
জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপের নাম বিয়ে। বিয়ে হল দুটি জীবনের চির বন্ধন। বিয়ে দুটি আত্মার একসাথে চলার প্রতিশ্রুতি। বিয়ে ভালোবাসার এমন এক অনুভূতি, যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে তোলে। বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে জন্ম নেয় শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ ও একে অপরের প্রতি গভীর যত্ন। পথ চলার স্থায়ী সঙ্গী হিসেবে পাশাপাশি থাকেন স্বামী-স্ত্রী। বিয়ে মানে কিন্তু কেবল একসঙ্গে থেকে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া নয়। এর অর্থ এবং প্রভাব আরও বেশি। এমনকি বার্ধক্যে একসাথে চলার প্রতিশ্রুতির নাম বিয়ে।
মানসিক নির্যাতন সচরাচর একদিনে শুরু হয় না। এটি সম্পর্কের ভেতরে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় — যখন ভালোবাসা বদলে যায় নিয়ন্ত্রণে, বোঝাপড়া বদলে যায় নির্দেশে। উচ্চস্বরে গালাগাল করা, মিথ্যা বলা, চারিত্রিক অপবাদ দেওয়া, খারাপ ব্যবহার করে পরমুহূর্তে তা অস্বীকার করা — এসবই মানসিক নির্যাতনের অংশ।
এমনকি অনেক সময় নির্যাতনকারী বলেন, “আমি রাগ করার মতো কিছু বলিনি, কী এমন বলেছি? খারাপ কী বললাম?” — এই কথাগুলোর মধ্যেও লুকিয়ে থাকে মানসিক নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র।তুমি এখানে যেতে পারবে না, “তুমি ঘরের বাইরে কাজ করতে পারবে না,তুমি শুধুই সংসার সামলাবে।বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও মানসিক নির্যাতন।”তুমি এটা কেন করছ?”, “তুমি এমন পোশাক পরো না”, “তুমি কিছুই ঠিকমতো পারো না”, “তোমার কাজের কোনো দাম নেই, তুমি কেবল বোঝা” — এসব কথায় ধীরে ধীরে ভেঙে যায় একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস।শুধু তাই নয়, যৌতুকের জন্য চাপ দেওয়া বা বাধ্য করাও এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলা, উপেক্ষা করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, স্পষ্ট করে দোষ না বলা, স্ত্রীর বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে খোঁটা দেওয়া, অপমানসূচক কথা বলা কিংবা গালিগালাজ — সবই মানসিক নির্যাতনের প্রতিফলন।
স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা বা সন্তান নিতে বাধ্য করা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন দুই-ই। এমনকি পুত্র সন্তানের জন্য বারবার গর্ভধারণে বাধ্য করা কিংবা গর্ভস্থ কন্যা সন্তানকে গর্ভপাত করানো — এসবও মানসিক নির্যাতনের গভীর ছাপ ফেলে।
ছোট ছোট কথাগুলো হয়তো প্রথমে তুচ্ছ মনে হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এগুলো রূপ নেয় মানসিক বন্দিত্বে।একজন সঙ্গী অপরজনকে ক্রমাগত ছোট করতে করতে নিজের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, আর অপরজন নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া অসম ভারসাম্যই সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বিষ।
নির্যাতিতা মনে করেন এর চেয়ে গায়ে হাত তুলে মারাও অনেক ভালো। এভাবে সবসময় মানসিক নির্যাতনের চেয়ে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করা যায়।
মানসিক নির্যাতন যা শারীরিক আঘাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ এর ক্ষত দৃশ্যমান নয়, বরং ধীরে ধীরে ভেতরের শক্তি নিঃশেষ করে দেয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, দীর্ঘদিন মানসিক নির্যাতনের মধ্যে থাকলে মানুষ ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, অনিদ্রা, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও আত্মহননের চিন্তায় ভোগে। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হএই কষ্টের কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন থাকে না। বাইরে থেকে সব কিছুই “স্বাভাবিক” মনে হয়, অথচ ভেতরে মানুষটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে।
আমাদের সমাজে ‘নির্যাতন’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই প্রথমে নারীর কথাই সামনে আসে। বাস্তবতা হলো — নারীরাই বেশি ভুক্তভোগী, কিন্তু পুরুষরাও এর বাইরে নন। অনেক পুরুষ প্রতিদিন স্ত্রী বা পরিবারের কাছ থেকে তির্যক ব্যঙ্গ, অপমান কিংবা তুলনার মুখোমুখি হন। কিন্তু সমাজ তাদের কষ্টকে গুরুত্ব দেয় না, কারণ পুরুষের যন্ত্রণা নাকি “পুরুষোচিত” নয়! তাই তারা চুপ করে যান। এই নীরবতাই ধীরে ধীরে সম্পর্কের মধ্যে বিষ ছড়ায়।
আসলে, মানসিক নির্যাতন লিঙ্গভিত্তিক নয়, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার। যে সম্পর্কের ভেতরে একজন সব সময় ‘নিয়ন্ত্রণকারী’ হয়ে ওঠে, সেখানে অন্যজন ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
একটা ধারণা প্রচলিত — “সংসার মানেই সহ্য করা। এই ধারণাই নির্যাতনকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। একজন নারী যদি বলে “আমার স্বামী আমাকে অপমান করে”, সমাজ বলে — “সব পুরুষই তো এমন”। একজন পুরুষ যদি বলে “স্ত্রী আমাকে মানসিকভাবে কষ্ট দেয়”, সমাজ বলে — “তুমি নিশ্চয়ই দুর্বল”। এই চিরাচরিত মানসিকতার কারণেই অনেক দাম্পত্য সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে।
সমাজ ভাবে — যতক্ষণ না কেউ মারা যাচ্ছে, ততক্ষণ সবই সহনীয়। কিন্তু সত্য হলো, মানসিক নির্যাতন ধীরে ধীরে আত্মাকে হত্যা করে।
প্রথমত, সম্পর্কের মধ্যে যোগাযোগের অভাব মানসিক নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কারণ। দুজন মানুষ একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা কথা না বললে, ভুল বোঝাবুঝি, অহংকার ও অপমান জায়গা নেয় ভালোবাসার স্থানে।
মানসিক নির্যাতন কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয় — এটি একটি সামাজিক সংকট, যা নীরবে অসংখ্য সম্পর্ক ধ্বংস করছে। যে সম্পর্কের ভেতরে সম্মান থাকে, সেখানে নির্যাতন টিকতে পারে না। সময় এসেছে আমরা সবাই নিজের ভেতরের দেয়ালটা ভাঙ্গি। ভালোবাসার আসল শক্তি নীরবতা নয়, বোঝাপড়ায়। আর সম্পর্কের সত্যিকারের সৌন্দর্য মুক্তিতে, নিয়ন্ত্রণে নয়।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক


