
নাম তাঁর দেবদূত রায়। ঈশ্বরের বার্তাবাহক বা স্বর্গীয় দূত হিসেবে সম্মান মর্যাদার কথা বিবেচনায় নিয়েই বাবা-মা ছেলের নাম রেখেছিলেন দেবদূত। কিন্তু মেহেরপুরের সদর এলএসডি (ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা) দেবদূত রায় নিজের নামের সাথে সুবিচার না করে জড়িয়েছেন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে।
মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দেবদূতের নানা অনিয়ম ও দুনীতির চিত্র।
দু’বছর আগে মেহেরপুর সদর এলএসডি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন দেবদূত রায়।
জেলার খাদ্য গোডাউনগুলো নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়াবাড়ি। মেহেরপুর জেলার খাদ্য গোডাউনগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে এই অনিয়ম দুর্নীতি চলে আসলেও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তাব্যক্তিরা কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।
মেহেরপুর পৌরসভার মধ্যে দুটি স্থানে বড়বাজার এবং কলেজ রোডে ৬টি, আমঝুপিতে ২টি এবং গাংনীতে ৩টি সর্বমোট জেলায় ১১টি খাদ্য গোডাউন আছে।
সদর এলএসডি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেবদূত রায় পৌরসভার মধ্যে ৬টি গোডাউনের দায়িত্বে ছিলেন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি মেহেরপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসে ডেপুটেশনে রয়েছেন। চাল মিলারদের সাথে যোগসাজশে ব্যবসায় যুক্ত থাকা, আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের চাল গোডাউনে উত্তোলন, গোডাউনের নিরাপত্তা প্রহরীদের কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া সহ নানা অভিযোগ দেবদূতের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ৬০০ মে. টন চাল প্রোগ্রামের মাধ্যমে মেহেরপুর এলএসডি’তে আসে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া এলএসডি থেকে ৩০০ মে. টন এবং জগতি এলএসডি থেকে ৩০০ মে. টন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ৬০০ মে. টন চালের মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ ভালো চাল, বাকিটা নিম্নমানের লাল চাল গ্রহণ করেছে দেবদূত। কুষ্টিয়া মিলারদের সাথে মেহেরপুর এলএসডি’র নিরাপত্তা প্রহরী আমানুজ্জামান লাভলুর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনও করে থাকেন তিনি।
গোডাউনের ভিতরে বাজে চালের সাথে ভালো চাল মিশিয়ে নতুন বস্তা প্রস্তুত করানো দেবদূত রায়ের নিত্যকার কাজকর্মের একটি।
২০২৫ সালের মে মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত বোরো চাল ক্রয় করা হয়। এই চালগুলো সবই নতুন চাল হওয়ার কথা, কিন্তু অধিকাংশই পুরাতন চাল। মিলের ইস্টেন্সিল নেই, WQSC নাম্বার নেই। লটের চারদিকে নতুন ভালো চাল রেখে ভিতরে পুরাতন খারাপ চাল রাখা হয়েছে। যার মধ্যে এফএস-১ চা/২৭/ ৪০০ বস্তায় চাল আছে ১২০ মে. টন। এফএস-১ চা/৩৫/ ২০৬৯ বস্তায় চাল আছে ৬২ মে. টন। এফএস-৪ চা/৩৪/ ২৯২৭ বস্তায় চাল আছে ১৪৬ মে. টন। এগুলো অধিকাংশই পুরাতন চাল।
প্রত্যেক এলএসডি একটি সংরক্ষিত এলাকা। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, এএসআই, নিরাপত্তা প্রহরী সকলের জন্যই আলাদা আলাদা কোয়ার্টার আছে। এলএসডির ভিতরে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী। মেহেরপুর এলএসডি’র কোয়ার্টারে থাকছেন অথচ ভাড়া দিচ্ছেন না। তাদের মধ্যে এএসআই মামুনুর রশিদ, পোস্টিং গাংনী, ১৫ জুলাই ২০১৫ সাল থেকে মেহেরপুরের কোয়ার্টারে বসবাস করছেন ভাড়া বিহীন।
নিরাপত্তা প্রহরী আলামিন শেখ ২৭ আগস্ট ২০২৩ থেকে কোয়ার্টারে আছেন ভাড়া বিহীন। গোডাউনের বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে ফুটপাতে খাবারের ব্যবসা করেন, সেই বিদ্যুৎ লাইন থেকে টাকার বিনিময়ে অন্যদের সংযোগ দেন।
নিরাপত্তা প্রহরী কুদ্দুস ৩০ আগস্ট ২০২৩ থেকে কোয়ার্টারে বসবাস করছেন ভাড়া বিহীন। গোডাউনের বাইরে ফুটপাতে ব্যবসা করেন।
ঝাড়ুদার হাফিজুর ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে এএসআই কোয়ার্টারে ভাড়া বিহীন বসবাস করছেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেবদূত রায়ের ঘনিষ্ঠজন। খুলনা থেকে তাকে এখানে মাস্টার রোলে চাকরি দিয়েছেন।
নিরাপত্তা প্রহরী আমানুজ্জামান ২১ মে ২০২৩ থেকে বসবাস করছেন এএসআই কোয়ার্টারে। ভাড়া দেন না। একটা কোয়ার্টার খালি আছে, সেটাতে মুরগি, কবুতর, ছাগল পোষা হয়। নিরাপত্তা প্রহরী আমানুজ্জামান ও আলামিন এই কাজটি করে থাকেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেবদূত রায়ের মোবাইল ফোনে বারবার ফোন করলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এরশাদ আলীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) আসমা উল হোসনা এইসব অনিয়মের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি তাই সকল অভিযোগ খতিয়ে দেখবো। একটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করবো এবং কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
(আগামী পর্বে পড়ুন গাংনী ও আমঝুপি এলএসডিদের নিয়ে সংবাদ। )