মেহেরপুরের উন্নয়ন ভাবনা-২য় পর্ব

৩। মেহেরপুর জেলাবাসীর জীবনের সাথে অতোপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল এবং মা ও শিশু কেন্দ্রটি। হাসপাতালের বয়স আজ ২০/২২ বছর হলো কিন্তু চার গুণ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও চিকিৎসা সেবা বহুধাপ নেমেছে নীচে, যা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

এই হাসপাতালের উপর ভর করে অনেকে বড় বড় নেতা ও সম্পদশালী হয়েছেন এবং হচ্ছেন অথচ হাসপাতালের দুঃসময় তাদের কাছে শুধুই রাজনীতির হাতিয়ার মাত্র। উল্লেখ্য ইতোমাধ্যে নতুন ভবনের কাজ শুরু হয়েছে ।

চরম অবহেলিত এই আধুনিক হাসপাতালকে ২৪ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সেন্ট্রাল এসি, লিফ্ট সিস্টেম করা সহ সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ সেবা পাওয়ার সুনিশ্চিত ব্যবস্থা করা এবং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এন্ড মেডিকেল কলেজে উন্নতিকরণসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

অনুমোদন প্রাপ্ত নার্সিং ইনষ্টিটিউট দ্রুত বাস্তবায়ন, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ডাক্তার বিহীন সেবা চলছে এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলির সেবা নিশ্চিত করাসহ মেহেরপুর শহরসহ ২ উপজেলায় ডায়াবেটিস হাসপাতাল আধুনিক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ। সমৃদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত দেশ প্রেম চেতনায় সৃষ্টিশীল মেধা প্রতিভা ও সততার সর্বোচ্চ সম্মান এবং মূল্যায়ন করতে হবে।

৪। আগামীতে নিশ্চিত পানি যুদ্ধ। এই যুদ্ধের অন্যতম ভয়াবহতা মোকাবেলা করতে হবে মেহেরপুরবাসীকে। সেইদিক বিবেচনা করেই এখন কেবলই স্মৃতি বিজড়িত বাংলার নদী মাতৃক নিশ্চিত প্রবাহকে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ পরিকল্পনাকে কাজে লাগিয়ে মেহেরপুর জেলার প্রাণ ভৈরব, কাজলা ও ছেওটিয়া নদী সহ সকল নদী পরিকল্পিতভাবে গভীর খনন করা এবং পানির দীর্ঘ মেয়াদি চাহিদা সুনিশ্চিত করা। উল্লেখ্য ভৈরব নদী শেখ হাসিনার সরকার অনেকাংশে ইতোমধ্যে খনন করেছে। ভৈরবনদী সহ রক্ষণাবেক্ষণ সংস্কার জেলা পরিষদ পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে ভৈরব কেন্দ্রিক পঞ্চমুখি পর্যটন স্বনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার।

শিক্ষিত যুবক যুবতি নিয়ে সমবায় ভিত্তিক এই স্বনির্ভর প্রকল্প চালু করা। নেট খাঁচা পদ্ধতিতে সমবায় বাণিজ্যিক মাছ চাষ, ২৫ লক্ষ ডিম উৎপাদন ক্যাম্বেল হাঁস ও রাজ হাঁস পালন, মোটা তাজাকরণ প্রকল্পে গরু ও মহিষ পালন, নদীর দুই পাড়ে নার্সারি ও পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ, ওয়াকিং জোন, জিমনেশিয়াম, ঝুলন্ত কারট্যুরিজম এবং পর্যটন তরী নামে ৬টি ১৮ জন পর্যটক বহনকারী স্পিডবোটের মাধ্যমে একটি বহুমুখি ইকোপর্যটন স্বনির্ভর প্রকল্প চালু যা ২০৪১ সালে সমৃদ্ধি অর্জনে একটি মডেল হতে পারে। সেখান থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

জেলার যে সব সরকারী খাল, বিল, খাস জমি আছে তার উন্নয়নে টি.আর, কাবিখার মত প্রকল্প গ্রহণ করে সংষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং আধুনিকভাবে গড়ে তোলা। প্রকৃত মৎসজীবী ও নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের অংশ গ্রহণে অধিকার রক্ষা করা। ভৈরব নদী কেন্দ্রিক সমবায় ভিত্তিক গভীর সেচ প্রকল্প চালু করা। হারিয়ে যাওয়া প্রচুর পুষ্টি, লাভজনক ও চাহিদাযুক্ত বিশ্ব সেরা ব্লাক বেঙ্গল খ্যাত মেহেরপুরের কালো ছাগল ও বলিষ্ঠ গাড়ল (ভেঁড়া) বিদেশে রপ্তানি হবে। একটি বাড়ি একটি খামারের মাধ্যমে ও সমবায় ভিত্তিক বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে। বিসিক সংলগ্ন জাপনী ছাগল পালন ফার্মটিকে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে নতুন ভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা। ভৈরব নদী কেন্দ্রিক সেভ লাইফ নামে মিনারেল ওয়াটার বাজারজাত করণ।

পাটের সোনালী দিন ফিরে আসছে, বিশ্ব ব্যাপী চাহিদাও বাড়ছে। সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিটি গ্রামে পচন প্রক্রিয়া চালু করা যেন পাটের গ্লেজ, আঁশ নষ্ট না হয় তেমনি সরকারীভাবে পাট ক্রয় চালুর আহবান জানায়। নদীর পানি যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। মেহেরপুর পৌরসভাসহ এমন শহরের বিভিন্ন ধরনের দূষিত পানি যেন সরাসরি নদীতে না পড়তে পারে সে ব্যপারে রিফাইনজোন স্থাপনে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ।

নিম্নবর্ণের সংখ্যা লঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করা। ভয়াবহ মরণব্যাধি দুর্নীতি যা উন্নয়নের বড় বাধা, তাই সর্বোক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক চালু করা সহ বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

৫। সেবাই মানবতার শ্রেষ্ঠ কর্ম, যা স্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ চাওয়া। যাদের সেবাতে এ দেশ চলে সেই সব মেহনতি মানুষের আজ সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তা বৈষম্য আর সমন্বয় করেই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন কিন্তু আমরা সেই সমন্বয় বাস্তবায়ন করতে চরমভাবে ব্যর্থ। যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অতিকষ্টে উপার্জিত অর্থ হতে বাংলাদেশের সর্ব উচ্চ থেকে সর্বনিম্ন ব্যক্তির বেতনের ৮০ ভাগ পরিশোধ করা হয় অথচ সেই শ্রমজীবী মানুষ আজ চরম ভাবে অবহেলিত। নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘুচিয়ে সকল ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা। যে কোনো অপচয় রোধ করি এবং সঞ্চয়ী হই, আবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে বিবেচনা করি, কর্মকে সাথী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রীতি, বন্ধন, উন্নয়ন, মানবতার আধুনিক মেহেরপুর গড়ে তুলি। ইতিহাস আমাদের শক্তি, সমৃদ্ধি অর্জনের অনুপ্রেরণা।

৬। সারা বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম আদর্শ সেরা কৃষি অঞ্চল হিসাবে খ্যাত এই মেহেরপুর জেলা। এখানকার উর্বর কৃষি জমি রক্ষা এবং কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ঠিক মূল্য ও আধুনিক কৃষি সেবা পাওয়ার সুব্যবস্থা করা। শস্য ফলজ, তৈলজ, প্রাণীজ ও মৎস এই তিন মিলেই আধুনিক কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। সুস্বাস্থ্য জাতি গঠনে রাসায়নিক সার, বিষ ও ভেজাল খাদ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত এবং জৈব সারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক নিশ্চিত করা।

গাংনী মেহেরপুর জেলার সংসদীয় ২ আসন। ৯টি ইউনিয়ন, একটি উপজেলা, একটি পৌরসভা ও একটি থানা নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। জেলার সার্বিক উন্নয়নে গাংনী উপজেলাকে বিশেষ পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যে গাংনীর চিৎলা কৃষি ফার্ম বাংলাদেশের সেরা একটি বৃহৎ বীজ উৎপাদন সেন্টার।

সময়ের প্রয়োজনেই এই ফার্মটিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি ও জিওগ্রাফী বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্স সেন্টার চালু করা। ইতোমধ্যে সেখানে কৃষি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয় আলোচনায় আসছে। গাংনীর ভাটপাড়া নীলকুঠি প্রায় ১৪০ বিঘা জমির উপর ব্রিটিশ ব্যবহƒত একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখন সরকারী আওতায় এই স্থানটিকে আয় বর্ধক পর্যটন কেন্দ্রীক একটি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা। সেখানে যে পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে তার আধুনিকায়ন করতে হবে। (চলবে)