ডাক্তার লিটনের ভুল চিকিৎসার খেসারত দিচ্ছে রোগী

তিনি সার্জারী ডাক্তার নন। সার্জারী করার বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণও নেই তার। অথচ, সরকারি দায়ীত্ব ফাঁকি দিয়ে নিজের ক্লিনিকে প্রতিদিনই করছেন নানা ধরণের জটিল রোগের অপারেশন।

ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী নচিকেতার গাওয়া সেই বিখ্যাত ‘ও ডাক্তার’ গানের বাস্তবতা মিলেছে পেশাগত চরিত্রে, মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের প্রেষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার মেহেদী হাসান লিটনের বিরুদ্ধে।

চিকিৎসক মেহেদী হাসান লিটন শুধুমাত্র একজন এমবিবিএস হলেও এনেসথেসিয়া চিকিৎসক বাদেই একাই মহিলাদের সিজারসহ জটিল রোগীদের অপারেশন করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

তার নিজস্ব ক্লিনিক ‘আমঝুপি জাহানারা ল্যাব এন্ড নার্সিং হোমেই’ করে থাকেন জটিল রোগের অপারেশন কার্যক্রম। চিকিৎসক মেহেদী হাসান লিটনের অপচিকিৎসার স্বীকার তার নিজ গ্রামের হতদরিদ্র তারিক আজিজ লিটন। মেহেদী হাসানের অপচিকিৎসায় তারিক আজিজ লিটন প্রানে বেঁচে থাকলেও যুদ্ধ করছেন রোগের কাছে।

তারিক আজিজ জানান, সম্প্রতি আমার পেটে যন্ত্রণা উঠলে মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে আমার এ্যাপান্ড্রিক ধরা পড়ে। জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আমাকে দ্রুত অপারেশন করার পরামর্শ দেন।

চিকিৎসক মেহেদী হাসান লিটন আমার গ্রামের ছেলে হওয়ায় আমি তার পরামর্শ নিই। সে আমাকে তার নিজ ক্লিনিক জাহানার ল্যাব এন্ড নার্সিং হোমে আসতে বলেন। আমি সেখানে গেলে বেশ কয়েকটি টেষ্ট করে। পরে রিপোর্ট দেখে অতিদ্রুত অপারেশন করার পরামর্শ দেন। আমি তার কথামত রাজি হই। তার সাথে অপারেশন বাবদ ১২ হাজার টাকা চুক্তি হয়। সেখানে বলা হয়েছে বাইরের ডাক্তার আসবে, এবং ওষধপত্র দেবে। তার নিজের ক্লিনিকে ৯ নভেম্বর আমার অপারেশ করা হয়। অপারেশন করার সময় মাত্র একজন নার্স নিয়ে চিকিৎসক মেহেদী হাসান একাই আমার অপারেশন করেন। দুই ঘন্টা যাবৎ আমার অপারেশন করেন মেহেদী হাসান। পরে আবার সেলাই দিয়ে বলে আমার পেটে আরো জটিল রোগ আছে। দুটো অপারেশন করতে হবে এমন কথা বলে বাড়ি ফিরিয়ে দেন চিকিৎসক মেহেদী হাসান। তার সাথে ১২ হাজার টাকার চুক্তির বিপরীতে কৌশলে সে প্রায় ২৫ হাজার টাকা লুটে নিয়েছে সে।

বাড়ি ফিরে এসে আমার পেটের যন্ত্রণা আরো বেড়ে যায়। পরে ঢাকার ইসলামিক ব্যাংক হাসপাতালে গেলে কয়েকটি টেষ্ট করেন সেখানকার চিকিৎসকরা। সেখানে এ্যাপান্ডিক হয়েছে বলে জানিয়ে অপারেশন করার পরামর্শ দেন। পরে ২৯ অক্টোবর সেখানেই অপারেশন করি।

অপারেশন করতে গিয়ে সেখানকার চিকিৎসকরা জানান আমার পেটের মধ্যে নাড়ি-ভুড়ি ওলট পালট করে রেখেছে। এজন্য আমার এতো কষ্ট হয়েছে। সেখানে অপারেশন করে বাড়ি ফিরেছি। এখন আমি প্রাণে বেঁচে থাকলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছি। তবে, তার সুস্থ্য হতে গিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলেও জানান অসহায় তারিক আজিজ লিটন।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিনই মেহেদী হাসান লিটন তার ক্লিনিকে মহিলাদের সিজারিয়ানসহ সকল ধরনের জটিল রোগের অপারেশন করছেন। তার অপচিকিৎসায় এলাকায় অনেক এখন মৃত্যুর মুখে বলে জানা গেছে।

মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেহেদী হাসান লিটন মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। সপ্তাহের তিন দিন জেলা কারাগারের চিকিৎসক হিসেবে সরকারি দায়ীত্ব পালন করেন। বাকি তিনদিন রবিবার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে।

জেলা কারাগারের একটি দায়ীত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর মত বাজে মেডিকেল অফিসার আমার জীবনেও দেখিনি। সে তার দায়ীত্ব ঠিকমত পালন করেন না। এই সপ্তাহে তার তিন দিন ডিউটি থাকলেও এসেছে ২ দিন। একদিন ফাঁকি দিয়েছে।

মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার মকলেছুর রহমান বলেন, গতকাল  বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকে মেহেদী হাসান লিটন জেলা কারাগারে দায়ীত্ব পালন করছেন। রাতে জেনারেল হাসপাতালে তার ডিউটি আছে।

মেহেরপুর জেলা কারাগারে সে ডিউটি পালন করছে কিনা খোঁজ নিলে তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার কারাগারে ডিউটি পালন করেনি। পরে তার নিজ ক্লিনিক আমঝুপিতে জাহানারা ল্যাব এন্ড নার্সিং হোমে গেলে তাকে দেখা যায় চিকিৎসায় ব্যস্ত রয়েছেন।
একজন সাধারণ এমবিবিএস চিকিৎসক এনেসথেসিয়া বাদে কোনে অপারেশন করতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনেসথেসিয়া কনসালটেন্ট মশিউর রহমান মোল্লা বলেন, সার্জারীর সময় অবশ্যই একজন এনেসথেসিয়া থাকতে হবে। এনেসথেসিয়া চিকিৎসক না থাকলে শতকরা ৮০ ভাগ রোগীর ঝুঁকি থাকে। অপারেশন করার সময় একজন রোগীর প্রেশার নীল হয়ে যেতে পারে। শ্বাসকষ্ট বাড়ে এবং হার্ট এ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এগুলো ম্যানেজ করার জন্যই সার্বক্ষনিক এনেসথেসিয়া থাকতে হবে। এছাড়া সার্জন ছাড়া কোনো রোগীর অপারেশন করা সম্ভব নয়।

মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাক্তার জমির মোহাম্মদ হাসিবুস সাত্তার বলেন, মেহেদী হাসান লিটন মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের সরসরি চিকিৎসক নন। করোণাকালিন সময়ে বিভিন্ন হাসপতাল থেকে এনে আপাদকালিন সময়ে সংযুক্তি করা হয়েছিল। এদের নিয়ন্ত্রণ করেন সিভিল সার্জন সাহেব। ডাক্তার মেহেদী হাসান লিটন শুধুমাত্র জরুরী বিভাগে দায়ীত্ব পালন করে থাকেন। তিনি বলেন, কোনো সরকারি ডাক্তার নিজে ছুটিতে থাকলেও সরকারি অফিস চলাকালিন সময়ে কোনো ক্লিনিক বা অন্য কোনো খানে প্র্যাকটিস করতে পারবেনা। এটা বিএমডিসির নিয়ম।

এব্যাপারে অভিযুক্ত চিকিৎসক মেহেদী হাসান লিটনের সাথে মোবাইল একাধিকবার যোগাযোগ করার পর ফোন রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় দিতেই কলটি কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ রাখেন।