
বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে ভূমি। কৃষি, শিল্প, আবাসন ও অবকাঠামো প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভূমির সুবিন্যস্ত ব্যবহার জাতীয় অগ্রগতির অন্যতম শর্ত। ভূমি মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়নও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। বাংলাদেশে ভূমি নিয়ে বিরোধও বেশি এর জন্য প্রয়োজন ভূমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এ লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় হয়রানিমুক্ত, জনবান্ধব অটোমেটেড ভূমিসেবা নিশ্চিতকরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি সমন্বিত, Inter-operable ও ডাইনামিক ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পুরো ভূমিসেবা ডিজিটাইজেশনের রূপরেখা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ভূমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় জনবান্ধব অটোমেটেড ভূমিসেবা নিশ্চিতকরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের অটোমেটেড মিউটেশন সিস্টেম ২.১ চালুর মাধ্যমে ভূমিসেবায় হিউম্যান টাচ আরও কমিয়ে ফেলা হয়েছে এবং ভূমিসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপর নির্ভরতা অনেক কমে যাবে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের অটোমেটেড নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম এবং খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ সরবরাহ সিস্টেম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভূমিসেবা আরও জনবান্ধব করেছে। land.gov.bd ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনভিত্তিক ভূমি সংশ্লিষ্ট সকল সেবা একই প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনা হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মে রেজিস্ট্রেশন ও প্রোফাইল তৈরি করে single sign-onএর মাধ্যমে অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর, নামজারি, খতিয়ান বা পর্চা ও ম্যাপ প্রাপ্তির আবেদন এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমে নগদ অর্থ ছাড়া ফি পরিশোধ করে সহজেই দাখিলা, নামজারি খতিয়ান, খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি ও ম্যাপ সংগ্রহ করা যাচ্ছে। ডাক-বিভাগের মাধ্যমে খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ নাগরিকদের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের অটোমেটেড মিউটেশন সিস্টেমের ফলে নামজারির জন্য নাগরিকদের মাত্র একবার উপজেলা ভূমি অফিসে আসতে হবে মূল দলিল যাচাই ও শুনানির জন্য। এটাও করা হয়েছে ভূমি জালিয়াতি রোধ করার জন্য। নামজারি হওয়ার সাথে সাথে পূর্ববর্তী মালিকের খতিয়ান হতে জমি কর্তন হয়ে নূতন মালিকের খতিয়ানে চলে আসবে। এর ফলে তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে একই জমি দ্বিতীয়বার বা বারবার বিক্রয় করার সুযোগ বন্ধ হবে। এছাড়া নামজারির সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হোল্ডিং তৈরি হয়ে যাবে এবং ভূমি মালিক ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পারবেন। হোল্ডিং তৈরির জন্য ভূমি মালিকদের আর ভূমি অফিসে ধর্ণা দিতে হবে না। এতে দুর্নীতি ও জন-হয়রানি অনেক কমে যাবে।
একই সাথে ভূমিসেবায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে “ভূমি” অ্যাপ, হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা। ভূমি অ্যাপ এর মাধ্যমে নাগরিক ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান ও দাখিলা সংগ্রহ, নামজারির ফি প্রদান, ডিসিআর ও খতিয়ান সংগ্রহ এবং খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি ও মৌজা ম্যাপ সংগ্রহ করতে পারবেন ঘরে বসে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভূমিসেবা ভূমি অ্যাপ এর মাধ্যমে প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
ভূমি অ্যাপ নিজে ব্যবহার করার পাশাপাশি জনগণকে ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় জনগণকে ঝামেলাহীন সেবা প্রদানে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ভূমিসেবার জন্য নাগরিকদের সহজবোদ্ধ সফ্টওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে। ভূমি সেবার ইন্টিগ্রেটেড মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারের সময় সার্ভার নিরাপদ রাখা ও ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। ফলে দিনশেষে আমরা পেপারলেস ভূমি ব্যবস্থাপনার স্বপ্ন দেখতে পারি।
ডিজিটাল যুগ আমাদের জীবনযাত্রা,সকল সেক্টরে কর্মপদ্ধতি এবং সেবাগ্রহণের পদ্ধতিকে আমূল বদলে দিয়েছে। কিন্তু এ পরিবর্তনের গতি ও সুবিধা সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায়নি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা এখনো সীমিত। ফলে সরকারি সেবা গ্রহণ, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কাজ, অনলাইন লেনদেন কিংবা মৌলিক নিরাপত্তা বিষয়ে তারা পিছিয়ে পড়ছেন। এই অসচেতনতা কমানো রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েরই জরুরি দায়িত্ব। ভূমিসেবা সহায়তা কেন্দ্র নামে সকল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সারা দেশে ৮৪০ টি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং আরো করা হবে। ভূমি সেবা প্রাপ্তি সহজ ও দ্রুত করার লক্ষ্যে এই সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্রের হতে নাগরিকরা অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর, মিউটেশন, খতিয়ান ও জমির নকশা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে পারে এবং ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে পারে।
ইতোমধ্যে ২য় প্রজন্মের ভূমিসেবা সিস্টেমের উপর প্রায় প্রাথমিকভাবে ৬০০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। সারাদেশের সকল কর্মকর্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য Training for Trainers (ToT)প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাশাপাশি সারাদেশে জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।ঢাকা মহানগর ও জেলার ১৯টি সার্কেল/উপজেলায় এবং নারায়নগঞ্জ জেলার ১টি সার্কেলে সফলভাবে পাইলটিং সম্পন্ন করে সারা দেশে (৩ পার্বত্য জেলা ব্যতীত) এই সেবা চালু করা হয়েছে।
ডিজিটাল সেবার পাশাপাশি আইন-বিধি-নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিসেবা সহজ ও জনবান্ধব করার কাজ চলমান আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয় বেশকিছু আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করেছে:ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিধিমালা ২০২৪ প্রণীত হয়েছে। এর মাধ্যমে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রকৃত ভূমি মালিকদের ভূমি সুরক্ষায় ৬১ জেলায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভূমি আপীল বোর্ড বিধিমালা ২০২৫; হাটবাজার ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২৫। বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন উল্লেখযোগ্য আইন ও বিধিমালাসমূহের মধ্যে ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫; স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম-দখল বিধিমালা, ২০২৫; বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২৫; জলমহাল আইন, ২০২৫ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যন্ত্রের পিছনের মানুষটার মানসিকতা। সেই মানুষটার উন্নত মানসিকতাই নিশ্চিত করবে জনবান্ধব ভূমিসেবা। সারাদেশে ভূমিসেবা সিস্টেমে শতভাগ খতিয়ান ও হোল্ডিং এন্ট্রি করা এবং ভুল সংশোধনের জন্য ইউএনডিপি, বাংলাদেশ এর মাধ্যমে কাজ শুরু করা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট ২০২৫ ফেনী জেলায় এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। বর্তমানে ৮টি জেলায় পাইলটিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। পর্যায়ক্রমে শতভাগ খতিয়ান ও হোল্ডিং এন্ট্রি এবং ভুল সংশোধনের এ কার্যক্রম সারা দেশে বাস্তবায়িত হবে। ডেটা এন্ট্রি সম্পন্ন হলে ভূমিসেবা সিস্টেমে আরও সহজ, জনবান্ধব ও স্বয়ংক্রিয় হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইউএনডিপি-এর সহায়তায় ভূমিসেবা সিস্টেমে জয়পুরহাট জেলার শতভাগ খতিয়ান ও হোল্ডিং এর নির্ভুল তথ্য সম্পন্ন করেছে।
ডিজিটাল সেবার পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়লেও সচেতনতা ও দক্ষতার উন্নয়ন ততটা দ্রুত হচ্ছে না। ভূমি সেবার ক্ষেত্রে এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এসব সেবার প্রয়োজনীয়তা বুঝলেও অনেকেই জানেন না কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। ডিজিটাল রূপান্তরের প্রকৃত সফলতা তখনই আসবে যখন দেশের প্রতিটি মানুষ নিজে ব্যবহার করতে পারবে।
ডিজিটাল ভূমিসেবা কেবল স্লোগান নয় এটি নাগরিকের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার। তাই সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল বিষয়ে সচেতন ও দক্ষ করে তোলাই এখন সময়ের দাবি। পরিষেবা প্রদানের প্রতিটি ধাপলগইন থেকে আবেদন, পেমেন্ট থেকে সনদপ্রাপ্তিসবই হতে হবে সহজ, সংক্ষিপ্ত ও বোধগম্য। সহজবোদ্ধ ডিজিটাল সেবা হলো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সময়সাশ্রয় নিশ্চিত করতে সহজ, দ্রুত ও ব্যবহারবান্ধব সেবা গড়ে তুলতে হবে। তবেই ডিজিটাল ভূমিসেবা সত্যিকার অর্থে নাগরিকবান্ধব হবে।
লেখক: তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়।


