কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর আধুনিকায়ন প্রকল্পটির কাজ ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দীঘ ১৪ বছরেও প্রকল্পের কাজটি শেষ হয়নি।
ফলে ভারতীয় প্রকৌশলীরা সহ ২২ জনকে বসে বসে ডলারে বেতন গুনছে কতৃপক্ষ।
জানা গেছে, প্রথমে দুই বছর সময় বেঁধে দিয়ে ২০১২ সালে ‘বিএমআর অব কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড’ নামে প্রকল্পটির অনুমোদন দেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক পুরোনো এই চিনিকলটির আধুনিকায়ন এবং আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে তখন খরচ ধরা হয়েছিল ৪৬ কোটি টাকা। কিন্তু সে সময়ে তো হয়নি বরং একবার নয়, দুইবার নয় সাতবার সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাড়িয়েছে ১০২ কোটি টাকায়। তার পরও ১৪ বছরে শেষ হয়নি প্রকল্পটির কাজ। তাই বাকি কাজ শেষ করতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলে সম্প্রতি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের জুনে পুরো কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ১৭ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অষ্টমবারের মতো সংশোধনের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।
পরিকল্পনা কমিশন ও শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান।এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৮ সালে দর্শনায় স্থাপন করা হয়। শুরুতে দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ১৬ মে. টন। পরে ক্ষমতা কমে গেলে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেডের। সুগার ইউনিট প্রতিস্থাপন, চিনিকলটির আখ মাড়াই, চিনি উৎপাদন ক্ষমতা সংরক্ষণ এবং যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রসেস লস ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বিএমআর অব কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড’ প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১২ সালের ২০ এপ্রিল। খুবই পুরোনো কেরু অ্যান্ড কোং চিনিকলকে আধুনিকায়ন এবং আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যেই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
শুরুতে ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার জন্য একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন খরচ ধরা হয়েছিল ৪৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। কিন্তু দুই বছরে কাজের কাজ হয়নি। পরে সংশোধন করে এক বছর সময় বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ শেষ হয়নি। এরপর দেড় বছর সময় বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তারপরও কাজ না হওয়ায় শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আবার সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবটি পাঠানো হলে তা যাচাই করতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। সভায় কিছু ব্যাপারে আপত্তি করা হলে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধন করে পাঠানো হলে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন এক লাফে সাড়ে তিন বছর সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। একই সঙ্গে খরচ দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে ধরা হয় ১০২ কোটি ২১ লাখ টাকা। খরচ বাড়ে ১২০ শতাংশ। কিন্তু তাতেও হয়নি পুরো কাজ। এরপর প্রতিবছর সংশোধন করে প্রতিবারে এক বছর করে সময় বাড়ানো হয়; যার মেয়াদ ছিল ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এভাবে প্রকল্পটির মেয়াদ একের পর এক বাড়ানো হয়েছে। এ পর্যন্ত সাতবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কিন্তু এই ১৪ বছরে খরচ করা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত যন্ত্রপাতি চালিয়ে গত ১৫ থেকে ১৬ মার্চ শুধু ওয়াটার ট্রায়াল রান সম্পন্ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বুঝা যায় আখ মাড়াই তথা চিনি উৎপাদনের জন্য ৫০ শতাংশ কার্যকর হয়েছে। তাই বাকি কাজ শেষ করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আবার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে আইএমইডির মতামত নিতে বলা হয়।
আইএমইডি তার মতামতে বলেছে, প্রকল্পটি দীর্ঘদিন থেকে চলমান। কিন্তু কাজ শেষ পর্যায়ে। তাই বাকি কাজ শেষ করার জন্য এক বছর সময় বাড়ানো যেতে পারে। এরপর আর সময় বাড়ানো যাবে না। একই সঙ্গে কোনো খরচও বাড়ানো যাবে না। আইএমইডির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশন সব কিছু যাচাই করে একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের আগে মতামতে বলেছে- প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চিনিকলের আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আখ মাড়াই ও চিনি প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতির আধুনিকায়নের মাধ্যমে চিনিকলের প্রসেস লস কমে যাবে। ফলে জনসাধারণের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে। সম্পূর্ণ মাড়াই মৌসুমে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের মাধ্যমে ট্রায়াল রান সম্পন্ন করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। তাই প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো যেতে পারে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) প্রকল্পটিতে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পের প্রায় সব কাজ শেষ হলেও গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হলে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা আসেননি। প্রোডাকশন ট্রায়াল রান সম্ভব হয়নি। এ কারণে সময় বাড়ানো ছাড়া বিকল্প ছিল না। প্রকল্পটির খরচ অপরিবর্তিত থাকলেও মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে বাস্তবায়ন শেষে আখ মাড়াই ও চিনি প্রক্রিয়াকরণে যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে প্রসেস লস কমবে, উৎপাদন বাড়বে এবং স্থানীয় কৃষি ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান বলেন,কাজ এখনও বুঝিয়ে দেয়নি কাজ বুঝিয়ে দিলে আমরা তা বুঝ করে নিব।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রশিদুল হাসানের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে ফোনটি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে রবিবার বেলা সাড়ে ১২ টা থেকে দুপুর ২ টা পযন্ত প্রায় দেড় ঘন্টা যাবৎ কেরুর বিএম আর প্রকল্পের কাজ পরিদশন করেন মেজর জেনারেল নাহিদ আজগার, ব্রিগেডিয়ার সাজ্জাদ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলামিন হোসেনসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৯ সদস্যর একটি টিম।