নিল রঙের নেট দিয়ে একটি জমিকে ঘিরে তার মধ্যে ছোট ছোট বীজতলা, বীজতলার পাশে বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ফুলের গাছ ।
সামনের দিকে প্রবেশের জন্য সুন্দর একটি ফটক। দুর থেকে একটি সুন্দর আয়োজন মনে হলেও ভয়ঙ্কর অসুন্দর আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে বিষ চাষ অর্থাৎ তামাকের চারা উৎপাদনের জন্য। পুরো জেলা জুড়ে এ চিত্র প্রায় শতাধিক।
মেহেরপুর শহর ছেড়ে কাথুলী সড়কের বিভিন্ন স্থানসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এমন ভয়ঙ্কর প্রস্তুতি মহাসমারোহে চলছে তামাকের চারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। এ সড়কের মোনাহারপুর কবরস্থান থেকে কুলবাড়িয়া ইটভাটা মাত্র আধা কিলোমিটারের মধ্যেই এ ধরণের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে ৬টি। এর মধ্যে বৃটিশ আমেরিকান টোব্যকোর (বিএটি) ৩টি, আবুল খায়ের গ্রুপের ২টি এবং জাপান টোব্যকো ইন্ডাস্ট্রিজের ১টি। তামাক কোম্পানীগুলোর লোভনীয় ফাঁদে পড়ে সাধারণ কৃষকরাই ঝুঁকছেন এ বিষ চাষে। এক মাস ১০ দিনের এ বীজতলা থেকে চারা উৎপাদনের পর সেগুলো হাজার হাজার বিঘা জমিতে চাষ করা হবে। চোখের সামনে ভয়ঙ্কর এ আয়োজন যেন চলছে বছরের পর বছর।
মেহেরপুর জেলায় গত বছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তামাক চাষ হয়েছে ৯৭৫ হেক্টর অর্থাৎ ৭ হাজার ৩১২ বিঘা জমিতে। তামাকের আবাদ এবছর আরও সম্প্রসারণ করতে ইতিমধ্যে তামাকের চারা উৎপাদনের জন্য এ বীজতলাগুলো তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
তামাকের এ আগ্রাসনের ফলে সবজি উৎপাদনের জেলায় প্রতিনিয়ত সবজি উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। তামাক চাষের ফলে আবাদি জমির উর্বরতা শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। তামাক উৎপাদনের সাথে জড়িত নারী-শিশুসহ বয়স্ক মানুষজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ জেলার ঘরে ঘরে ফুসফুস, শ্বাসকষ্টসহ ক্যান্সারের মত মরণব্যাধি দেখা দেবে। এত কিছু জানার পরও তামাক কোম্পানীর গুলোর লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে সাধারণ কৃষকরা তামাক আবাদে ঝুঁকে সবজি উৎপাদনের জমিগুলোর উর্বরতা নষ্ট করছেন।
জেলায় কয়েকটি তামাক ক্রয়ের কোম্পানি আছে। এগুলোর মধ্যে বৃটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো কৃষকদের বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এই কোম্পানিগুলোর এলাকাভিত্তিক নিজস্ব তামাক চাষীদের তালিকা আছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি কোম্পানির আলাদাভাবে তালিকা থাকে। সেই তালিকা ধরে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে বীজ, ঋণ হিসেবে বাজারদরে সার, কীটনাশক (যা তামাক ক্রয়ের পরে মূল্যের সঙ্গে পরবর্তীতে সমন্বয় করা হয়) এবং নগদ টাকাও ঋণ দেয়। এগুলো দিয়েই শেষ না বীজতলা থেকে যাতে কাঙ্খিত চারা উৎপাদন হয় এবং চাষ করা হয় সে পর্যন্ত তদারকি করে থাকের কোম্পানীর প্রতিনিধিরা।
গতকাল রবিবার সকালে মেহেরপুর-কাথুলী সড়কের মোনাহারপুর মাঠে বিএটির তত্ত্বাবধানে একটি বীজতলার তৈরির কাজ করছিলেন কয়েকজন কৃষক। তাাঁদের সাথে কথা বলা জানা গেছে, ৮ থেকে ১০ জন কৃষক মিলে এক বিঘার একটি বীজতলা তৈরি করেছেন। যা থেকে যে চারা উৎপাদন হবে তা প্রায় দেড়শ বিঘা জমির তামাক আবাদ করা যাবে।
বীজতলার মালিক মো: হিরো বলেন, তাঁদের এ বীজতলাটি তৈরি করতে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে তারপর অন্য কৃষকদের কাছে চারা বিক্রি করবেন। বীজতলা তৈরির জন্য বিএটি থেকে নেট, বীজ ও কীটনাশক দিয়েছেন ঋণ হিসেবে পরে তামাক বিক্রয়ের সময়ে সেখান থেকে টাকা কেটে নেই।
হিরো আরও বলেন, তামাক চাষ করে খুব বেশি লাভ হয় না। তবু তামাক কোম্পানীগুলোর পিড়াপিড়াতে করতে হয়।
কথা হয় তামাক চাষী উজুলপুর গ্রামের আবু হানিফের সাথে। তিনি বলেন, আমার সাড়ে তিন একর জমির চাষ করার কার্ড রয়েছে। গত বছর ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। ভালো লাভ হয়নি। চাষিদের লজ্জা নেই, তাই লস হলেও করি। এবার কতবিঘা চাষ করবো এখনো বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, কোম্পানীর কার্ড থাকায় তামাক বিক্রি করে টাকা পেতে সমস্যা হয়না বলে আবু হানিফ জানান।
একই গ্রামের মঈনদ্দিন নামের আরেক কৃষক বলেন, তামাক চাষ করলে ক্ষতি হয়। তামাক জ্বালানোর সময় শরীর জ্বরে, চুলকায় এবং শ্বাষকষ্ট হয়। গত বছর দুই বিঘা তামাকের চাষ করলেও এ বছর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এচাষে শরীরের ক্ষতি ছাড়াও জমিরও অনেক ক্ষতি হয়।
মিনারুল ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, এক বিঘা তামাক চাষ করতে ৭/৮ বস্তা সার লাগে। বেশি লাগে ড্যাপ (ডিএপি) সার। তামাক কোম্পানী থেকে শুধু এসওপি সার দেয় বাকি সার বাজার থেকেই কিনতে হয়।
বীজতলা পরিচর্যার দেখভাল করছিলেন বৃটিশ আমেরিকান টোব্যকো বিএটির লিফ ম্যানেজার তানভির হোসেন, মেহেরপুরে মোট কতটি বীজতলা করা হয়েছে এবং কি পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা আছে তা তিনি জানাতে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, জার্মিনেশনের উপর ভিত্তি করে তামাক চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বীজগুলো যাতে ভালোভাবে জার্মিনেশন হয়
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, মেহেরপুর জেলায় ৯৭৫ হেক্টর জমিতে গত বছর তামাকের চাষ হয়েছে। জেলায় মোট আবাদি জমি রয়েছে ৫৮ হাজার ৫০৭ হেক্টর।
কৃষি অফিসের তথ্য মতে প্রতি বিঘা জমিতে জমিতে তামাক চাষ করতে ৪০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি ডিএপি, ৫০ কেজি এসওপি, ১ কেজি দস্তা ও আধা কেজি বোরণ প্রয়োজন হয়।
কিন্তু কৃষকদের তথ্যমতে প্রতিবিঘা জমিতে ৭/৮ বস্তা সার লাগে। বেশি লাগে ডিএপি সার। তামাক চাষ করার জন্য তামাক কোম্পানীগুলো শুধুমাত্র এসওপি সার সরবরাহ করে। বাকি সারগুলো সাধারণ খুচরা সার ডিলার ও সার ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে সংগ্রহ করেন চাষীরা। কৃষি বিভাগ থেকে তামাকের জন্য কোন সার বরাদ্দ না থাকলেও কৃষকরা বিভিন্ন ফসলের নাম করে তামাকের সার সংগ্রহ করেন। যার ফলে প্রতিবছর তামাক মৌসুম শুরু হওয়ার আগে সারের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক জেসমিন ফেরদৌস বলেন, তামাকচাষে নিরুৎসাহীত করতে কৃষকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ, উঠান বৈঠক ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। তামাকে বিপরীতে পেঁপের চাষ করতে উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছে। আশা করছি গতবছরের তুলনায় এবছর কিছু হলেও তামাকের চাষ কমবে।
সার সঙ্কটের বিষয়ে তিনি বলেন, চাষীরা প্রয়োজনের তুলনায় জমিতে অধিক সার ব্যবহার করেন। তাঁরা মনে করেন বেশি সার ব্যবহার করলে ফলন ভালো হয়। তবে আমরা এবছর অতিরিক্ত সারের চাহিদা পাঠিয়েছি।