পিটার হাস আসলে মেনেনডেজের পরিকল্পনায় হাঁটছেন

পিটার হাস আসলে মেনেনডেজের পরিকল্পনায় হাঁটছেন

পিটার হাস সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। বলছি বটে বলার নেই, কিন্তু যতক্ষণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে আছেন, ততক্ষণ না বলেও উপায় নেই। বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জন্য পিটার হাস আলোচিত এক নাম। একটু পিছন ফিরে দেখলেই স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশে আসার পর থেকেই পিটার হাস একের পর এক বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অপতৎপরতা শুরু করেন। এই অপতৎপরতা বাংলাদেশের জন্য কখনও কখনও বেশ বিব্রতকর হয়েছে। দেশের গণমাধ্যমে এই বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

গতবছর ১৪ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর শাহীনবাগে প্রায় এক দশক ধরে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় গিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাসার বাইরে একদল লোক তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন। পরে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান।

শুধু বাংলাদেশ নয় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই বিষয়ে তার বক্তব্য স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে (১৪ ডিসেম্বর ২০২২) যাওয়াটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চেষ্টার শামিল। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে ক্রমেই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন।

আর কোনো দেশ এই বিষয়ে কথা না বললেও মারিয়া জাখারোভার কঠোর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, পিটার হাস প্রথমত বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে ক্রমেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। দ্বিতীয়ত, পিটার হাস কারো এজেন্ডা নিয়ে এই কাজ করছে। যে এজেন্ডার কারণে পিটার হাস একের পর এক বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করছে।

কেনো পিটার হাস এমন? এইবার আসি পিটার হাসের নিযুক্ত হওয়ার বিষয়ে। বাইডেন প্রশাসন ৪টি দেশে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য মার্কিন সিনেটে উত্থাপন করেন। বাংলাদেশ, ভারত, চিলি ও ফ্রান্স। পিটার ডি হাস, এরিক এম. গারসেতি, ডেনিস ক্যাম্পবেল, বেরনাডেটে এম. মিহান এই চার জনকে নির্বাচন করা হয়। ৯ জুলাই ২০২১, প্রেসিডেন্ট বাইডেন চার জনকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৩ জুলাই ২০২১, প্রস্তাবটি সিনেটে আসে এবং সিনেট এই প্রস্তাব পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে পাঠায়। ২০ অক্টোবর ২০২১, দীর্ঘ চার মাসে বারবার আলোচনার পরেও কমিটি শুনানিতে বিষয়টি সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ৩ নভেম্বর ২০২১, অবশেষে সিনেটর মেনেনডেজের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ক্যাম্পেইনের ফলে কমিটি এই ১৪ জনের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, কণ্ঠভোটে সিনেটে প্রস্তাবগুলো পাস হয়। এই যে সিনেটর মেনেনডেজের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ক্যাম্পেইনের ফলে কমিটি এই ১৪ জনের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এখানে যে প্রশ্নটি সবার আগে সামনে আসে তাহলো, কেন সিনেটর মেনেনডেজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই কাজ করলেন?

কেন এই কাজ করলেন সেই উত্তর দেওয়ার আগে সিনেটর মেনেনডেজ সম্পর্কে বলে নেওয়া ভালো, মেনেনডেজ হচ্ছে সেই লোক যিনি ৪ লাখ ৮০ হাজার ডলারসহ ধরে পড়েন। শুধু তাই নয়, স্বর্ণ কেলেঙ্কারিতে সিনেটর মেনেনডেজের নামও জড়িত। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, মিশরে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ে তথ্য পাচার করা এবং অর্থ লেনদেন। এই অর্থ লেনদেনে জড়িত ছিলেন মেনেনডেজের স্ত্রী নাদিন আর্সলানিয়ান।

মেনেনডেজ প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুরু করেন এরপর পিটার হাস একের পর এক নিষেধাজ্ঞা তালিকা বর্ধিত করতে থাকেন। এ যেন মেনেনডেজের দেখানো পথেই পিটার হাস হাঁটছেন।

যে দুটি বিষয় আলোচনায় আসেনি তা হলো, বাইডেন যে চার জনকে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করার বিষয় আগ্রহ দেখান সেই চার জনের মধ্যে পিটার হাসের ক্যারিয়ার বাকিদের চেয়ে দুর্বল। পিটার ডি হাস ছিলেন সিনিয়র ফরেন সার্ভিসের ক্যারিয়ার সদস্য এবং একই সাথে স্টেট ডিপার্টমেন্টের অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বিষয়ক প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে, হাস স্টেট ডিপার্টমেন্টের বাণিজ্য নীতি ও আলোচনার জন্য সিনিয়র উপদেষ্টা / উপ-সহকারী সচিব ছিলেন।

সিনিয়র উপদেষ্টা / উপ-সহকারী সচিব থেকে পিটার হাসের এত দ্রুত কীভাবে পদায়ন হয় তাও ভাববার বিষয়। কে এই পদায়নের পেছনে যুক্ত ছিল তাও অনুমান করা যায়। আরও জানার বিষয় হলো, ২১ মার্চ ২০২৩, রাজধানীর এক হোটেলে পিটার হাস ‘দুর্নীতি দূর করতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র’ এইরকম বক্তব্য দেন। প্রশ্ন হলো, পিটার হাস যার সুপারিশে বাংলাদেশে এসেছেন সেই মেনেনডেজের দুর্নীতির খবর সারা পৃথিবী জানে। তবে কি বিষয়টা এইরকম যে, পিটার হাস বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দিতে বা কোনো বিশেষ মহলের সুবিধার জন্য কাজ করছিলেন?

এই সন্দেহ সরিয়ে দেওয়ার উপক্রম নেই, পিটার হাস আসলে মেনেনডেজের পরিকল্পনায় হাঁটছেন এবং মেনেনডেজের মতো দুর্নীতি বিরোধী কাজের কথা বলে বিভিন্ন উপঢৌকন বা ব্যবস্থার বিষয় হাসিল করতে চাইছেন। এইসব বিষয় যতটা সরলভাবে আমরা ব্যাখ্যা করছি তারচেয়েও অধিক অজানা বিষয় এখনও লুকিয়ে আছে মেনেনডেজ আর পিটার হাসের মধ্যকার লুকায়িত প্রস্তাব বা উদ্দেশ্যের মধ্যে। তাও আমাদের জানা প্রয়োজন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।