বাংলাদেশে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেমোর প্রভাব নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব

বাংলাদেশে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেমোর প্রভাব নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব

বাংলাদেশের চলমান রাজনতিতে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষিত মেমোরেন্ডাম এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পার্কে আলোচনা, সতর্ক পর্যালোচনা দরকার কেন? প্রশ্নটি বিভিন্ন বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের বণিজ্যিক স্বার্থ অন্যদিকে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন বাংলাদেশের মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। গত নভেম্বরের ১৬ তারিখে হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিং রুম থেকে প্রেসিডেন্টের অ্যকশন-এর নিমিত্তে বিভিন্ন “বিভাগসমূহের” এবং “এজেন্সিসমূহের” প্রধানদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই “মেমোরেন্ডাম” (মেমো) জারি করেছেন। মোট ৫ টি সেকশন বিশিষ্ট মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই মেমোর সেকশন-১ নীতি (পলিসি); সেকশন-২ দৃষ্টিভঙ্গি (অ্যাপ্রোচ); সেকশন-৩ বাস্তবায়ন (এক্সিকিউশন); সেকশন-৪ সংজ্ঞাসমূহ(ডেফিনিশনস); এবং সেকশন-৫ সাধারণ বিধানসমূহ (জেনারেল প্রভিশন্স)। সবশেষ সেকশন-৫ এর (ডি) তে “ফেডারেল রেজিষ্টারে” প্রকাশ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তার সেক্রেটারি অব স্টেটকে “কর্তৃত্ব” ও “নির্দেশ” প্রদান করেছেন।

ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সরকারকে এই মেমোরেন্ডাম সম্পর্কে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে। গত ২০শে নভেম্বর দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত চিঠির সাথে এই মেমোরেন্ডামটিও অ্যটাচ করে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইস্যু করা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ঘোষণা দেয়া ‘মেমোরেন্ডাম অন এডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ শীর্ষক মেমোরেন্ডাম এর শুরুতে বলা হয়েছে, “সংবিধান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন দ্বারা রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমার উপর অর্পিত কর্তৃত্ব দ্বারা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উন্নত করার জন্য নীতি এবং আমাদের জাতির দৃষ্টিভঙ্গি” অভ্যন্তরীণভাবে এবং বিশ্বজুড়ে “কর্মীদের অধিকার রক্ষা এবং প্রচারের জন্য”, এই মেমোরেন্ডামের আদেশ জারি করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানির বিষয়টি একান্তভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমান বিশ্বে ক্রিয়াশীল জাতি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ-ই একমাত্র ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। কোন একটি ধর্মের জন্য নয় বরঞ্চ সবধর্ম ও বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তাই ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান উপায় । অন্যদিকে, কোন কোন বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে এবং বিশ্লেষণে ভিন্ন চিত্র উপস্থাপিত হলেও এটি প্রায় সকলেই স্বীকার করবেন যে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে ও বহুত্ববাদ তথা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষণাবেক্ষণের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে শীর্ষ স্থানে। আমেরিকার বেশ কিছু অঙ্গরাজ্য এবং শহর সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময়। জাতিসংঘের সদরদপ্তর নিউইয়র্ক। নিউইয়র্ক সিটি সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় শহরের একটি চমৎকার উদাহরণ।

বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, জাতি এবং জাতিগত পটভূমি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি চমৎকার উদাহরণ। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য চিরতরে অবসান ঘটিয়ে এদেশে “মনোলিথিক” কালচার প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রতিভূ বিএনপি-জামায়াত জোট। ধর্মীয় বৈচিত্র্য অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে এইজোটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রচেষ্টার কারণে পরিকল্পিতভাবে এরই মধ্যেই দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে।

“গণতন্ত্র” প্রকৃতপক্ষে ধর্ম, ভাষা, জাতি এবং জাতিগত পটভূমি সম্বলিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পটভূমিতেই কেবল “প্রাতিষ্ঠানিক” রূপ লাভ করতে পারে। বিএনপি-জামায়াত জোট মুখে বলে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কথা, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে এবং বাস্তবায়ন করতে চায় “মনোলিথিক” সাংস্কৃতিক কর্মপরিকল্পনা। এই শক্তি নির্বাচন বাঞ্চালের জন্য বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে মূলত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠাকামী রাজনৈতিক শক্তি এবং মনোলিথিক সমাজ প্রতিষ্ঠাকামী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২০ জনকে মনোনয়ন দেয়া সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠাকামী একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দলটির পরিচয় বহন করে।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের “মেমোরেন্ডাম” আসলেই যে কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাহলো বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসত্ত্বেও বহি:শক্তির উস্কানিতে এই শিল্প সেক্টরে শ্রমিক বিক্ষোভ হচ্ছে! ষড়যন্ত্রকারীরা বিষয়টি যেভাবে ঘোলা জলে মাছ শিকারে প্রবৃত্ত রয়েছে তা সফলতার সাথে মোকাবেলার জন্য মেমোরেন্ডামটি সতর্কভাবে পরর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। অপর দিকে, বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সবচেয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ এবং বক্তব্য দিচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি সস্ত্রীক নিজদেশে গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন। হঠাৎ করে পিটার হাসের দেশে যাওয়া নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এহেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ঘোষিত “মেমোরেন্ডাম” এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

অপর দিকে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক অর্থাৎ নির্বাচনের পক্ষে এবং বিপক্ষে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল বেশ সরব হয়ে উঠেছে। এর দ্বারা অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি এটাও নিশ্চয় প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বেশ ভাইব্রান্ট অবস্থায় আছে। যদিও গণতন্ত্র বিরোধী এবং পাকিস্তানী মানসিকতার বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি গণতান্ত্রিক কনসোলিডেশনের এই নির্বাচনকে প্রতিহত এবং বাঞ্চাল করার জন্য চেষ্টার কোনো ঘাটতি রাখছে না।

এই ‘মেমোরেন্ডাম’ মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সব দেশের ওপরই প্রযোজ্য, তবু এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এর অন্যতম টার্গেট হতে পারে বাংলাদেশ। রিপোর্টটি প্রকাশের সময় নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের শ্রম ইস্যুকে উদ্ধৃত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী। এই ‘মেমোরেন্ডাম’ অনুযায়ী, শ্রমবিষয়ক ইস্যুগুলোতে সরাসরি প্রভাব (ইন্টার‌্যাক্ট/ডিল) বিস্তার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক মিশনগুলো। এই নীতির কারণে অনেক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপে আগ্রহী মার্কিন কূটনীতিক বা মিশনগুলো উৎসাহিত হতে পারে। দৃশ্যত যদি তারা মনে করে বা বিশ্বাস করে যে, শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তাহলে এই সুযোগকে যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরোপ করা হতে পারে। এই ‘মেমোরেন্ডামের’ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বহু কারণে উদ্বেগজনক হতে পারে।

‘মেমোরেন্ডামে’ শ্রম অধিকার বিষয়ে যা বলা হয়েছে তার নেপথ্যে আছে রাজনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন উপায়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে তাই এই ‘মেমোরেন্ডাম’ বাংলাদেশের জন্য একটি সিগন্যাল। কারণ, ‘মেমোরেন্ডামে’ বর্ণিত শ্রম ইস্যুর অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। এই মেমোরেন্ডাম বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অঙ্গন যখন সরগরম। তাই সংশ্লিষ্ট অংশীদারদেরকে আগে থেকেই বিষয়টি আমলে নেয়া উচিত। সব ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার স্বার্থে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর “মেমোরেন্ডাম” এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে জনগণ এই আশা করে।

লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা।