বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় প্রোটিন অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। এ ক্ষেত্রে ডিমকে বলা হয় সবচেয়ে সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর উৎস।
মানবজাতির সুস্বাস্থ্য, শিশুর বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের বিকাশে ডিমের গুরুত্ব অপরিসীম। ডিমকে বিশ্বে একটি উন্নতমানের ও সহজলভ্য আমিষজাতীয় খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন (আইইসি) গঠিত হয়। বর্তমানে এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা ৮০। সংস্থাটি প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন এবং সর্বোপরি ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ আয়োজন করে, যা পরবর্তী সময়ে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। এ বছর বিশ্ব ডিম দিবসের প্রতিপাদ্য "শক্তিশালী ডিম- প্রাকৃতিক পুষ্টিতে ভরপুর”-প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং ওয়াপসা-বিবি যৌথভাবে বিশ্ব ডিম দিবস-২০২৫ পালন করছে। বিশ্ব ডিম দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো- বিশ্বজুড়ে মানুষকে ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন করা, সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের প্রোটিন ও অপরিহার্য পুষ্টি সরবরাহে ডিমের ভূমিকা তুলে ধরা এবং সব বয়স ও শ্রেণির মানুষের খাদ্য তালিকায় ডিমকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
ডিম সুস্বাদু আর সহজলভ্য এক খাবার, যাকে একটি পরিপূর্ণ খাবার হিসেবে গণ্য করা হয় । এতে রয়েছে আমাদের শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ১৩টি পুষ্টিগুণ। ডিম সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে অন্যতম। ডিমকে বলা হয় ‘গরিবের প্রোটিন’। আবার টেকসই প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে এর স্থান সবার উপরে।এজন্য একে “নিউট্রিয়েন্ট পিল” বলেও অভিহিত করা হয়। ডিমে থাকা উচ্চমানের প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ ও অ্যামিনো অ্যাসিড শরীরের সুষম বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। এটি শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে না, বরং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ও মনোযোগ বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। তাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ডিমকে যুক্ত করা মানে এক সহজলভ্য ও প্রাকৃতিক পুষ্টির উৎস নিশ্চিত করা। বর্তমানে বাংলাদেশে অপুষ্টির হার, মা ও নবজাতকের মৃত্যু হার কমেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে খর্বাকায় ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যাও কমেছে। এর বিপরীতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে আমাদের দেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার সংখ্যা ছিল বছরে গড়ে মাত্র ১০ থেকে ১৫ টি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে এ সংখ্যা ১৩৭টি। দেশে দৈনিক ডিম উৎপাদিত হচ্ছে বছরে প্রায় ৬ কোটি ৬৮ লাখ। ২০৩১ সাল নাগাদ ডিম খাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বছরে জনপ্রতি ১৬৫টি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের জিডিপিতে অবদান ১.৮১ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.১৯ শতাংশ। কৃষিজ জিডিপির মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৫৪ শতাংশ, যা সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব প্রতিফলিত করে। বর্তমানে দেশে প্রায় আড়াই কোটি গরু, ১৫ লক্ষ মহিষ, ৩ কোটি ছাগল-ভেড়া এবং ৪০ কোটি হাঁস-মুরগি রয়েছে। এ সকল গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদনের মাধ্যমে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ১৫৫ লক্ষ মেট্রিক টন দুধ, ৮৯.৫৪ লক্ষ মেট্রিক টন মাংস এবং ২ হাজার ৪ শত ৪০ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতের ধারাবাহিক উন্নতির ফলে গত এক দশকে ডিম উৎপাদনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ডিম উৎপাদন হয়েছে ২৪৪০ কোটি, যা এক দশক আগের তুলনায় প্রায় ২.১৬ গুণ বেশি। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে গত ৯ অর্থবছরের উৎপাদন প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১,৪৯৩.৩১ কোটি থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৪৪০ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। ডিম উৎপাদনের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি দেশের মানুষের পুষ্টি ও প্রোটিন চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে জনপ্রতি ডিম প্রাপ্যতা বছরে ১৩৭টি, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। ডায়েটিশিয়ানদের পরামর্শ অনুসারে, একজন পুরুষ সুস্থ জীবনযাপন এবং পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য প্রতিদিন ১টি ডিম খেতে পারেন। ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির এই সফলতা এসেছে সরকারি নীতিসহায়তা, আধুনিক খামারব্যবস্থা, বাচ্চা মুরগি ও খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। বর্তমানে ডিম শুধু একটি পুষ্টিকর খাবার নয়, বরং এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যমোচনে বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এই উৎপাদন প্রবৃদ্ধি শুধু দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করেনি, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও দারিদ্র্যমোচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে এ খাতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে - যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, দারিদ্রমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। মাত্র চার যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর এ খাতটি এখন অনেকটাই আত্মনির্ভরশীলতার দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সি বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। সাধারন গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে প্রাণিজ আমিষের যোগান দিচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশের প্রান্তিক খামারিরা এখনো মোট ডিম উৎপাদনের বড়ো অংশ যোগান দিয়ে থাকে। বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্প বিকাশে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে পোল্ট্রি ফিডের উচ্চ মূল্য। এ কারনে অনেক প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারী আশানুরুপ মুনাফা করতে না পারায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রলায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছে।
দেশে মাংস, দুধ ও ডিমের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং পোল্ট্রিশিল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের অংশগ্রহণে একাধিক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভার আলোচনার ভিত্তিতে একটি বহুমুখী সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সরকার। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং পোল্ট্রি শিল্পের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের পরামর্শে ২০২৪ সালের জন্য মুরগি ও ডিমের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে কৃষি মন্ত্রণালয় সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত মূল্য বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়। একদিন বয়সি বাচ্চা মুরগির উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রয়মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে একটি কৌশলপত্রের নির্দেশনা অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, পোল্ট্রি ফিডের মূল্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ যৌথভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রতি কেজি ফিডের দাম ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত হ্রাস করা হয়েছে, যা প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ কমাতে সহায়তা করছে।
প্রাণিজ প্রোটিনের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে সরকার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভিরুলেন্ট নিউক্যাসেল ডিজিজ ও ইনফেকশাস ব্রঙ্কাইটিসসহ নতুন রোগের ঝুঁকি কমাতে ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। খামারিদের উৎপাদন ব্যয় কমাতে বিদ্যুৎ বিলে কৃষির ন্যায় ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে সারা বছরব্যাপী সুলভ মূল্যে নিরাপদ ডিম সরবরাহের জন্য সংরক্ষণাগার স্থাপনের লক্ষ্যে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা যুগোপযোগী করার নির্দেশনাও দিয়েছে সরকার। এছাড়া, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সয়াবিন ও এর উপজাতের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করেছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেশের প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে স্থিতিশীলতা, ন্যায্যমূল্য এবং প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে-যা পুষ্টি নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য এক ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মেধাবী ও সবনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং ধনী-দরিদ্রের পুষ্টির বৈষম্য নিরসণকল্পে গরিবের প্রোটিনখ্যাত ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ খাতসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সার্বিক সহযোগিতায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।