
একটি প্রতিভা, একটি কণ্ঠ ও একটি মঞ্চ—এই তিনের অপূর্ব মেলবন্ধনে প্রিয়সী চক্রবর্তী এখন নতুন কুঁড়ির দেশসেরা শিশুশিল্পী। গান যেন তার সঙ্গী, আর মঞ্চ যেন তার নিজের ঘর। সেই আলোকিত ঘরে দাঁড়িয়ে আট বছর বয়সি এই শিশুশিল্পী প্রমাণ করেছে—মন থেকে সংগীতচর্চা করলে বয়স কখনো বাধা হতে পারে না। নতুন কুঁড়ির রঙিন মঞ্চে তার গান লক্ষ শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করেছে।
প্রিয়সী চক্রবর্তী টাঙ্গাইল সদর উপজেলার শাহিন ক্যাডেট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রিয়সী ২০২৫ সালের নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার ‘ক’ শাখার সেরা পুরস্কার বিজয়ী শিশুশিল্পী। সে আধুনিক গান ও রবীন্দ্রসংগীত— উভয় বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এবারের নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় কোনো প্রতিযোগী দুটি বিভাগে প্রথম হতে পারেনি। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতা।
একদিন প্রিয়সীর বাবা টাঙ্গাইল শিল্পকলা একাডেমির ওয়ালে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন দেখতে পান। বিজ্ঞাপন দেখে মেয়েকে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরপর শুরু হয় প্রিয়সীর নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার যাত্রা। আঞ্চলিক বাছাই অনুষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহে। নতুন কুঁড়ির মঞ্চে প্রিয়সীর প্রথম গান ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায়…’। আঞ্চলিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রিয়সীকে নিয়ে পরিবারের স্বপ্ন বড় হতে থাকে।
প্রিয়সীর জন্ম ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আকুর টাকুর পাড়ায়। তার পিতা সঞ্জয় চক্রবর্তী সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা। আর মা রাখী চক্রবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। দুই বোনের মধ্যে প্রিয়সী ছোট। বড় বোন শ্রেয়সীর কাছ থেকে সে সংগীতের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। শ্রেয়সী এখন দিল্লীতে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করছেন। পরিবারের স্বপ্ন শ্রেয়সী ও প্রিয়সী দুজনই একদিন গুণী শিল্পী হবে। পরিবারের এই স্বপ্ন প্রিয়সীর মানসিক দৃঢ়তাকে আরও শক্তিশালী করছে।
দেশসেরা প্রিয়সীকে গানের শিক্ষা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপক ড. অসীত রায়। প্রিয়সীর সফলতার পিছনে গুণী এই শিক্ষকের অনেক অবদান রয়েছে। প্রিয়সী সম্পর্কে ড. অসীত রায় বলেন, ওর সংগীত প্রতিভা অসাধারণ। এই বয়সের কোনো শিশুশিল্পীর মধ্যে সংগীতের যে বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে থাকা উচিত, ওর মধ্যে তার থেকে একটু বেশিই আছে। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় সে প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছে। ড. অসীত রায় আশাপ্রকাশ করে বলেন, প্রিয়সী একদিন বাংলাদেশের গর্ব করার মতো একজন গুণী শিল্পী হবে।
নতুন কুঁড়ির প্রতিটি ধাপেই প্রিয়সী তার নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সংগীতের প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছে। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় প্রিয়সীর পরিবেশিত গানের মধ্যে রয়েছে—‘ওই ঝিনুক ফোটা সাগর বেলা…’, ‘তুমি মিষ্টি করে দুষ্টু বলো…’, ‘মন তো ছোঁয়া যাবে না…’, ‘আমি কি তোমার মতো এত ভালোবাসতে পারি…’ প্রভৃতি। তার কণ্ঠ, সুর ও গায়কি দর্শক-শ্রোতার মন ছুঁয়েছে। প্রতিযোগিতার বিচারকগণও তার অনবদ্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছেন। প্রিয়সীর গান শুনে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্বে থাকা কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা বলেন, ‘‘প্রিয়সীর অনবদ্য একটা কণ্ঠ রয়েছে। ওর গান শুনলে যেন ওর গানের ওপর ঘুমাতে ইচ্ছা করে। ওর গানে কোনো ভুলভাল নেই।’’ প্রিয়সীর গানের প্রশংসা করে প্রতিযোগিতার বিচারক কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘সে অনেক সুন্দরভাবে সংগীত পরিবেশন করেছে। তার গানের সুর ও উচ্চারণ—দুটিই ভালো।’’ বিচারক ময়নুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘আমি প্রিয়সীর সংগীত পরিবেশনায় অনেক বেশি সন্তুষ্ট হয়েছি। বয়স অনুযায়ী সে যথেষ্ট ভালো করেছে।’’ বিচারক মকসুদ জামিল মিন্টু বলেন, প্রিয়সী প্রতিটি গান সুন্দরভাবে গেয়েছে। ওর সুর ও এক্সপ্রেশন ভালো ছিল। গানের ভুবনে সে একদিন আলো ছড়াবে।’’ প্রিয়সীর গান শুনে বিচারক সাজ্জাদ হোসেন পলাশ বলেন, ‘‘অসাধারণ, অসাধারণ এবং অসাধারণ। ওর গায়কি, উচ্চারণ—সবকিছু ভালো লেগেছে।’’ নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালনকারী কণ্ঠশিল্পী আগুন ও ন্যান্সিও প্রিয়সীর গানের প্রশংসা করেছেন।
গত ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকার চেক ও ট্রফি গ্রহণ করেন নতুন কুঁড়ির ‘ক’ শাখার দেশসেরা শিশুশিল্পী প্রিয়সী চক্রবর্তী। পুরস্কার গ্রহণের পর প্রিয়সী বলেন, ‘‘সরকারপ্রধানের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই পুরস্কার আমার সংগীতজীবনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। … আমি বড় হয়ে একজন গুণী শিল্পী হতে চাই।’’
নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ সংযোজন। নতুন কুঁড়ির মঞ্চ শিশুদের শৈল্পিক বিকাশের পাশাপাশি তাদের দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে তোলে। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা উপমহাদেশের বৃহত্তম রিয়েলিটি শো। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মোঃ মাহফুজ আলমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ২০ বছর পর নতুন উদ্যমে শুরু হয় নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই প্রতিযোগিতা বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। এ বছর ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩৯ হাজার প্রতিযোগী অংশ নেয়। ৬৪ জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে ভাগ করে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আঞ্চলিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক পর্ব থেকে ‘ক’ ও ‘খ’ শাখা মিলিয়ে সকল ক্যাটাগরিতে প্রায় ১৪ হাজার প্রতিযোগী বিভাগীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়। দেশের আট বিভাগে একযোগে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতার মোট বিষয় ছিল ১২টি। এগুলো হলো : অভিনয়, আধুনিক গান, আবৃত্তি, উচ্চাঙ্গ নৃত্য, কৌতুক, গল্পবলা, দেশাত্মবোধক গান, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত, সাধারণ নৃত্য ও হামদ-নাত। বিভাগীয় পর্যায় শেষে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্ব। আট বিভাগ থেকে ১ হাজার ৪০ জন প্রতিযোগী চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়। চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ ২৭৯ জন প্রতিযোগী সেরা ১০ পর্বে অংশগ্রহণ করে। এই পর্ব থেকে সেরা ৫ জন বাছাই করা হয়। এরপর ফাইনালে ‘ক’ বিভাগ থেকে ৩৬ জন এবং ‘খ’ বিভাগ থেকে ৩৭ জন প্রতিযোগীকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। দীর্ঘ এই প্রক্রিয়ায় ‘ক’ বিভাগে সেরাদের সেরা অর্থাৎ চ্যাম্পিয়ন হয় প্রিয়সী চক্রবর্তী।
এ বছর স্বচ্ছ ও ন্যায্য প্রক্রিয়ায় সারা দেশ থেকে নতুন কুঁড়িদের বাছাই করা হয়েছে। ২৯৩ জন বিজ্ঞ বিচারক এই বাছাই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে এবারে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শ্রেণির শিশু-কিশোর এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। বিটিভিতে প্রচারিত নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার প্রতিটি পর্ব বিটিভির ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলেও প্রচার করা হয়েছে। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই প্রতিযোগিতার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিটি শিশুর কোনো না কোনো বিশেষ প্রতিভা থাকে। শিশুদের বিশেষ প্রতিভা খুঁজে বের করাই নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা প্রিয়সীর মতো অসংখ্য প্রতিভা আবিষ্কার করেছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। ‘নতুন কুঁড়ি’ শিশু-কিশোরদের কাছে শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং শিল্পজীবনের প্রথম পাঠশালা। অল্প বয়সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গানের সুর তোলা, কবিতার ছন্দে ভেসে যাওয়া কিংবা নাটকের সংলাপ উচ্চারণ করার অভিজ্ঞতা শিশু-কিশোরদের সারাজীবনের আত্মবিশ্বাস গড়ে দেয়।
প্রিয়সীর সেরা হওয়া শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার অর্জন। প্রিয়সীর সাফল্য প্রমাণ করেছে—শিশুপ্রতিভা যথাযথ সুযোগ ও উৎসাহ পেলে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তার এই সাফল্য অন্য শিশু-কিশোরদেরও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করবে। প্রিয়সীর মতো অসংখ্য প্রতিভাবান শিশু আগামী দিনের নতুন কুঁড়ির মঞ্চে প্রতিভার আলো ছড়াবে এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত