
ভয়ঙ্কর এক প্রতারক দম্পত্তির ফাঁদে পড়ে নি:স্ব প্রায় দেড় শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যেক্তা । পুলিশ লাইনের রেশনের ব্যবসা ও ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে লাভ দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে প্রায় এক বছর ধরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক দম্পত্তি রুবেল শেখ ও তানিশা ইয়াসমিন ইমা। রুবেল শেখ পুলিশের এএসআই পদমযর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর মামলায় তিনি বহিস্কৃত হয়েছেন। মেহেরপুর শহরের পুরাতন পোস্ট অফিস পাড়ায় তাদের বসবাস।
তাদের এ কর্মকাণ্ডে সহযোগীতা করেছেন সুমন হোসেন নামের পুলিশের এসআই পদমযর্যাদার এক কর্মকর্তা, স্থানীয় যুবলীগ নেত্রী হাসিনা খাতুন ও ইমার মা মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের স্টাফ আয়েশা খাতুন। ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়েও কোন সুফল পাচ্ছেন না। প্রতারক এ চক্রটি ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধামকি দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেহেরপুর শহরের পুরাতন পোস্ট অফিস পাড়ায় পুলিশ লাইনের রেশন সামগ্রীর নামে সয়াবিন তেল, চাল, চিনি ও ডাল সরবরাহের ব্যবসা দেখিয়ে সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাসপেন্ড হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই রুবেল ও তার স্ত্রী তানিশা ইয়াসমিন ইমার বিরুদ্ধে। প্রথমে স্বল্প মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে আস্থা অর্জন করলেও পরবর্তীতে হঠাৎ সব ধরনের পণ্য দেওয়া বন্ধ করে দেন তারা। তবে শুধু পন্য সরবরাহ না, পাশাপাশি সুদের মাধ্যমে লাভ দেওয়ার নাম করেও অনেকের কাছে থেকে টাকা নিয়েছেন বলে নাম প্রকাশ না করার সূত্রে কয়েকজন জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, অন্তত দেড়শো মানুষ তাদের কাছে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা পাওনা। ক্তভোগীদের অভিযোগ প্রায় ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্রটি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল সোমবার বিকালে পুরাতন পোস্ট অফিস পাড়ায় গিয়ে জানা গেছে প্রতারক দম্পত্তির ভয়ঙ্কর প্রতারণা গল্প।
পাবনা থেকে এসে মেহেরপুরে দর্জির কাজ করা শিউলী খাতুন জানান, অগ্রিম দেওয়া ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা এখনো পাননি। তিনি অভিযোগ করেন, ইমা শেলী ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তার গলার চেইন ও কানের দুল নেন, যা ফেরত দেয়নি। ২ লাখ ২০ হাজার টাকার একটি চেক দিলেও সেখানে চালাকির আশ্রয় নিয়ে নিজের নামে চেক লিখে দিয়েছেন তানিশা ইয়াসমিন। এছাড়া সাদা কাগচে ১২লাখ ৩২ হাজার টাকার হিসাব করে সেখানে সাক্ষর করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে টাকা চাইতে গেলে ইমা, তার মা ও সহযোগী হাসিনা মিলে তাকে মারধর করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
শেলীর স্বামী মো. শফিউল আলম জানান, তার স্ত্রী তেল কিনলে তিনি দোকানে বিক্রি করতেন। পরে অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর পণ্য দেওয়া বন্ধ করেন ইমারা। এ বিষয়ে সেনাবাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা টাকা ফেরতের আশ্বাস দিলেও পরে আর দেননি। থানায় অভিযোগ করেও সমাধান মেলেনি বলে দাবি তার।
স্টেডিয়াম পাড়ার নারী উদ্যোক্তা রেহানা খাতুন বলেন, ‘আমি একজন উদ্যোক্তা। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ১৭ টি আইটেমের ব্যবসা করে আসছি। পেয়াদা পাড়ার হাসিনার কথাতে আমি আমার ব্যবসাতে সয়াবিন তেল সংযুক্ত করি। হাসিনার মাধ্যমে ইমা, এএসআই রুবেল এবং আয়েশা খাতুন আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং বলে আমাদের ট্রেড লাইসেন্স আছে, এই লাইসেন্স দিয়ে আমরা পুলিশ লাইনে রেশনের মালামালের ব্যবসা করি। তাদের এই কথাতে আমি তাদের সাথে তেলের ব্যবসায় রাজি হই। এরপর তাদের আমি অর্ডার বাবদ অগ্রিম টাকা দিই। এরপর তারা আমাকে ৬ বার তেল সরবরাহ করে। তাদেরকে সবসময়ই অর্ডারের টাকা অগ্রিম পরিষদ করতে হতো। এক পর্যায়ে আমি তাদেরকে চারটা অর্ডার দিই। ১ লাখ ৫৬ হাজার করে তিনটা অর্ডার এবং ৮৪ হাজারের একটা অর্ডার। এই অর্ডার দেয়ার পর থেকে সাত মাস যাবত আমাকে ঘুরাচ্ছে। আমাকে তেলও দেয় না আবার টাকাও ফেরত দেয় না। আমি বাজার কমিটিতে একটি অভিযোগ করেছি বাজার কমিটি আমাকে একটি প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছে। আমি মেহেরপুর সদর থানাতেও একটা অভিযোগ করেছিলাম সেখানে সালিশে তারা টাকা পয়সার ব্যাপারটা স্বীকার করলেও দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেসময় এসআই অমিত কুমর আমাকে স্বৈরাচারের দোসর আখ্যায়িত করে বলেন ১৭ বছর তো অনেক কামিয়েছেন, আপনার এই টাকা না নিলেই বা কি হবে। এরপর আমি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিলুর রহমান খানের কাছে যাই। তিনি আমাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি মামলা করার প্রক্রিয়ার দিকে আগাচ্ছি।
এলাকার নারী উদ্যোক্তা আসমানি খাতুন জানান, রেশনের তেল সরবরাহের নামে দেড় লাখ টাকা নিলেও এক বছরেও কোনো মালামাল পাননি। নাম প্রকাশ না করা অনেকে দাবি করেন, কেউ দুই লাখ, কেউ পাঁচ লাখ, কেউবা বিশ লাখ পর্যন্ত দিয়েছেন। প্রথমে সরবরাহ দিলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পুরোপুরি বন্ধ।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শিমুল খান জানান, পুলিশের রেশন সামগ্রী সরবরাহের কথা বলে অগ্রিম দুই লাখ টাকা নেওয়া হয় আট মাস আগে, যা আর ফেরত পাওয়া যায়নি।
নারী উদ্যোক্তা রেহানা খাতুন জানান, ফেসবুক পেজে ব্যবসার জন্য চার দফায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার অর্ডার দিয়েছিলেন। ছয়বার পণ্য সরবরাহের পর আচমকা তা বন্ধ হয়ে যায়। থানায় গেলে এসআই অমিত উল্টো তিরস্কার করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে সালিশ ও আলোচনার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পরও ভুক্তভোগীরা টাকা ফেরত পাননি। অভিযোগ রয়েছে, গণমাধ্যমে কথা বলায় সোমবার রাত ৯টার দিকে ইমা শেলী প্রতিবেশীর বাড়ির গেটে গিয়ে প্রকাশ্যে গালাগাল ও হুমকি দেন।
রিকশাচালক রুবেল, যিনি দীর্ঘদিন তাদের হয়ে পণ্য সরবরাহ করতেন, বলেন এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যবসা বন্ধ। ইমা ও রুবেলের নির্দেশেই সব করা হতো বলে জানান তিনি।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে এসআই সুমন জানান, রুবেলের সঙ্গে চাকরি সূত্রে পরিচয় থাকলেও ব্যবসার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ এস আই সুমনকে ডিও স্যার সাজিয়ে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এস আই সুমনও ভুক্তভোগীদের বাড়িতে গিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। ভুক্তভোগীদের সাথে এসআই সুমনের এসকল কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
তবে মূল অভিযুক্ত তানিশা ইয়াসমিন ইমাকে ফোন পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়ে চাকরিচ্যুত এএস আই রুবেল শেখ প্রথমে প্রতারণার অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে বিভিন্নজনের কাছে ঋণ থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি টাকার সমস্যা থাকায় বিভিন্ন জনের কাছে থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়েছি। সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়েছেন তো, তেল চিনি কিভাবে দিলেন এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান। শেষে তিনি প্রতিবেদককে তার সাথে দেখা করে চা খাওয়া ও গল্প করার প্রস্তাবও দেন।
তবে, হাসিনা খাতুন টাকা নেওয়া ও তাদের সাথে জড়িত থাকার কথা এ প্রতিবেদকের কাছে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে প্রতিবেদকের কাছে ফোন দিয়ে পুরো পরিচয় জানতে চেয়ে হুমকি দেন।
ভুক্তভোগীরা হাসিনা খাতুনের বিষয়ে অভিযোগ করে বলেন, তার ইসলামি ব্যাংকের একাউন্টে লেনদেনের মাধ্যমে এ ব্যবসা পরিচালনা করতো ইমা ও রুবেল। হাসিনা সাবেক মেয়রের বাসায় কাজ করতো। তার একাউন্টের হিসাব দেখলে বুঝা যাবে টাকার উৎস কি।
মেহেরপুর সদর থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে। প্রায় কোটির টাকা কিছু অভিযোগের কথা শুনেছি। লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখনো কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেনি বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একই কৌশলে শহর ও আশপাশের বহু মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পুলিশ লাইনের নাম ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করে ভুক্তভোগীদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এখনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দ্রুত তদন্ত করে এ চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ—পুলিশ সদস্যের নাম জড়ানো থাকায় কেউই প্রথমে সন্দেহ করেননি। এখন পুরো এলাকা অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানান তারা।


