংশই অব্যবহার্য থাকে না।
তাই পাটচাষ বৃদ্ধি পেলে পাটকাঠি অবশ্যই কৃষকদের বিনিয়োগকৃত অর্থ উপার্জন পূর্বক অতিরিক্ত অর্থ আয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস হতে পারে।
কৃষি অধিদপ্তর ঝিনাইদহের উপপরিচালক কৃষিবিদ ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন , পাট চাষিদের জন্য একটি অর্থকরি ফসল এবছর পাটের রং ভাল আসছে এবং যেখানে সেখানে পানি থাকায় কৃষকরা সহজেই পাট জাগ দিতে পারছে। পাটের আঁশের সঙ্গে পাটকাঠিও কৃষকদের আর্থিক সুবিধা দিতে পারে। এ ছাড়াও পাটকাঠি আর্থিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কৃষকদের নানাবিধ কাজে লাগে। তাই পাট জাগ দেওয়ার ব্যাপারে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত পাটের রং ও পাটকাঠির মানের বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন।