স্বাধীনতা পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে এ দেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম খাত ছিল পাট। ক্রমান্বয়ে পাটের চাহদিা নানাবিধ কারণে কমতে থাকে। মোটামুটি ৮০’ দশক থেকে আমাদের দেশে পোষাক শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে দেশের পুরাতন সুতাকল গুলোর উৎপাদন নুতন করে বাড়তে থাকে, সেইসাথে তুলাচাষের ব্যপক সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সমস্যা হল দেশের উৎপাদিত তুলা স্থানীয় তাঁত শিল্পের চহিদাই ঠিকমত পূরণে সক্ষম ছিল না তার উপরে মানও তেমন উন্নত না হওয়ায় দেশে তুলা উৎপাদনে ব্যপক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভ’ত হয়।
১৯৭২ সনে তুলা চাষের উন্নয়নের জন্য এদেশে “ কটন বোর্ড” গঠিত হয় যা ছিল মূলত পাকিস্থান কটন বোর্ডের নতুন সংস্করণ। এই বোর্ড দেশের তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চল সমুহের মধ্যে সঠিক পদ্ধতীতে তুলা চাষের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। সেই সময় ঢকার গাজীপুর ছাড়াও রঙপুর,বান্দরবন প্রভিতি স্থানে কটন বোর্ডের স্যাটেলাইট কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কিন্তু এইসব কেন্দ্রে মটিভেসনাল কাজ বেশি হলেও গবেষণা কাজ তেমন ছিল না।
৮০’ দশকে পোষাক শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নের জন্য আমদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০% এই খাত থেকে অর্জিত হতে থাকে। গড়ে ওঠে নুতন নুতন আধুনিক স্পিনিং মিল বাড়তে থাকে কাচাঁতুলার চাহিদা। কিন্তু দেশে সে হারে তুলা উৎপাদিত না হওয়ায় প্রচুর পরিমান তুলা আমদানি করতে হয়। এবং বলতে গেলে আমরা এখনও আমদানি নির্ভর। বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক পরিচর্যা করলে দেশের চহিদার ৪০ থেকে ৫০ ভাগ তুলা দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। এবং এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৯৮০ সনে দেশে আধুনিক মানের “ তুলা উন্নয়ন গবেষণা ও বীজ উৎপাদন খামার” প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূলত এই প্রতিষ্ঠান সমতলে তুলাচাষ,বীজ উন্নয়ন, কৃষকদেও প্রশিক্ষণ সহ উন্নত জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক ভাবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে থাকে। এবং দেশের বিভিন্নস্থান যেমন রংপুর, শ্রীপুর, দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি প্রভৃতি অঞ্চলে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে ব্যাপকভাবে কাজ করতে থাকে। গবেষণায় দেখা যায় দেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের পদ্মা অববাহিকা তুলাচাষের জন্য স¤ভাবনাময় এলাকা। এই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে দেশের বৃহত্তর তুলা উন্নয়ন গবেষণা ও বীজ উৎপাদন কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় যশোরের চৌগাছাতে। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮২ থেকে ২০২৪ সন পর্যন্ত এই কেন্দ্র ১টি হায়ব্রিড (ঈই-১) সহ ৬টা উন্নত জতের তুলাবীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছড়াও এই প্রতিষ্ঠান চিন থেকে একটি উন্নত জাত আমদানি করে কৃষক পর্যায়ে বাজার জাত করে থাকে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৫০০ স্পিনিং মিল আছে এবং এই সব মিলের চাহদা মেটানোর জন্য প্রতি বছর ভারত, পাকিস্থান, মিশর সহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার তুলা আমদানি করে। তবে পরিতাপের বিষয় এ খাত যখন ক্রমাগত উন্নতির দিকে হাটছিল তখনি অসম বানিজ্যনীতির কারণে আমাদের এই সম্ভাবনাময় খাতটি হঠাৎ করেই ধ্বসে পড়ে। আমাদের পার্শবর্তি দেশ ভরতে সুতার মুল্য কম, এবং রঙ ও মান ভাল হওয়াই পোষাক শিল্প মালিক ও স্পিনিং মিল মালিকরা ব্যপক হারে কম শুল্কে স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে থাকে।
বাংলাদেশ হয়ে পড়ে কাচাঁ তুলা ও সুতার ভারতীয় বাজার। এতে আমাদের স্পিনিং শিলগুলো যেমন ক্রমেই বন্ধ হতে থাকে তেমনি অকার্যকর হতে থাকে সম্ভাবনাময় তুলা উন্নয়ন ও গবেষণা কাজ। ক্রমেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকলাপে নেমে আসে স্থবিরতা এবং পর্যাপ্ত বরাদ্ধের অভাবে চলতে থাকে জনবল ছাটায়। গবেষণা ও মটিভেশনাল কাজও এক সময় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি ভারতের সাথে আমাদেওর দেশের বানিজ্যনীতির টান পোড়েনের জন্য ভারত সরকার আমাদের দেশে তুলা, সুতা ও তুলাজাত পন্য স্থলপথে রফতানী সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এতে সংকট আরো ঘনিভ’ত হতে থাকে। ভারত সরকারের এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হঠাৎ করেই বর্তমান কারখানাগুলো বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কিন্তু সরকারের সময়চিত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি দ্রুতই সমাধান হয়।
এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার নিকটবর্তী দেশ ছাড়াও আফ্রীকা, মার্কিনযুক্তরাষ্ঠ্র ও দক্ষিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ থেকে জরুরী তুলা আমদানীর অনুমতি দেন। সাথে সাথে সরকার অনুধাবন করেন যে, দেশের পোষাক শিল্প ও আনুসঙ্গিক তুলাজাতদ্রব্য উৎপাদন টিকিয়ে রাখার জন্য দেশে ব্যাপক তুলাচাষ ও উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে সামনে রেখে সরকার সমতলের তুলাচাষের ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যশোরের ”তুলা উন্নয়ন গবেষণা ও বীজ উৎপাদন খামারের” প্রতি নুতন কওে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এবং এর উন্নয়নের জন্য যথাপুযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের উদে¦্যগ নেন, সংশ্লিষ্ঠ বিষেষজ্ঞরা ভারতের এই সিদ্ধান্তকে দেশের তুলাচাষের জন্য মঙ্গল বলেই মনে করছেন।
তবে এক্ষেত্রেও সরকার পরিচালিত অন্যান্য খামারের মত কিছু সমস্যার কথা উঠে আসে। সর্বত্র সক্ষমতার অভাব ও প্রকট জনবল সংকট ও সম্বয়হীনতা। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম লোকবল দিয়ে এখানে কাজ করা হয়, ফলে সঠিক গবেষণা ,মাঠপর্যায়ে কাজ করা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও মটিভেষনাল কাজগুলো যথাযথভাবে করা সম্ভব হয় না। মাঠপর্যায়ে এখানকার উৎপাদিত বীজ কৃষদেও মাঝে বন্ঠন এবং ফলাফর সংরক্ষনের জন্য যে ধরণের শিক্ষীত কর্মী প্রয়োজন তেমনটা না থাকায় সব সময় সঠিক রেজাল্টও পাওয়া যায় না। তার পরেও এখানকার উৎপাদিত জাাত গুলোর চাহিদা অনেক বেশি বলে জানা যায়। হাই ব্রীড অপেক্ষা উন্নত জাত গুলোর চহিদা কৃষক পর্যায়ে বেশি। একইভাবে হাইব্রীড তুলা চাষের বাড়তি পরিচর্যা ও অতিরিক্তি খরচ ও কিছুটা ঝুকির বিষয়ও মাঠপর্যায় থেকে জানা যায়।
তুলাচাষের সম্ভাবনার মাঝেও বেশ কিছু সমস্যা চাষিদের কাছ থেকে উঠে আসে। চাষিদেও বক্তব্য থেকে জানা যায়, তুলার বলওয়র্ম একটা মারাত্তক বালায়, তাছাড়া পরিচর্য়ার অভাব, জিনিং অসুবিধা সহ বাজারজাত করণের অভাব ও সঠিক মুল্য না পাওয়াতে চাষিরা তুলাচাষে অনেক সময় আগ্রহ দেখান না। অথবা তুলা চাষে লাভবান হন না। তবে আশার কথা বিশেষজ্ঞগন এই সমস্যা সমাধানের জন্য যশোর কেন্দ্র থেকে তুলার সাথে সাথী ফসল চাষের বিশেষ পদ্ধতি আবিস্কার করেছেনে। ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি কুষ্টিয়া সহ দেশের অন্যান্য এলাকাতেও বেশ আগ্রহের সৃস্টি হয়েছে।
বর্তমানে তুলা চাষে আবার গতি ফিরেছে। দেশে প্রায় ১০ জেলার ৬০০ হেক্টও জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। এবং র্বমান সরকার তুলা চাষের উপরে কৃষকদের আগ্রহ সৃস্টির জন্য যশোর কেন্দ্্কে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। তুলা রবি ফসল এটা তামাক মৌসুমে ফলে থাকে। দরকার হলে তামাক চাষ সীমিত করে হলেও কৃষকদের তুলা চাষে উদ্বুদ্ধ করা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন।
তুলাচষে ব্যপকতা সৃস্টি ও অধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যশোর কেন্দ্রের এই উজ্জীবনকে আমরা সাধুবাদ জানাই। সেই সাথে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বেশকিছু সরকারী কৃষি খামারকেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ঠ করার বিষয়ে ভেবে দেখার অনুরোধ এলকাবাসির। ইতোপূর্বে মেহেরপুরের মাটি ও জলবায়ু তুলাচাষের জন্য যথেষ্ঠ উপযোগী বলে কৃষি আধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল এবং ’৯০ দশকে বেশ কাজও হয়েছিল।
মেহেরপুরের যে ৩/৪ টা কৃষি খামার আছে সেগুলোতে বর্তমান বাজার চাহিদা ও জাতীয় অর্থনীতিতে পোষাক শিল্পের অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে মাঠ-ফসলের পাশাপাশি তুলা চাষের দিকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে এলাকাবাসি মনে করে। বিপুল সম্ভাবনাময় এই খাতকে কোন ক্রমেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
প্রয়োজনে দক্ষজনবল, প্রশিক্ষণ ও যান্ত্রিক কাঠোমো উন্নয়নের মাধ্যমে তুলাচাষে আগ্রহী চাষিদেও আগ্রহী ও দক্ষ করে তুলতে পারলে একদিকে যেমন ক্ষতিকর তামাক চাষ কমে আসবে তেমনি দেশ আমদানি কৃত ৮০ লক্ষবেল তুলার বিপরিতে ৪০ থেকে ৬০ লক্ষ বেল তুলা দেশেই উৎপাদন করতে সক্ষম হবে; এবং দেশের প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
এক্ই সাথে পুঃনজাগরিত হবে স্পিনিং মিল, সুতা ও কাপড়কল। তুলাবীজ থেকে উৎপাদিত হবে উন্নত মানের ভেজ্যতেল ও পুষ্ঠিগুন সম্পন্ন খৈল যা উন্নত পশুখাদ্যের জন্য আমরা আমদানী করে থাকি। জাতীয়সার্থেই আমাদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে এমনটাই আশাবাদ সকলের।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও পরিবেশবিদ