ভয় – এসআই মেহেদী

ভয়ে আজ থরথরিয়ে হাতটি কাঁপছে! কী বোর্ডে হাত ঠিকমতো পড়ছে না। মাথাটাও কেমন যেন দপ দপ করছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খুব খুব বেশি ভয় হচ্ছে! অজানা আতঙ্কে হৃদয়ের কম্পন গতি বেড়েই চলেছে। একটি পরাজয়ের ভয় যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে আমার মানসপটে। কেন এতো ভয় হচ্ছে আমার?

৭১ এর রনাঙ্গনে গুলিবিদ্ধ কিশোর ছেলেটিতো সেদিন ভয়ে কাঁদেনি! জীবনের শেষগুলিটিও তো তার লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়নি? তের বছরের কিশোরী মেয়েটি সেইদিন দশজন পাকিস্তানী নরপশুর কাছে নিজেকে সঁপে দিতে এতটুকু ভয় পায়নি? সেই একই দিনে, রাজারবাগ বেতারের কনস্টেবল তো আক্রমণের খবর ছড়িয়ে দিতে ভয় পায়নি! এমনকি আমার পূর্ব পুরুষরা সাজোয়া ট্যাংকের উপর গুলি ছুড়তেও একাত্তরে ভয় পায়নি। তাহলে আজ আমি কেন এতো ভয় পাচ্ছি? আমি তো তাদেরই উত্তরসূরী। তাহলে কি আমি ভীতু! সত্যিই কি আমি ভীতু?

আমিও তো চালিয়েছি সিন্দাবাদের সেই পঙ্খীরাজ। দুর্দান্ত দাপটের সাথে টিপু সুলতানের মতো, আস্তাবলের সবচেয়ে তেজি ঘোড়াটা নিয়ে ছুটেছি সারদার পুলিশ ট্রেনিঙয়ের মাঠে। এক লাফে চুড়ায় উঠেছি; নয় ফুট উচ্চতার সমান সীমানা প্রাচীরের। রশি বেয়ে উঠেছি বাইশ ফুট। গ্রীষ্মের কাটফাটা দাবদাহের গরমে পুড়ে কংক্রিটের রাস্তা ধরে প্রতিদিন দৌড়েছি দশ কিলোমিটার পথ।

একআঙ্গুলে বহন করে চলেছি চার কেজি ওজনের হাতিয়ার। আমার আঙ্গুলের ইশারায় গগনবিদারী শব্দে গর্জে উঠেছে বিশ্বসেরা সব আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু আমি তখন একটুও ভয় পাইনি।প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে দেখেছি নতুন নতুন কবর! যারা কয়দিন আগে আমাদের মতো করে দৌড়াতো এই কংক্রিটের রাস্তা ধরে। দেখেছি সারদাহ এর মাঠে হঠাৎ পাশের বন্ধুটি কংক্রিটের উপর পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে।

আর আমরা তাকে ফেলে দৌড়ে চলেছি। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে কতো জন ভেঙ্গেছে হাত, পা এবং কোমর। তাদেরকে নিয়ে দ্রুত গতিতে মাঠ ছেড়েছে অ্যাম্বুলেন্স। তখনতো কোন ভয় পায়নি আমি। মৃত্যু পুরীতে কাটিয়েছি একটি বছর। প্রতিদিন আশে পাশে ঘুরেছে আজরাইল।

একটুও ভয় পাইনি। কিন্তু আজ আমার বড্ড ভয় হচ্ছে। এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষন শেষে পবিত্র সংবিধান, পতাকা ও পবিত্র কোরআনে উপর হাত রেখে শপথ করছি দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করবো না। তাহলে কেন? কেন সেই আমি আজ ভয় পাবো?

আমার ভয় হচ্ছে। বড্ড ভয় হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, হাজারো আশরাফুল শেখদের কথা ভেবে। নড়াইলের আশরাফুল শেখ। বয়স আর কতোই বা হবে!দুই কন্যা সন্তানের জনক তিনি। বড় মেয়েটি এবার অনার্স শেষ করেছে; আর ছোট মেয়েটি এবার এইচ এস সি দিবে।

আশরাফুল শেখ রোগাক্রান্ত জীর্ণ শীর্ণ শরীরে মাদুরের বোঝা মাথায় নিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে। তার পা যেদিন চলে না; বাড়ির চুলাটাও সেইদিন জ্বলেনা। আশরাফুল শেখের শরীরটা বেশ কয়েক বছর ধরেই খারাপ। চিকিৎসা তো দূরের কথা, মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত একবেলা বিশ্রাম তার কপালে জোটেনি। তার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। একটি মাত্র কুড়ে ঘর ছাড়া আর কোন সম্পদ তার নাই। মেয়ে দুইটি পড়াশুনায় খুব ভালো।

আশরাফুল শেখ ক্ষুধা পেটে অসুস্থ শরীরে মাদুরের বোঝাটি মাথায় নিয়ে মনের জোরে ধীরপায়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ফেরি করে। ভাবে বড় মেয়েটা চাকরী পেলে তার আর কস্ট থাকবে না। আশরাফ শেখ শেষ কবে দুপুরের খাবার খেয়েছে তার মনে পড়ে না। কখনো একটা বিস্কুট সাথে কয়েক গ্লাস পানি দিয়ে পেটটা ভরেছে।তবে ইদানীং সে মনে করে তার চিকিৎসা করানোটা খুব বেশী দরকার।

কিন্তু ভাত যেখানে স্বপ্ন; চিকিৎসা সেখানে বিলাসিতা ছাড়া আর কি! ছোট মেয়েটার সামনে পরীক্ষা। তার একটা জামা কেনার দরকার। আশরাফ শেখ প্রতিদিন অল্প অল্প করে জমিয়ে তিনশ টাকার মতো করতে পেরেছে। বড় মেয়েটার এমবিএ ভর্তীর তারিখ দিয়েছে। লাগবে তিনহাজার টাকা। এই সব ভাবতে ভাবতে আশরাফ শেখ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

কোন ভাবেই আশরাফ শেখের জ্ঞান ফেরেনা। স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করেন।

আশরাফ শেখের মেয়েরা স্থানীয়দের কিছু সহায়তা এবং সুদি মহাজনের কাছ থেকে ধার করে চব্বিশ হাজার টাকা নিয়ে গত ১১/৫/২০২০ তারিখে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে হাসপাতালে ভর্তি করায়। টাকার অভাবে তেমন কোন চিকিৎসা সে পায়নি।

এরই মধ্যে আশরাফ শেখের শরীরে করোনা ভাইরাসের লক্ষ্মণ প্রকাশ পায়। পরীক্ষায় আশরাফ শেখের করোনা পজিটিভ আসে। অভিমানী আশরাফ শেখ ২০ মে ২০২০ তারিখে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে আল্লাহ্‌র কাছে আপন গন্তব্যে পাড়ি জমান।

কিন্তু আশরাফ শেখ মরেও যেন মুক্তি পেলোনা। পেলোনা প্রিয় ভূমি ও প্রিয় মানুষের বিদায়। যেহেতু আশরাফ শেখ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলো, তাই তাকে কবর দেওয়ার জন্য কেউ জমি দেয়নি। কেউ খুড়তে চাইনি তার কবর। আশরাফ শেখের অসহায় মেয়ে আর স্ত্রীর বুকফাটা কান্নায় গলেনি কারোর হৃদয়।

এদিকে হাসপাতাল থেকে লাশ নেওয়ায় জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছে কতৃপক্ষ। কি করবে আশরাফ শেখের মেয়ে আর স্ত্রী? তাদের তো নিজের কোন জমি নাই। আবার লাশ দাফনের মতো কোন পুরুষ মানুষ ও নাই। তারা অঝোর ধারায় কেঁদেই চলেছে হাসপাতালের সামনে।

আল্লাহ মানুষকে কেন এতো কঠিন পরীক্ষায় নেন? মানুষ কেন এতো বেশী অসহায়? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জোরাজুরীতে আশরাফ শেখের মেয়ে তাদের অসহায়ত্বের কথা কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা লাশ পুলিশ কে দিয়ে দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করে।

আশরাফ শেখের মেয়ে একথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা তার বাবাকে চিকিৎসা করাতে পারলো না; মরার পরে নিজেরা দাফন কাজও করতে পারবে না। তার প্রিয় বাবার লাশটাও বাড়িতে নিতে পারবে না।

আশরাফ শেখের মেয়ের বুক ফাটা চিৎকারে হাসপাতালের আশপাশে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠে। বারবার বাড়িতে ফোন করে কোন সাড়া না পেয়ে আশরাফ শেখের মেয়ে কান্না থামিয়ে বলে, আপনারা যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করেন।

আমরা লাশ গ্রামে নিতে পারবো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অফিসার ইনচার্জ মিরপুর মডেল থানা লাশ দাফনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এইসব দেখে শুনে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। ইদানীং খুব তাই ভয় হচ্ছে আমার!

সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশজনের করোনা পজিটিভ মিরপুর থানায়। করোনা উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষার অপেক্ষায় আরো দশজন। তাই ভয় হয় মিরপুর থানার আমরা সবাই যখন করোনা পজিটিভ হয়ে যাবো তখন কি ঘটবে? আশরাফ শেখদের লাশ কি তখন রাস্তায় পড়ে থাকবে?

এজন্যই কি তের বছরের কিশোরীটা সেদিন তার শরীরের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের উদ্দাম নাচ নাচতে দিয়েছিল? সে কি জানতো টাকার অভাবে আশরাফ শেখদের চিকিৎসা হবে না? জমি না থাকার কারনে নিজ গ্রামে তার কবর হবে না?

আশরাফ শেখদের কথা শুনে কি কষ্ট পাবেনা সেদিনের সেই কিশোর যোদ্ধাটি। সে যদি জানতো আশরাফ শেখদের জন্য স্বাধীন দেশে এই পরিনতি অপেক্ষা করছে তাহলে কি সে ভয় পেতো না?

সে কি পারতো গুলি করে লক্ষ্য ভেদ করতে? নিশ্চয়ই এ কথা জানলে তার হাত কাপতো! বুক চিতিয়ে দাড়াতে পারতো না সেদিন রাজার বাগের পুলিশ বাহিনী!

তাই আজ আমার বুক ভয়ে দূরু দূরু করছে! আমার তো টাকা নাই; চিকিৎসা হবেতো? আমার জমি নাই কবরের জন্য; কেউ জমি দিবে তো? আমার থানায় বিশজন আক্রান্ত!

আমি যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আমার লাশ নিজ গ্রামে নেওয়া হবেতো? তাই একথা বলতে আজ আমার কোন লজ্জা নাই! ভয়ে আমার বুকটা কাঁপছে।

সত্যিই খুব ভয় পাচ্ছি আমি।

মেপ্র/এমএফআর