
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই প্রেম-ভালোবাসা শব্দ দুটো জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনের সঙ্গে। ভালোবাসা-প্রেম, এখনো প্রকৃতির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও রহস্যময় আবেগ। প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া কোনো মানুষই পরিপূর্ণ নয়। আজও মানুষের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল হলো ভালোবাসা। মানুষ এই ভালোবাসার জন্যই বেঁচে থাকার শক্তি পায় আবার ভালোবাসা শূন্য হলে নিঃশেষ হয়ে যায়।
ভালোবাসার মানুষের জন্য বেদনা আর রক্তের অক্ষরে লেখা হতো চিঠি। রাত জেগে পরচোখের আড়ালে হৃদয় নিংড়ানো শব্দ ঝাঁপি খুলতো সন্তর্পণে। তারপর সেই চিঠি কাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছিল আরেক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা।ভালোবাসার সম্পর্কে যা একে অপরের মধ্যকার সমুদ্র সমান দূরত্ব আর পর্বত সমান বাধাকে জয় করে জন্ম দিতো আত্মার এক বন্ধনের।আত্মার এ মিলন জন্ম জন্মান্তরের।এর বিনাশ নেই,হতে পারে না! আর তাই যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্ম হয় ভালোবাসার। ভালোবাসার মৃত্যু নেই,তার রয়েছে শুধু বিকাশ। ভালোবাসা সত্যিই অমর। সত্যিকারের ভালোবাসাই যে পৃথিবীতে সবচাইতে মূল্যবান, তা প্রমাণিত হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দীতে।
ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস ও রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেনের প্রেম কাহিনি পৃথিবীতে স্বরণীয় হয়ে থাকবে।ইতিহাসে মিশরীয় ফারাও ক্লিওপেট্রা আর মার্ক অ্যান্থনির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাদের করুন প্রেম কাহিনি। দিল্লির প্রভাবশালী দম্পতি বাদশাহ শাহজাহান ও তার রানি মমতাজ। ভালোবাসার কাহিনী কারও অজানা নয়। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা যুগে যুগে মানুষের অন্তরে বসত করে।স্বর্গীয় প্রেম নামে আখ্যায়িত লাইলি-মজনুর প্রেম কাহিনী। তাদের সম্পর্ক এতটাই দৃঢ় ছিলো যে, মজনুকে আঘাত করলে আহত হতেন লাইলি নিজেই।প্রেমের জন্য এমন কত আত্মদানের নজির, সাহিত্যে অনুষঙ্গ।
একটা সময় ছিল যখন প্রেম বলতেই ছিল অন্তঃপুরের বিষয়। কাউকে ভালোবাসি বলাটাও ছিল পাপ। ‘হৃদয়ের কথা বলতে চাওয়ার ব্যাকুল’মন দহনে দহনে অঙ্গার হতো। বুক ফাটলেও মুখ ফুটতো না। জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও প্রেম ছিল নিঃশেষিত।দেড় দশক আগেও প্রণয় এতোটা দুঃসাহসিক হয়ে উঠতে পারেনি। ভাঙতে পারেনি সামাজিকতার দেয়াল।
এখন সময় বদলে গেছে। পার্বতীর জন্য দেবদাসের দীর্ঘ অপেক্ষার যুগ শেষ হয়েছে । শিরি-ফরহাদের মতো অতৃপ্ত ভালোবাসার ইতিহাসও আর লেখা হবে না। প্রণয়-সঙ্গ এখন খুবই সহজ। চাইলেই প্রেম হয়! না চাইলেও হয়।আজকের যুগে ভালোবাসা এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাচেতনা, জীবনযাত্রা ও প্রযুক্তির বিকাশ ভালোবাসার ধরনও বদলে দিয়েছে।
আগেকার দিনে ভালোবাসা ছিল অপেক্ষা, চিঠির আদান-প্রদান, একে অপরের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করার মতো ধৈর্যের পরীক্ষা। কিন্তু বর্তমান যুগের ভালোবাসা অনেকটাই গতিময়, প্রযুক্তিনির্ভর এবং বহুমাত্রিক।বর্তমান সময়ে প্রেম বা প্রণয় সম্পর্ক গড়া সহজ হলেও ভিত নড়বড়ে। বন্ধনও অতটা পোক্ত নয়। তাসের ঘরের মতো সম্পর্ক। এই আছে, এই নেই।আগে প্রিয় মানুষটির হৃদয়ের ধ্বনি তখন শোনা যেতো দূর থেকেও।বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে।বদলে গেছে প্রেমের মাধ্যমও। ফেসবুক,টুইটার,লিংকডইন,ম্যাসেঞ্জার,হোয়াটসআপ,ভাইবার,ইমো,স্নাপচ্যাট,জি-প্লাস,ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদি কত কিছু।এখন ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায় ইনবক্সের বার্তায়, ইমোজির হাসিতে, কিংবা হঠাৎ আসা নোটিফিকেশনে। সম্পর্ক শুরু হয় এক ক্লিকেই, আবার শেষও হয়ে যায় আরেক ক্লিকে। প্রশ্ন জাগে—এমন ভার্চুয়াল ভালোবাসা কি সত্যিকারের সম্পর্কের সমান?ভার্চুয়াল এই প্রণয় জগৎ ঠুনকো করে দিচ্ছে আন্তরিক সম্পর্ক।চাকচিক্য প্রিয় মানুষ, সুন্দরের পুজারি মানুষ বিশ্বাস হারাচ্ছে অন্তর্জালিক প্রতারণায়, যা বড় ধরনের বিপদও ডেকে আনছে সময়ে সময়ে।যোগাযোগ সহজ হওয়ায় মানুষের মনের টানও কমে আসছে।আগে প্রিয়তমা বা প্রিয়তমর দেখা পাওয়ার জন্য যে উত্তেজনা বা হৃদয়ের টান অনুভূত হতো মানবহৃদয়ে তা এখন নেই বললেই চলে।কারণ চাইলেই মুহূর্তে ভিডিও কলে রাখা যায় চোখে চোখ।
ভার্চুয়াল এই সাক্ষাতে কিছু ক্ষেত্রে প্রিয়জনকে কাছে টানা গেলেও আত্মিক বন্ধন নেই বললেই চলে।একটা উদাহরণ দিলে তা কিছুটা স্পষ্ট হবে।আমরা যখন কারও সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলি, তখন দুজনই দুজনের প্রতি মনোযোগী হই।তখন কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনায় তৃতীয় কেউ আসতে পারে না।কিন্তু আমরা যখন ম্যাসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলি, তখন একই সময়ে একাধিক জনের সঙ্গে আলাপ হয়।তখন আর মনোযোগ একমুখী থাকে না।একই সময়ে চিন্তাশক্তি এবং মনোযোগও ভাগ হয়ে যায়।এতে আলাপের গুরুত্বও অনেক ক্ষেত্রে কমে আসে ।কারও কারও জীবনে এই ভার্চুয়াল প্রেমই পরিণত হয়েছে স্থায়ী দাম্পত্যে। তাই প্রযুক্তি যেমন দূরত্ব কমিয়েছে, তেমনি ভালোবাসার নতুন এক অধ্যায় তৈরি করেছে।কিন্তু এই ভালোবাসার ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভঙ্গুরতা। বাস্তবে দেখা না হওয়ায় অনেক সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে কেবল কল্পনার ওপর। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাজানো হাসি, এডিট করা ছবি আর অল্প কিছু কথোপকথন দিয়েই তৈরি হয় এক পৃথিবী। অথচ বাস্তবে সেই পৃথিবী হয়তো একেবারেই আলাদা। তাই সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতেই সম্পর্ক ভেঙে যায়, এক নিমিষে হয়ে যায় ব্লক কিংবা আনফ্রেন্ড।এই ধরনের ভার্চুয়াল সম্পর্ক খুব বেশি দৃঢ় হয় না।দীর্ঘদিন একসঙ্গে পথচলাও সম্ভব হয় না.তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ভার্চুয়াল ভালোবাসাকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা, পরিবার কিংবা নিজের ভবিষ্যতের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সেই সম্পর্ক। আবার এমনও আছে যারা কেবল সময় কাটানোর জন্য সম্পর্ক গড়ে তোলে, আর অন্যজন ডুবে যায় মানসিক আঘাতে।
তাহলে কি ভার্চুয়াল ভালোবাসা মিথ্যে? আসলে ভালোবাসা মিথ্যে হয় না কখনো। মিথ্যে হয় মানুষ, যদি সেখানে না থাকে সততা, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা। ভালোবাসা যদি আন্তরিক হয়, তবে সেটা ভার্চুয়াল হোক বা বাস্তব—দুই জায়গাতেই সমান সত্য। শুধু ইমোজি পাঠালেই সম্পর্ক টেকে না; আবার দেখা না করেও হৃদয়ের গভীর টান তৈরি হতে পারে, যদি দুইজন মানুষ সত্যিই একে অপরকে গুরুত্ব দেয়।
আজকের এই ডিজিটাল যুগে ভালোবাসা হয়তো অনেকটাই ভার্চুয়াল হয়ে গেছে—এটাই সময়ের নিয়ম। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা আমাদের সবার জন্য রয়ে গেল—আমরা কি সত্যিই ভালোবাসছি, নাকি কেবল স্ক্রিনের আলোয় তৈরি করছি এক ক্ষণস্থায়ী মরীচিকা?
লেখক: কবি ও উদ্যোক্তা।