বেতাই না মুজিবনগর; কোনটা সঠিক?

বেতাই না মুজিবনগর; কোনটা সঠিক?

একটি ছবি। কিন্তু দুটি স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে ভিন্ন্ন স্থানের ক্যাপশন। দুটি ক্যাপশনই মুক্তিযুদ্ধের গৌরাবান্বিত ইতিহাস বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, একই ছবি কিভাবে দুটি ইতিহাস তৈরি করে? আমাদের মত পাঠকদের মনেও হয়তো প্রশ্ন তৈরি হবে কোনটি সঠিক ? বেতাই না কী মুজিবনগর।

মেহেরপুর ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের (সাবেক মেহেরপুর পৌর ডিগ্রি কলেজ) ‘ইতিহাসের পাতা থেকে মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন’ স্মারক সংখ্যা ও কলেজে অধ্যক্ষর কক্ষের ডিসপ্লে বোর্ডে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে স্মারক সংখ্যার সম্পাদক মাসুদ রেজার বিরুদ্ধে। মাসুদ রেজা মেহেরপুর ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের ভুগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

স্মারক সংখ্যার কোথাও মরহুম ছহিউদ্দিনকে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার বা জড়িত থাকার তথ্য না থাকলেও সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম খানের বাণীতে মরহুম ছহিউদ্দিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্মারক সংখ্যার একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভারতের বেতাই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পতাকা উত্তোলন করছেন ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম সেখানে পতাকাকে সালাম জানাচ্ছেন মরহুম ছহিউদ্দিন। ওই একই ছবি মেহেরপুর ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষর কক্ষে নোটিশ বোর্ডে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মেহেরপুর ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০২২ সালের মার্চ প্রকাশিত ইতিহাসের পাতা থেকে মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন (স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত) নামের একটি স্মারক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত স্মারক সংখ্যা ও কলেজের অধ্যক্ষর কক্ষে ইতিহাস পরিক্রমায় ছহিউদ্দিন কর্ণার পর্যবেক্ষণ করলে ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি উঠে আসে।

স্মারক সংখ্যা থেকে জানা গেছে, সংখ্যাটি একটি গবেষণা সংকলণ। ইতিহাসের পাতা থেকে মোহাম্মদ ছহি উদ্দীন (স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত)” নামকরণের সংখ্যাটি সম্পাদনা করেছেন ছহি উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক এম মাসুদ রেজা। সংখ্যাটিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি’র “কিছু কথা” এবং মেহেরপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খানের বাণী ছাপানো হয়েছে। স্মারকসংখ্যায় তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে ২২টি নাম। তার মধ্যে সালাউদ্দিন দুলক, (সাবেক সরকারি কর্মকর্তা) ভূগোল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাফর ওয়াজেদ মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, আব্দুল হামিদ রায়হান রুপান্তর কুষ্টিয়া, জীবনের জয়রথ, তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী এবং ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম।

সংকলণে প্রায় পঞ্চাশটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। যেগুলো দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক যুগান্তর (কলকাতা), বাংলার বাণী, জয়বাংলা মুজিবনগর, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আযাদ ও দি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকাগুলো থেকে।

যে ছবিটি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, সেটি হলো, “মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে বেতাইয়ে পতাকা উত্তোলন করছেন হুইফ আমির উল ইসলাম এবং সালাম দিচ্ছেন মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন ও অন্যান্য এমএনএ/ এমপিগণ” এই ক্যাপশন সংবালিত একটি ছবি। যেটি সংকলণের চব্বিশ পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে।

আবার এই ছবিটিই ক্যাপশন বদলিয়ে ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের রুমে ডিসপ্লে বোর্ডে সাটানো হয়েছে।বোর্ডের একাংশে লেখা “ইতিহাস পরিক্রমায় ছহি উদ্দিন বিশ্বাস”। তার নিচে দেওয়া রয়েছে ৬টি ছবি। বোর্ডের অপরাংশে লেখা আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সংগঠক ও মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক ছহিউদ্দিন বিশ^াস এর জীবনতরী। বোর্ডে দেওয়া ছয়টি ছবির মধ্যে (বাম থেকে) দ্বিতীয় ছবিটি ক্যাপশন বদলানো সেই ছবি। ক্যাপশনে লেখা আছে “শপথ অনুষ্ঠানে প্রথম সরকারের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময়”। একই ছবি ভারতের বেতাই ক্যাম্পের আবার প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের। এটি পরিকল্পিত বিকৃিত বলে মনে করেছেন অনেকেই। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরণের ইতিহাস বিকৃতি সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরাও অনেকটাই অবাক হয়েছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ একরামুল আযীমকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, আমি এই সংকলণ বা আমার রুমের ডিসপ্লে বোর্ডের ছবি বা লেখা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবো না। ৫২ পৃষ্ঠার সংকলনটির কোনো একটি স্থানেও আমার কোনো নাম নেই। এটি সম্পাদনা করেছেন, কলেজের সহকারী অধ্যাপক এম মাসুদ রেজা, তাকেই জিজ্ঞাসা করেন। আপনার কলেজের অনেক শিক্ষার্থী এই বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছে। তাদেরকে আপনি কোনটি ঠিক বলে উত্তর দেবেন এবং এটি ইতিহাস বিকৃতি কিনা এমন প্রশ্নে অধ্যক্ষ একরামুল আযীম কোনো কথা বলতে সম্মত হননি।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা গেছে, মরহুম ছহিউদ্দিন পঞ্চাশ দশকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে মেহেরপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করেন। ষাটের দশকে মেহেরপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৯ হতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্য ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। তিনি ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে মেহেরপুর-মুজিবনগর আসনের জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন অনুকরণীয় রাজনীতিককে নিয়ে এধরনের পরিকল্পিত ইতিহাস বিকৃতি কি খুব জরুরী ছিল ? ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উনার অনুপস্থিতি কি উনার অর্জন বা রাজনৈতিক জীবনকে খাঁটো করে ? তাহলে কেনো একটি ছবির ক্যাপশন পাল্টিয়ে মরহুম ছহিউদ্দিন (স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত) ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেখানো হলো ?

সংকলনটিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি স্মারকসংখ্যার কিছু কথা শিরোনামে তাঁর বাবা সম্পর্কে লিখেছেন, কিংবদন্তিতুল্য অনুকরণযোগ্য এক মহান রাজনীতিক হিসেবে। কোথাও তিনি ১৭ এপ্রিলের শপথ অনুষ্ঠানে তার বাবার উপস্থিতির কথা লেখেন নায়। অতিউৎসাহি হয়ে এ ধরনের একটি বিকৃত ইতিহাস কেনো জন্ম দেওয়া হলো এনিয়ে একটি তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কিছু শিক্ষানুরাগী ও সংগঠক বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কক্ষে বিকৃত ইতিহাস প্রকাশ করার ফলে শিক্ষার্থী ভুল ইতিহাস শিখবে। একই সঙ্গে ম্যাগাজিনে সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলমের বাণীতে যে মিথ্যাচার করা হয়েছে তারও অনুসন্ধান করে ম্যাগাজিনের সংশোধনী সংস্করণ বের করার দাবী জানান তারা।

মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিলের কোরআন তেলোয়াতকারী বাকের আলী বলেন, ৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের শপথ অনুষ্ঠানে মরহুম ছহিউদ্দিন সাহেব উপস্থিত ছিলেন না। অথচ, একটি ছবির ক্যাপশন বদল করে তাকে উপস্থিত দেখানো ঠিক হয়নি। এটি ইতিহাস বিকৃতি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন আচরণ শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হবেন।

মেহেরপুর জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি তোজাম্মেল আযম বলেন, একটি স্মরণিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি কমিটি থাকতে হয়। অথচ, এই স্মরণিকাটি মাত্র একজনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। সেকারনে, মারাত্বক একটি অপরাধও সংগঠিত হয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব:) এম এ মালেক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মো: নুরুল ইসলাম তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, জাতীর শ্রেষ্ট অর্জন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি একটি জঘন্য অপরাধ। সে যেই হোক ইতিহাস বিকৃতিকারির বিচার হওয়া উচিত।

তৎকালিন বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি দোয়াজ উদ্দিন মন্ডল (যিনি ১৭ এপ্রিলের আনুষ্ঠানিকতার প্রত্যক্ষ সংগঠক ছিলেন) বলেন, আমি অনেকবার বলেছি, মেহেরপুরের কোনো নেতাই সেদিন মুজিবনগরে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও যারা এধরনের ইতিহাসকে বিকৃত করে তাদের বিচার হওয়া উচিৎ। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত নেতা মোমিন চৌধুরীর ভিডিও রেকর্ড মেহেরপুর প্রতিদিনের সংগ্রহে আছে। তিনিও মরহুম ছহিউদ্দিন বিশ্বাসের উপস্থিতির কথা স্বীকার করেননি।

মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ইতিহাস বিকৃতি খুবই লজ্জাজনক, শিক্ষার্থীরা এতে বিভ্রান্তি হবে। মরহুম ছহিউদ্দিন সাহেব ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের অনুষ্ঠানে ছিলেন না (প্রিন্ট ভার্সনে ছাপাজনিত ভুলের কারণে ‘না’ শব্দটি বাদ গিয়েছে)। তাঁকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করা মানে তাঁকেই খাটো করা হয়েছে।

তবে স্মারক সংখ্যার সম্পাদক ও মেহেরপুর ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রেজার সাথে মেহেরপুর প্রতিদিন থেকে কথা বলার জন্য বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং তিনি ফোন ব্যাকও করেননি।