প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ওজোন দিবস পালিত হয়। ১৯৮৭ সালের মন্ট্রিল প্রটোকল এ দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে। এদিন মানবজাতি প্রথমবারের মতো একত্রিত হয়ে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর রক্ষায় আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এ বছরের প্রতিপাদ্য “From science to global action” যার বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে “বিজ্ঞানসম্মত কর্ম, ওজোন রক্ষায় বর্ম”।
প্রতিপাদ্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে বাস্তব কর্মপরিকল্পনায় রূপান্তর করার অঙ্গীকার। প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশে ১৬ সেপ্টেম্বর সরকারিভাবে বিশ্ব ওজোন দিবস পালন করা হবে। এ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র্যালি, সেমিনারের আয়োজন করা হবে। এছাড়াও দিবসের প্রতিপাদ্যে গণমাধ্যমে বিশেষ কর্মসূচি প্রচারিত হবে।
বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসসমূহের মধ্যে ওজোন গ্যাস অন্যতম। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫-৩৫ কিলোমিটার উচ্চতায় স্ট্রাটোস্ফিয়ারে যে অংশে সর্বাধিক ঘনমাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে, সেটিই ওজোন স্তর নামে পরিচিত। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে এ স্তর পৃথিবীর জীবজগতকে সুরক্ষা দেয়। তাই একে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ঢালও বলা হয়ে থাকে।
ওজোন স্তর ক্ষয় হলে অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে প্রবেশ করে মানুষের ত্বকে ক্যান্সার, চোখে ছানি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। একই সঙ্গে উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়, ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায় এবং সামগ্রিকভাবে জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ওজোন স্তর ক্ষয় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে আরও তীব্র করতে পারে।
বিগত শতকে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন শিল্পজাত রাসায়নিক ওজোন স্তর ক্ষয়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি), হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফরম, হাইড্রোক্লোরোফ্লোরোকার্বন (এইচসিএফসি), মিথাইল ব্রোমাইডসহ বহু রাসায়নিক দ্রব্য একসময় রেফ্রিজারেন্ট, ফোম ব্লোয়িং এজেন্ট, সলভেন্ট, প্রোপেল্যান্ট ও অগ্নিনির্বাপক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এসবকেই বলা হয় ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য (ওডিএস)। এগুলো শুধু ওজোন স্তর নয়, বরং অধিকাংশই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবেও চিহ্নিত।
ওজোন স্তর রক্ষায় বৈশ্বিক পদক্ষেপের সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে ভিয়েনা কনভেনশন গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে। এরপর ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে গৃহীত হয় ঐতিহাসিক মন্ট্রিল প্রটোকল যা আজ বিশ্বের অন্যতম সফল পরিবেশ চুক্তি হিসেবে স্বীকৃত। এই প্রটোকলের আওতায় ধাপে ধাপে ওডিএস-এর ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গৃহীত হয় কিগালি সংশোধনী। এর মাধ্যমে ১৮ ধরনের উচ্চ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোফ্লোরোকার্বন (এইচএফসি)-এর ব্যবহার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও এইচএফসি সরাসরি ওজোন স্তর ক্ষয় করে না, তবে এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই এ নিয়ন্ত্রণ জলবায়ু সুরক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট মন্ট্রিল প্রটোকল অনুস্বাক্ষর করে এবং পরবর্তীকালে লন্ডন, কোপেনহেগেন, মন্ট্রিল ও বেইজিং সংশোধনীসমূহ অনুস্বাক্ষর করে। সরকার ২০২০ সালের ৮ জুন কিগালি সংশোধনী অনুস্বাক্ষর করেছে। প্রটোকল বাস্তবায়নে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে “ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৪” জারি করা হয় এবং ২০১৪ সালে বিধিমালাটি সংশোধিত হয়। উক্ত বিধিমালার আওতায় দেশে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক লাইসেন্সিং সিস্টেম চালু করা হয়। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর এবং সংশ্লিষ্ট সার্ভিস সেক্টরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে একাধিক পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে ১ জানুয়ারি ২০১০ হতে দেশে সিএফসি, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ও মিথাইল ক্লোরোফরমের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওষুধ শিল্প থেকে সিএফসি এবং রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ফোম তৈরিতে ব্লোয়িং এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত এইচসিএফসি-১৪১বি-এর ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ এইচসিএফসি ব্যবহার বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে এইচসিএফসি-এর ব্যবহার ৬৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এইচপিএমপি স্টেজ-টু প্রকল্পের আওতায় ৪টি এয়ার কন্ডিশনার প্রস্তুতকারক কারখানা ও একটি চিলার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে গৃহস্থালি এসি তৈরিতে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য আর-২২ এর পরিবর্তে আর-২৯০ এবং আর-৩২-এ রূপান্তর করা হচ্ছে। পাশাপাশি রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং সেক্টর সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ানদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও দেশে রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং সেক্টরে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রচলনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি নীতিসমূহ হালনাগাদ করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি এ বছর শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মন্ট্রিল প্রটোকলের ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে এইচসিএফসি ফেজ-আউট টার্গেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কিগালি সংশোধনীর আওতায় উচ্চ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ক্ষমতাসম্পন্ন এইচএফসিসমূহ নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছে। সরকার ২০২০ সালের ৮ জুন কিগালি সংশোধনী অনুস্বাক্ষর করেছে। এ সংশোধনীর আওতায় বাংলাদেশকে ২০৪৫ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ এইচএফসি ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। এ প্রেক্ষিতে এইচএফসিসমূহের আমদানি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০২১ সালে একটি এসআরও জারির মাধ্যমে লাইসেন্সিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে এবং এর আওতায় ২০২২ সাল থেকে সরকার এইচএফসি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়াও মন্ট্রিল প্রটোকল মাল্টিল্যাটারাল ফান্ডের আর্থিক সহযোগিতা এবং ইউএনডিপি ও ইউএনইপি-এর কারিগরি সহায়তায় কিগালি ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান প্রণয়নে কাজ শুরু করা হয়েছে। অধিকন্তু, প্যারিস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কর্তৃক ২০২১ সালে প্রণীত ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কন্ট্রিবিউশনে এ সেক্টর থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২ দশমিক ৯২ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য নিঃসরণ হ্রাস করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সর্বোপরি, ওজোন স্তর রক্ষায় বাংলাদেশ শুরু থেকেই সফলভাবে মন্ট্রিল প্রটোকলের বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। মন্ট্রিল প্রটোকলের সফল বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কর্তৃক একাধিকবার বিশেষভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। তাছাড়া ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের চোরাচালান রোধে কার্যকর ভূমিকার জন্য ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি দ্বারা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
ওজোন স্তর আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক ঢাল। একে রক্ষা করা শুধু পরিবেশ নয়, মানবস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মন্ট্রিল প্রটোকল প্রমাণ করেছে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে বৈশ্বিক ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করলে পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। এ বছরের প্রতিপাদ্য “বিজ্ঞানসম্মত কর্ম, ওজোন রক্ষায় বর্ম” তাই আমাদের প্রত্যেককে অনুপ্রাণিত করে ব্যক্তিগত, জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণে। ওজোন রক্ষার এ লড়াই কেবল একটি স্তর বাঁচানোর সংগ্রাম নয় এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়