
মেহেরপুর জেলা শহরের আদালতপাড়ায় একাই পাঁচতলা ভবনের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের এক সাবেক জনপ্রতিনিধি মো. একরামুল হক। পেশায় সৌখিন রাজমিস্ত্রি হলেও এলাকাবাসীর চোখে তিনি একজন আদর্শবান মানুষ, সমাজসেবক ও পরিশ্রমী নাগরিক।
বিনা পারিশ্রমিকে নিজের ওয়ার্ডের শতাধিক দুস্থ পরিবারের জন্য পাকা ঘর নির্মাণ করেছেন তিনি। দেশে এটাই প্রথম ঘটনা, যেখানে একজন ব্যক্তি শ্রমিক ও মিস্ত্রি দুয়ের ভূমিকায় একাই বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। প্রতিদিনই অনেকে তার কাজ দেখতে আসছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা একরামুল হক আদালতপাড়ায় নিজের জমিতে নির্মাণ করছেন একটি আধুনিক ভবন। ইতোমধ্যে পঞ্চম তলার ছাদ পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হয়ে সেখানে ভাড়াটিয়াও উঠেছেন। তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলার কাজ এখনও চলমান।
কোনো নির্মাণশ্রমিক ছাড়াই তিনি নিজেই এই ভবনের মিস্ত্রি ও সহকারী। টাইলসের কাজও করছেন নিজ হাতে। একাই সিমেন্ট-বালু মাখানো, মাথায় করে ইট তোলা, সিমেন্ট-বালু দিয়ে ইটের পর ইট গাঁথা সবকিছুই তিনি করছেন একা।
প্রথম দিকে মাটি খোঁড়ার কাজে শ্রমিক নিয়েছিলেন। প্রতিটি ছাদ ঢালাইয়ের দিনও কিছু অতিরিক্ত লোকবল নিয়েছেন নিরাপত্তার জন্য। তবে বাকি সব কাজ নিজেই করছেন এই পরিশ্রমী মানুষটি। তার আশা, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পুরো ভবন নির্মাণ শেষ করবেন।
ব্যক্তিজীবনে একরামুল হক একজন বহুমাত্রিক মানুষ কখনো কৃষক, কখনো নাট্যশিল্পী, আবার কখনো রাজমিস্ত্রি।
১৯৮৮ সালে প্রথমবার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অল্পের জন্য পরাজিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের নির্বাচনে গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হন ইউপি সদস্য হিসেবে। পরবর্তী নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেন।
জনপ্রতিনিধি থাকাকালে নিজ সম্মানী থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩০টি গরিব পরিবারের গৃহকর পরিশোধ করেছেন।
গ্রামের অনেক দুস্থ পরিবার ইট-বালু জোগাড় করতে পারলেও শ্রমিকের মজুরির অভাবে ঘর নির্মাণ করতে পারত না। তখন একরামুল নিজেই মিস্ত্রি হিসেবে একা একা ৯৮টি ঘর নির্মাণ করে দেন বিনা পারিশ্রমিকে। তার হাতে তৈরি সেই ঘরগুলো আজ নিরাপদ আশ্রয় অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের।
সহগল গ্রামের দরিদ্র আছিয়া খাতুন বলেন, গরু-ছাগল বিক্রি করে ঘর নির্মাণের চিন্তা করছিলাম। একরামুল ভাই এসে নিজের হাতে আমার জন্য ঘর তুলে দেন। তিনি কোনো পারিশ্রমিক নেননি।
একই গ্রামের অতিদরিদ্র ওবাইদুল্লাহ আলম বলেন, একবার অগ্নিকাণ্ডে আমার মাটির ঘর পুড়ে যায়। তখন একরামুল মেম্বার নিজে ইট, টিন ও বাঁশ জোগাড় করে বিনা পারিশ্রমিকে ঘর তৈরি করে দেন। গ্রামের অনেকের ঘরই তিনি এমনভাবে নির্মাণ করে দিয়েছেন।
আদালতপাড়ায় প্রতিদিন নিজের ভবনে হাতুড়ি, কাঠ, সিমেন্ট ও বালুর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন এই মানুষটি। সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা, পরিশ্রম ও আন্তরিকতা তাকে এলাকার এক অনন্য অনুপ্রেরণায় পরিণত করেছে।
আদালতপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় একরামুল মাথায় করে ইট তুলছেন পাঁচতলায়।
নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়িতে একমাত্র ছেলে মুদি ব্যবসা করে। আমি বসে থাকতে পারি না। লেখাপড়া ছেড়ে সখের বসে রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছিলাম। পারিশ্রমিক ছাড়াই দুস্থ মানুষের ঘর বানিয়ে দিতে আনন্দ পাই। প্রতিদিন ভোরে মেহেরপুরে এসে নিজের পাঁচতলা ভবনের কাজ করছি।
কাথুলী ইউনিয়নের কাঠ ব্যবসায়ী ওয়াহেদ হোসেন বলেন, একবার স্থানীয় একটি স্কুলে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা দাবি করে পুরস্কারটি একরামুল মেম্বারের হাত থেকেই নিতে চায়। তখন তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, তোমরা মন দিয়ে পড়ো, বড় হয়ে এই গ্রামটাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলো। এখনো তিনি সেই আশায় বেঁচে আছেন।
কাথুলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম বলেন, একরামুল ছিলেন একজন নির্লোভ ও মানবিক জনপ্রতিনিধি। মানুষের বিপদে তিনি পাহাড় হয়ে দাঁড়াতেন। তার ওয়ার্ডে তিনি প্রার্থী হলে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পেত না। তার কাজ ও চরিত্র সত্যিই শ্রদ্ধার যোগ্য।


