বল কুড়ানো ছেলেটি আজ রেফারি!

মেহেরপুরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন খেলোয়াড় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এর রেফারি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হলেন মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান গ্রামের শুকুর আলীর ছেলে সোহেল রানা(২০)।

৩ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট সোহেল। বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি শেষ করে, বাগোয়ান আন-নুর টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এইসএসসি’র শিক্ষার্থী সে।

একজন গ্রামের মানুষ হয়ে, গ্রামেই বসবাস করে কিভাবে তিনি রেফারি হতে পেরেছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেরপুর প্রতিদিনের এক সাক্ষাৎকারে সোহেল রানা জানান, ছোট থেকে স্বপ্ন ছিলো ভালো একজন ফুটবলার হওয়ার, তাই খেলার এই নেশাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের বড় ভাইদের সাথে গিয়ে খেলা করতাম।

আমি ছোট থাকায় বড় ভায়েরা সে রকম গুরুত্ব দিত না। বল মাঠের বাইরে চলে গেলে বলটি কুড়িয়ে নিয়ে আসতে বলতো, আমি তাদের কথামত সেটাই করতাম। আস্তে আস্তে তারা আমাকে তাদের ক্লাবের সদস্য হিসাবে নিয়ে নিলো।

তারপর থেকে তাদের সাথে আমিও খেলা করতাম। এভাবে খেলতে খেলতে একসময় স্কুলের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় খেলতাম। ভেবেছিলাত হয়তো একদিন আমি বড় ধরনের খেলোয়াড় হব। সেই ভেবে একদিন হঠাৎ করে ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকার ক্লাবে টাইল দিতে।

২০১৭ সালের দিকে ফকিরাপুল সূর্য যুব সংঘ ক্লাবে প্রথম টাইল দিয়েছিলাম কমলাপুর স্টেডিয়ামে। টাইলে সুযোগও পেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস যেদিন থেকে ৩য় বিভাগের খেলা শুরু, সেই দিন থেকেই আমার (এস এস সি) পরিক্ষা। বাড়িতে ফিরে আসতে হলো। অনেকের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ রাখতাম।

হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম প্রতিবছর বাফুফে থেকে রেফারির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তখন আমি ভেবে দেখলাম, আমার জেলায় তো তেমন কোন বাফুফে সনদ পাওয়া রেফারি নাই, আর আমার নিজ উপজেলা মুজিবনগরে একটাও রেফারি নাই, তখনিই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আমি রেফারির প্রশিক্ষণ নিবো।

তরপর থেকেই খেলোয়াড় হওয়ার সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়ে যোগাযোগ করলাম বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে। সেখান থেকে জানতে পারি, ০৯/০২/২০২০ এ নিউ রেফারি কোর্স হবে ৬ দিনের। আমি অনলাইনে আবেদন করলাম। আমাকে বাছাই করেছিল অনলাইনের আবেদনে। এরপর ০৭/০২/২০২০ তারিখে আমি ঢাকায় যায়, এবং ৬ দিনের প্রশিক্ষণ নিই। এর মধ্যে বেশকিছু পরীক্ষাও দিতে হয় সেখানে। যেমনঃ ফিটনেস টেস্ট দিতে হয় ৪০০মিঃ ১০ পাক/ লেপ, লিখিত পরীক্ষা ১০০ নম্বরের। এভাবেই উত্তীর্ণ হই ৩য় শ্রেনির রেফারিতে।

রেফারিতে সুযোগ পাওয়ার পিছনে আমার মায়ের অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশি। আমার মা আমাকে সাহস যুগিয়েছে। সকল জায়গায় আমাকে সাথে করে নিয়ে গেছে। সব সময় ছাঁয়ার মত পাশে থেকেছে আমার মা। এছাড়া আমঝুপি গ্রামের গালর্স স্কুলের শিক্ষক লিটন ভাই ও আনন্দবাস গ্রামের মজিবার রহমান ঠান্ডু ভাই আমাকে অনেক সহযোগীতা করেছেন। তাদের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

রেফারিতে সুযোগ পাওয়ার পর তার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, আমি দেখেছি অনেকেই খেলা করে। কিন্তু কেউই ঠিক নিয়ম জানেনা। সকলেই মনগড়া নিয়ম তৈরি করে খেলা পরিচালনা করেন। ফিফার যে ঠিক নিয়ম আছে সেই ঠিক নিয়মটা আমি সকলের মাঝে তুলে ধরতে চাই। এবং নিজ জেলায় ফুটবলের উন্নতি করা ও ফুটবলের ঠিক নিয়ম এর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় তৈরি করা।

বাগোয়ান গ্রামের হাসিবুল ইসলাম জানান, সোহেল আমাদের অনেক ছোট। আমরা যখন খেলা করতাম তখন সে আমাদের বল কুড়িয়ে এনে দিত। সে খেলার জন্য সব সময় আমাদের বলতো কিন্তু আমরা সে রকম তাকে গুরত্ব দিতাম না। মাঝে মাঝে খেলার জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করলে আমরা এক সময় তাকে খেলায় অংশগ্রহন করতে দিই।

তারপর থেকে সে আমাদের সাথে খেলা করতো। কিন্তু সে যে একদিন এমন একটা জায়গায় পৌঁছাবে আমরা কখনও কল্পনাও করতে পারি নি। বর্তমানে সে একজন বাফুফে’র সদস্য হওয়ায় আমরা বাগোয়ানবাসী তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। আমরা দোয়া করবো সে শুধু বাফুফের সদস্যই না। সে যেন ফিফার শেষ পর্যায় প্রর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

সোহেলের মা নূরজাহান খানম আনজিরা বলেন, আমার ছেলে যখন ছোট থেকে খেলাধুলা করতো আমি সব সময় তাকে সাহস দিয়ে এসেছি। যে কোন জায়গায় তার কাজ থাকলে আমি নিজে সাথে করে নিয়ে গিয়েছি। তার খেলার প্রয়োজনীও জিনিস আমার কাছে থেকে যা চেয়েছে আমি কোন কিছু তার অপূরণ রাখিনি। সব সময় তাকে সহযোগীতা করে এসেছি। আমার ইচ্ছে ছিলো সে একদিন বড় কিছু হয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। আর আল্লাহর কাছে অশেষ মেহেরবানী তিনি আমার সেই চাওয়াটা পূরণ করেছেন।

ইউপি সদস্য কাজী কোমর উদ্দীন সেলিম জানান, সোহেল বাফুফের রেফারি হয়ে বাগোয়ান গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। সে যেন আগামীতে আরো বড় রেফারি হতে পারে এবং ঠিক নিয়মে খেলা পরিচালনা করে সেই প্রত্যাশা করি।

বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন জানান, সোহেল রানা বাফুফের রেফারি হিসাবে সুযোগ পেয়েছে এটা শুনে আমি খুবিই আনন্দিত হয়েছিলাম। সনদ হাতে পাওয়ার পর পরই সে আমার পরিষদে এসেছে। আমি তাকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আমি চাইবো সে শুধু বাগোয়ান গ্রামের না পুরো মুজিবনগরের মুখ উজ্জ্বল করবে।

মেহেরপুর জেলাতে এই প্রথম মুজিবনগর থেকে একজন বাফুফে রেফারিতে সুযোগ পাওয়ায় মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন সরকারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৯১ তম ব্যক্তির মধ্যে সে অন্যতম ব্যক্তি। সে যে তাদের সকলের ভিতর থেকে টিকে থাকতে পেরেছে এটা মুজিবনগর বাসীর জন্য একটি সুখবর।

আমাদের এখানকার যে ক্রিয়া সংস্কৃতি সেটা এগিয়ে নিয়ে আসার এটা আরেকটি অন্যতম দিক। আমাদের নিকটবর্তী যে সকল ফুটবলের আয়োজন করে থাকি সেই আয়োজন গুলোতে এরকম ব্যক্তিত্বদের যদি আমরা সংযুক্ত করতে পারি তাহলে মুজিবনগরের ফুটবল সংস্কৃতিটা আরো একটু এগিয়ে যাবে।