দারাজসহ ১৩ প্রতিষ্ঠানের নামে অভিযোগ দায়ের

‘এক টাকায় গাড়ি’ মিলবে এমন প্রলোভন দিয়ে ফেসবুক পেজে অফার দিচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজ অনলাইন শপিং। এ অফারে বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। একইভাবে বাজারমূল্য থেকে ৩৫ শতাংশ কমে মোটরসাইকেল বিক্রির অফার দিয়েছে আলেশা মার্র্ট।

শুধু দারাজ ও আলেশা মার্ট নয়, আরও ১১টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নানাভাবে বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করছে যা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।

এসব প্রতিষ্ঠানকে বিচারের আওতায় আনতে প্রতিযোগিতা কমিশন তাদের বিরুদ্ধে স্ব-প্রণোদিত হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছে। এরপর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুরু করেছে প্রাথমিক অনুসন্ধান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো- দারাজ অনলাইন শপিং, আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, কিউকম ডটকম, ধামাকা ও আলাদিন প্রদীপ। এ ছাড়া আনন্দের বাজার, ফাল্গ–নি শপ ডটকম, ই-অরেঞ্জ, আদিয়ান মার্ট, থলে, শ্রেষ্ঠ, দালাল প্লাস এবং ২৪কেটি.কম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মজিবুল ইসলামের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী একটি পণ্য অন্যান্য কোম্পানির উৎপাদিত একই পণ্যের দামের তুলনায় অনেক বেশি কমে বিক্রি করতে পারবে না। বাজারে পণ্যের এ ধরনের আচারণে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হবে। দারাজ অনলাইন শপিং এক টাকায় গাড়ি মিলবে এই বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

তিনি বলেন, দারাজের মতো অন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও বাজারে পরিবেশ নষ্ট করছে এমন ধারণা থেকে কমিশন নিজেই অভিযোগ দায়ের করেছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্তে দায় সাব্যস্ত হলে পরবর্তী প্রক্রিয়া শেষ করে বিচারের আওতায় আনা হবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন দু’ভাবে অভিযোগ আমলে নেয়। এক হচ্ছে বাইরে থেকে কোনো সাধারণ ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- প্রয়োজন মনে করলে কমিশন নিজেই স্ব-প্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ে করে।

সূত্র জানায়, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরেজমিন গিয়ে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে অপরাধ প্রমাণ হলে কমিশনে তাদের শুনানির জন্য ডাকা হবে। ওই শুনানিতে হাজিরা দিয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে। এরপর চূড়ান্তভাবে অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থদণ্ড।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার যদি এক হাজার কোটি টাকা হয়, ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ অর্থদণ্ড হবে ১০০ কোটি টাকা। ফলে আর্থিক দণ্ড দেখাবে বিশাল।

এদিকে গত ২ ডিসেম্বর ‘নিরাপত্তাহীনতা’ কারণ দেখিয়ে আলেশা মার্টের অফিসিয়াল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, আগামী জানুয়ারির মধ্যে সব গ্রাহকের দায় মেটানো হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে অসংখ্য তরুণ টাকা পায়, যারা কম দামে মোটরবাইক কিনতে অর্থ জমা দিয়েছে।

জানা গেছে, অফিসিয়ালি বন্ধের পর প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে বাজারমূল্য থেকে ৩৫ শতাংশ কমে মোটরবাইক বিক্রির ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে তারা এই অফারের মাধ্যমে ৪৬ হাজার মোটরবাইকের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ৬৫৮ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন যে ১৩টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে এর মধ্যে ধামাকা শপিং এবং সিরাজগঞ্জ শপের সদস্য বাতিল করেছে ই-ক্যাব। এরা নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতাদের পণ্য বা মূল্য ফেরত দেয়নি। পাওনা পরিশোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেয়নি। এ ছাড়া অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখার কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। তবে আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে ধামাকা এরই মধ্যে ৮০৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ শপের বিরুদ্ধে ৪৭ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সঠিক জবাব না দেওয়া ও ক্রেতাদের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি না করায় এ প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল করেছে ই-ক্যাব।

এদিকে আনন্দের বাজার, দালাল প্লাস, থলে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে মোটরবাইক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের অফার করেছে। অগ্রিম দাম পরিশোধের পর ২০ থেকে ৪০ কর্মদিবসের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের অফার বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট করছে। এটি আমলে নিয়ে এই তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে কমিশন। তিন প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের কয়েক শ’ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। প্রায় সবগুলোর মালিকই লাপাত্তা, অফিস বন্ধ। কিন্তু অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চলছে।

এর আগে অস্বাভাবিক অফার দিয়ে অনলাইন কেনাকাটায় গ্রাহকদের প্রতারিত করার অভিযোগে এই তিন প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল থেকে।

ওই চিঠিতে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে দায়ের পরিমাণ এবং দায় পরিশোধের লক্ষ্যে কোম্পানির চলতি সম্পদের পরিমাণ ও পরিকল্পনা জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া দেশব্যাপী প্রতারণার জাল বিছানো কোম্পানির নাম ‘আলাদিনের প্রদীপ’। কোম্পানির মালিক মেহেদী হাসান মুন আলাদিনের প্রদীপ হাতে পেলেও, আর্তনাদ করছেন টাকা দিয়ে পণ্যের অপেক্ষায় থাকা ক্রেতারা।

কিউকম ডটকম ৩০ সেপ্টেম্বর এক নোটিশে অফিস বন্ধ করে দেয়। বিগ বিলিয়ন নামে বাইক বিক্রির প্রতিষ্ঠানটি অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এ প্রতিষ্ঠানের সন্দেহজনক লেনদেনের বিরুদ্ধে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে আদিয়ান মাট অন লাইনের বিরুদ্ধেও।