
মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজারের সবচেয়ে সরু গলিটায় থাকে বুদু শেখ। মানুষ যাকে “মুলি” নামে ডেকে ডেকে ক্ষুদ্র করে দিয়েছে। সাড়ে তিন ফুটের শরীরটা কারো হাসির খোরাক, কেউ ভাবে প্রাকৃতিক। কিন্তু মুলির চোখে জীবন শুধু একটা লরি, যার চাকায় ঘুরে যায় রুটির হিসাব।
তার বাবা, একজন মৃতপ্রায় দিনমজুর, জীবনের শেষে বিছানায় শুয়ে কেবল একটা কথাই বলে গেছেন বারবার: “মানুষ হবি, গায়ের আকারে না, মনে। চাকা ঘুরা থামায় দিস না।”
বাবা চলে যাওয়ার দিন মুলির বয়স মাত্র বারো। সে জানত, কাঁদা নিষেধ। কারণ, কান্না গরিবের রোজগার বন্ধ করে দেয়।
বাস টার্মিনালের ধুলোতে মুলির কৈশোর গলতে থাকে। নোংরা হেলমেট, গ্রীজ মাখা শার্ট, আর লরি চালকদের অশ্রাব্য হাসাহাসিতে সে
ধীরে ধীরে একটা শব্দের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে: “চালাবি?”
প্রথমবার, এক মাতাল চালক কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছিল। মুলি মাথা নিচু করে বলেছিল,
“শিখতে চাই। শুধু শেখা।”
কেউ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সে থেকে গিয়েছিল। চাকা ধুতো, পাম্প করতো, প্যাডেল টিপে ব্রেক কষার কায়দা শিখত পেছন থেকে। ধীরে ধীরে, হেলপার থেকে সহকারী।
একদিন এক চালক বলেন,
“তুই ছোট মানুষ না, তুই হলি চাকার নিচে চাপা পড়া মাটির ছায়া।”
এই কথা তার মগজে থেকে যায়। পুরোনো এক লাল-কালো লরি। ইঞ্জিনে দম্ভ, দরজায় আঁচড়ের নকশা, নম্বর প্লেট ঝাপসাÑ তার হাতে আসে। লাইসেন্সটাও হয়, যদিও অফিসের এক ‘ভাই’-কে খুশি করতে হয়েছিল এক রাতের কাজ দিয়ে।
এপ্রিলের এক পাগল করা রাতে মুলি পাথর বোঝাই লরি নিয়ে ফিরছিল সিলেট থেকে। নির্জন রাস্তা। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। চাঁদের আলোয় পিচ রাস্তা সাপের মত চকচক করছে।
গাড়ির গতি ৮০ কিমি। হঠাৎ এক শব্দ! চিৎকার নয়, যেন পাতা চাপা পড়ার আওয়াজ।
চোখের সামনে এক বৃদ্ধা। সবকিছু ঘটে যায় এক সেকেন্ডে। বুড়ি শুয়ে ছিলেন রাস্তার পাশে। ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। চাকা চলে যায় তার পায়ের ওপর।
মুলির বুক ধক করে ওঠে। হাত কাঁপে, পা কাঁপে, কিন্তু সে গাড়ি থামায়।
লরি আলো ফেলে রেখেছে একফালি আলোকছায়া। বৃদ্ধা কাতরাচ্ছেন। রক্তের ছিটে গরম পিচে শুকিয়ে যাচ্ছে।
চারপাশে কেউ নেই। নিঃশব্দ এক শূন্যতা। কুকুরও নেই।
মুলি হাঁটু গেড়ে বসে। বৃদ্ধার মুখে পানি দেয়। বৃদ্ধা চোখ খুলে তাকান, কিন্তু কিছু বলেন না। শুধু হালকা শব্দে “মা,” বলে যেন দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে চান।
তখনই আসে প্রশ্নটা।
“এই বৃদ্ধ বাঁচলেও কী হবে? চিকিৎসা করতে পারবে না। ঘরে অভাব। হয়তো ছেলে-মেয়েরা তাকে বোঝা ভাববে। আমি যদি এখনই শেষ করে দিই; তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারি।”
এই ভাবনা তার নিজের নয়। সেটা সে জানে। কিন্তু কখনও কখনও মানুষের মধ্যে একটা অন্ধরূপ জন্ম নেয়Ñ অতিমাত্রায় যুক্তিভিত্তিক, নির্দয় এক বিবেক।
সে লরি পিছিয়ে নেয়। এবার পুরো বুকের উপর তুলে দেয় চাকা। মুলি লরি ছালিয়ে চলে আসে মেহেরপুর। তবে ঘুম আসে না মুলির। তবু অদ্ভুতভাবে শান্তি লাগে। এক নিষ্ঠুর আত্মতৃপ্তি। যেন জীবনকে একবার বশে আনতে পেরেছে সে।
পরদিন পত্রিকায় খবর: “রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা কোরবান নামে এক দিনমজুর বৃদ্ধ লরি চাপায় নিহত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃদ্ধটি ঘুমঘোরে অসাবধানতাবশত রাস্তায় চলে গিয়েছিলেন।”
মুলি চা খায় রাস্তার ধারের দোকানে। পত্রিকা হাতে। চোখ যায় নিজের হাতের দিকে। মনে হয় হাতটা কাঁপছে। চা-ও ভালো লাগে না আবার লাগে। জীবন যেমন চলে, পাপও চলে সাথেই।
তবে তারপর থেকে কিছু বদলে যায়।
মাঝরাতে এক অদ্ভুত ঘুম ঘিরে ধরে মুলিকে। সে দেখে তার লরির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ, একই কাপড়, একই মুখ, একফালি হাসি নিয়ে। কখনও তার দরজা খুলে যায় নিজে নিজে। কখনও ব্রেক ধরে না। সে জানে, কিছু একটা আছে, যা রয়ে গেছে।
একদিন লরির আয়নায় হঠাৎ দেখে এক জোড়া চোখ। পেছনে কেউ নেই। তবু চাকা ঘোরে না।
আজও মুলি চালায়। তবে আয়নায় সবসময় খোঁজে কিছু। এক মুখ, এক চোখ, এক ভার।
পাপ যেমন চাপা থাকে, তার একটা ওজন থাকে। সেটা গরিব হোক, চালক হোক, ছোট মানুষ হোকÑ ভুল কখনো ছোট হয় না।
মুলির চাকার নিচে শুধু রাস্তাই থাকে না, থাকে তার অতীত। আর যখনই সে নতুন হেলপারদের শেখায়, চাকা ঘোরাতে দেয়, সে কেবল একটা কথাই বলে।
“যার ওপর দিয়েই যাও, আগে দেখে নিওÑ তোমার নিজের ছায়া পড়ে আছে কিনা।”
বৃদ্ধকে পিষে ফেলার পর প্রথম তিন রাত মুলি ঘুমোতে পারেনি।
চোখ বন্ধ করলেই সে এক দৃশ্য দেখেÑ রাস্তার মাঝে একটি কুঁচকে যাওয়া শরীর পড়ে আছে। তার চারপাশে শুধু পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে, আর লাল রক্তের রেখা আঁকা হয়ে গেছে লরির চাকার পেছনে। আর সেই বৃদ্ধ তাকিয়ে আছেন। কোনো অভিশাপ নয়, কোনো ঘৃণা নয়, বরং এমন এক দৃষ্টি, যেন তিনি কিছু বুঝতেই পারেননি। এই “না বোঝা” টাই মুলিকে গিলে খায়।
সে ভাবে “যদি তিনি চোখে চোখ রেখে কেবল একটা গালি দিতেন, তাহলে সহজ হতো। কিন্তু কিছুই তো বললেন না… এমন কি, মৃত্যুর আগে আমাকে ক্ষমাও করে দিলেন কী? মুলি চেষ্টা করে স্বাভাবিক হতে। চা খায়, হেলপারদের সাথে আড্ডা দেয়, চালায় প্রতিদিনের মতো।কিন্তু তার মধ্যে দুইটা মুলি তৈরি হয়েছে।
একটা লরি চালায়। আরেকটা প্রতিদিন তার ডান কাঁধে বসে কানে কানে ফিসফিস করে বলে “তুই খুনী, মুলি। তোর লরি একদিন তোর দিকেই ফিরবে।”
সে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধদের দেখে না তা যেন ভয়। কখনও গাড়ি চালাতে চালাতে ব্রেক ছাড়তে ভয় পায়, মনে হয়, হঠাৎ যদি আরেকটা বৃদ্ধ চলে আসে?
সে একবার খোঁজ নিয়েছিল বৃদ্ধ’র পরিবারের। জেনেছিল বৃদ্ধ কোরবান ছিলেন নিঃসন্তান। আশেপাশের লোকজন বলেন,
“তাঁর কারো ওপর ভরসা ছিল না। একা থাকতেন, ভিক্ষা করতেন। কিছু ছিল না হারানোর মতো।”
এই কথাগুলো শুনে মুলির কিছুটা স্বস্তি লাগার কথা ছিল। কিন্তু বরং মনে হয়,
“যার কিছু নেই, তার তো আমিই সব ছিলাম। এমন এক লোকের জীবন আমি কেড়ে নিলাম, যার জন্য কেউ কাঁদেওনি।”
একদিন এক মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ভিতরে ইমাম সাহেব বলছিলেন।
“আল্লাহ ক্ষমা করেন, যদি পাপি অনুতপ্ত হও। কিন্তু যার ওপর জুলুম হয়েছে, যদি সে না করে, তবে সেদিন হিসাব হবে।”
মুলির চোখ ফেটে পানি আসে। সে একা বসে থাকে, মসজিদের পেছনে, মাথা নিচু করে।
ভেতর থেকে একটা কান্না আসে। কিন্তু এটা চোখ দিয়ে না, আসে বুক দিয়ে, হাড়ের ভেতর দিয়ে।
তারপর থেকে মুলি বদলে যায়। সে নিয়মিত এক নির্জন জায়গায় যায়। এক পুরনো গাছের নিচে যেখানে বৃদ্ধ’র দেহ পড়ে ছিল। সেখানে একটা ছোট পাথর বসিয়েছে, কোনো নাম লেখা নেই, শুধু একটা ছোট লাল কাপড় বেঁধে রেখেছে শাখায়।
সে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি জানি আপনি কেউ ছিলেন না। কিন্তু আমার জন্য আপনি ছিলেন। আমি জানি আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। কিন্তু আমি প্রতিদিন লরি চালিয়ে আপনার কাছে যাচ্ছি… একদিন আপনিই থামাবেন আমার গাড়ি।”
আজও মুলি লরি চালায়। চালায় তার গন্তব্যের জন্য না, চালায় যেন পাপকে পেছনে ফেলে পালাতে।
আয়নায় সে শুধু রাস্তা দেখে না, দেখে এক মুখ। যে মুখ কিছু বলেনি, তবু সব বলে গেছে। কারণ পাপ যেমন চাপা থাকে, তার একটা ওজন থাকে। আর সেই ওজন চাকার মতো ঘুরে ঘুরে একদিন থেমে যায় ঠিক সেখানেই, যেখানে ক্ষমা শেষ হয়।
মুলির বয়স এখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই। গায়ের আকারটা আগের মতোই সাড়ে তিন ফুট, কিন্তু চোখের নিচে কালি, মুখে দাড়ির ছাঁট নেই, পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে লরি চালাতে চালাতে।
সে এখন আর আগের মত বেপরোয়া গতিতে লরি চালায় না। রাতে কম চলে, দুপুরে থামে বেশি। হেলপাররা ভাবে, “বুড়া হয়ে গেছে।” কিন্তু আসলে, মুলির মধ্যে এখন একটা ধীরে ধীরে পুড়তে থাকা অভিযুক্ত সময় জমে আছে।
প্রতিটা বাঁকে সে এখন দেখে। “এই জায়গাটা সেই নয় তো?” প্রতিটা বৃদ্ধ রিকশায় চড়লে সে খেয়াল করে, পা কাঁপছে কিনা। একবার তো গাড়ি থামিয়ে এক বৃদ্ধকে রাস্তা পার করিয়েছে। হেলপার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কীরে ভাই, কী হলো?” সে কেবল বলে, “বৃদ্ধরা জানে না, কার গাড়ি কত পাপ নিয়ে চলে।
একদিন, হঠাৎ করেই এক ছেলেকে লরি চাপা দেয় মুলি।
নতুন হেলপার তখন স্টিয়ারিং ধরেছিল, কিন্তু মুলিই ছিল তত্ত্বাবধানে। ছেলেটি ছিল মানসিকভাবে অক্ষম। হঠাৎ করে রাস্তা পার হতে গিয়েছিল।
চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। পুলিশ আসে, গ্রামবাসী ঘিরে ধরে। এক বৃদ্ধ লোক বলে,
“এই চালক আগে এক বৃদ্ধকেও মেরেছিল, শুনছি।”
মুলির মুখ তখন পাথরের মতো। সে পালায় না। দাঁড়িয়ে থাকে। এক পুলিশ অফিসার বলে, “তুমি দায়ী না সরাসরি। কিন্তু তোমাকে আটকাব তদন্তের জন্য।” মুলিকে থানায় নেওয়া হয়। থানার একটি ছোট কক্ষে সে বসে থাকে একা। চোখ বন্ধ করলে, আরেকটা কক্ষ মনে পড়ে। লরির ভেতরের কেবিন। চোখ খুললে দেখে, সামনে দেয়ালে টাঙানো একটা আয়না।
নিজের চোখের দিকে তাকায়। মনে পড়ে সেই রাত। বৃদ্ধ’র মুখ। তারপর মনে পড়ে তার বাবার কথা। “মানুষ হবি, গায়ের আকারে না, মনে। মুলি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তিনদিন থানায় থেকে যায়। চতুর্থ দিন সকালে, ছেলেটির মা থানায় আসে। বিপরীত দিক থেকে ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় মুলির সামনে। চোখে পানি নেই। ঠোঁটে শুকনো দাগ।
“শুনছি তুমি খারাপ না। এক বৃদ্ধকেও নাকি একা দাফন করছিলে একসময়। ছেলেটা আমার ছিল না ঠিক করে, আমরাই তাকে পালতাম। এখন নাই। বাকি জীবন তুমিও বোঝা বইবা।” মুলি কিছু বলে না। নারীটি চলে যায়। সেই রাত, ছাড়া পেয়ে মুলি আবার লরি চালায়। কিন্তু এবার গন্তব্য নির্দিষ্ট।
সে সোজা চলে যায় সেই জায়গায়Ñ যেখানে কোরবান বৃদ্ধ’কে পিষেছিল। বছর সাতেক আগের ঘটনা। গাছটা এখনও আছে। আগের কাপড়টা নেই। সে এবার পকেট থেকে এক নতুন কাপড় বের করে। তাতে হাত দিয়ে লেখে। “আমি বুঝি। আপনি চুপ ছিলেন, আমি আর চুপ থাকতে পারি না।”
গাছের শাখায় কাপড় বেঁধে সে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে, মাটি ছুঁয়ে বলে: “আপনি যদি কোথাও থাকেন, একবার শুধু বলেন। চালাতে পারবো কিনা।” কোনো উত্তর আসে না। কিন্তু বাতাসটা হালকা হয়। গাছের পাতাগুলো হালকা নড়ে।
মুলি উঠে দাঁড়ায়। চোখের নিচে ক্লান্তির রেখা, তবু বুকটা হালকা। মুলি আজও লরি চালায়। কিন্তু লরি চালানো এখন তার কাজ না, তার ক্ষমা প্রার্থনার উপায়। প্রতিবার স্টিয়ারিং ধরার আগে সে আয়নায় দেখেÑ নিজের মুখ, নিজের দায়, নিজের পাপ।
তোজাম্মেল আযম
লেখক ও সাংবাদিক