প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনায় তিন পরিকল্পনা

বাংলাদেশের শহর এলাকায় গত ১৫ বছরে জনপ্রতি প্লাস্টিকের গড় ব্যবহার বেড়েছে ছয় কেজি। ২০০৫ সালে বার্ষিক জনপ্রতি ব্যবহার ছিল তিন কেজি, তা ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৯ কেজিতে। ২০২০ সালে মাঠ পর্যায়ে করা বিশ্বব্যাংকের বর্জ্য সংরক্ষণ পরামর্শ জরিপে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তারা বলছে, করোনার কারণে প্লাস্টিকের ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়েছে। বিশেষ করে পিপিই, মাস্ক ও করোনার অন্যান্য সরঞ্জামের ব্যবহারের কারণে। তবে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যে ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় পরিকল্পনা নিয়েছে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই কর্মপরিকল্পনার কথা জানান পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।

পরিবেশ রক্ষায় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনাগুলো হলো, ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা, ২০২৬ সালের মধ্যে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ বন্ধ করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ হ্রাস করা। অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশের টেকসই প্লাস্টিক ব্যববস্থাপনার লক্ষ্যে বহুখাত কর্মপরিকল্পনা’ শীর্ষক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পরিবেশ রক্ষায় বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি আজকে যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করলাম তার বাস্তবায়ন আপনাদের আমাদের সবার করতে হবে। তাহলেই এসডিজি লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেশের মাটিতে সচেতন নই, দেশে যেখানে সেখানে ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল ফেলি, কিন্তু বিদেশে গেলে আমরা সচেতন। এর জন্য আমাদেরকেই আগে সচেতন হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এর আগে উদ্বোধনী বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর দানদান চেন বলেন, ‘দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং দূষণ উভয়ই হঠাৎ বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারি প্লাস্টিক আবর্জনার অব্যবস্থাপনাকে আরো বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের এখনই সময় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সবুজ প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়া।’

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বহুখাত কর্মপরিকল্পনা শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা নিশাত। তিনি বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি, যেটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার সবচেয়ে ওপরে থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী।’ তিনি আরো বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে বেশি প্লাস্টিকের ব্যবহারের পরও তারা তাদের পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখেছে শুধুমাত্র ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য। আমাদেরকেও সেদিকে নজর দিতে হবে আর তার জন্য এই জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।’

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের মাঠ পর্যায়ে করা জরিপে আরো বলা হয়, রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারাই বছরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার করে ২৪ কেজি, যা জাতীয় গড় থেকে অনেক বেশি। কারণ হিসেবে তারা বলছে, করোনা সংকটের কারণে প্লাস্টিক দূষণ খারাপ অবস্থায় এসেছে। বিশেষ করে মাস্ক, গ্লাভস এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামাদিতে (পিপিই) প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি বড় অংশ জলাশয় ও নদীতে ফেলা হয়, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এ সময় সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ময়লা বিশেষ করে প্লাস্টিকের বর্জ্য সংগ্রহের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। তার মধ্যে একটি হলো নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া। এরই মধ্যে আমরা বেশ সাড়া পেয়েছি, পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা এরই মধ্যে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবে এই কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। আমাদের সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে।’

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র দে, ওয়েস্ট কনসার্নের নির্বাহী পরিচালক আবু হাসনাত মো. মাকসুদ সিনহা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাউসিয়া চৌধুরী। এ ছাড়া ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন।