মাটি যখন কারো না, সেখানে ভবন কীভাবে কারো হবে? মেহেরপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে সামান্য দূরে পন্ডের ঘাট এলাকায় গড়ে উঠছে একটি নতুন ভবনের স্বপ্ন। সে স্বপ্নের গায়ে লেগে আছে নিয়ম ভাঙার কালি। পানি উন্নয়ন বোর্ড ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিশাল এক ভবন নির্মাণ প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান করেছে যে জমির মালিকানাই এখনো সরকারের হাতে নেই। একটি স্থাপনা দাঁড়ায় যে জমির উপর, তার মালিকানা না নিশ্চিত করেই যেখানে ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি, এ যেন বালির উপর প্রাসাদ গড়ার মতো।
গ্রীষ্মের ধুলাঝরা বিকেলে যখন মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে একটুকরো জমির ওপর দাঁড়ানো হয়, তখন বোঝা যায়- এটা কেবল একখণ্ড ভূমি নয়; এটা একজন মানুষের জীবনভিত্তি, উত্তরাধিকার, প্রজন্মের আশা। এই জমির মালিক মো. আশরাফুল হক বলছেন, ‘শহরের উপকন্ঠে বামনপাড়া মৌজায় ২৩২২ ও ২৩২৩ দাগের একবিঘা জমি অধিগ্রহণ করেন। আমার জমির বাজারমূল্য তিন কোটি টাকা। সরকার আমাকে দিচ্ছে মাত্র ১ কোটি ৬ লাখ। দলিল হয়নি, অধিগ্রহণও সম্পন্ন নয়- তবু দরপত্র আহ্বান! এটা তো আইনের অপমান।”
তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন এবং উচ্চ আদালত সেখানে স্থগিতাদেশ দেন। অথচ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের তাড়া যেন আদালতের আদেশকেও বিব্রত করে।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘মো. ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স’ ইতোমধ্যে পেয়েছে কাজের দায়িত্ব। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে চলতি মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত। ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে, হাতে আছে মাত্র চোদ্দ দিন।একটি সরকারি দপ্তরের ভিত গড়তে গিয়ে যখন ন্যায়বিচারকে পাশ কাটিয়ে এগোনো হয়, তখন শুধু একটা ভবন নয়- আস্থা, আইন এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিও ক্ষয়ে যেতে থাকে।
ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, “জমি ক্রেতারা সাধারণত বিক্রেতার সাথে যেদামে ক্রয় চুক্তি করেন তার থেকে কমদামে দলিল রেজিস্ট্রি করেন। ফলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে যেমন বঞ্চিত হয়। তেমনি সরকার জমি অধিগ্রহণকালে রাস্ট্রিয় প্রয়োজনে জমি কেনা বেচায় জমির দাম না মেলাতে মামলা মোকদ্দমা বাড়ছে। ফলত, সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনসাধারণও পড়ে হয়রানির মধ্যে।”
জেলা প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “জমির দাম নিয়ে আপত্তি থাকলে তা আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করা উচিত। কিন্তু দলিল সম্পন্ন না করে দরপত্র আহ্বান করা হলে সেটি প্রশাসনিক ও নৈতিক দুই দিক থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ।”
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হান্নান প্রধান বলেন,“জমি অধিগ্রহণ ও রেজিস্ট্রি শেষ না করে ভবনের দরপত্র ডাকা ঠিক হয়নি, স্বীকার করি। বিষয়টি প্রশাসনিক আলোচনায় রয়েছে।”
স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। কেউ বলছেন, “আইনি জটিলতা নিয়ে শুরু হওয়া ভবন কখনো টেকসই হয় না,” কেউ বা বলছেন, “ব্যক্তি মালিকানার জমি দখল করে উন্নয়ন নয়, এটা তো অন্যায্য দখলদারি।”
বিশিষ্ট এক সমাজকর্মী বলেন,“সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পকে আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু তা যেন হয় স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের ভিতরে। জমির ন্যায্য দাম না দিলে ভবিষ্যতে ক্ষোভ জন্ম নেবে, যা কোনো ভবনের ভিত্তির চেয়েও বিপজ্জনক।”
এই ঘটনা কেবল একটি জমি নিয়ে নয়, এটি একটি নৈতিক সংকট, একটি প্রশাসনিক গাফিলতির প্রতিচ্ছবি।যেখানে নিয়মের চেয়ে ‘তাড়াহুড়ো’র মূল্য বেশি, সেখানে ন্যায় ও উন্নয়ন সমান্তরালভাবে চলতে পারে না। প্রকল্প হয়তো শেষ হবে সময়মতো, ভবন উঠেও দাঁড়াবে, কিন্তু তার নিচে যে জমিটি এখনো ব্যক্তি মালিকানায়। ফলে সংকট হয়তো আরও গভীর ক্ষত রেখে যাবে সমাজে।