মেহেরপুরে খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে না অধিকাংশ পরিবার

মেহেরপুরে কর্মহীন হয়ে পড়া অনেকেই পায়নি ত্রাণ সহযোগীতা। জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে ঘুরে ঘুরেও কোন লাভ হয়নি বলে অভিযোগ করেছে অনেকে। এমন কি সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে মুঠোফোনে কল করেও মেলেনি খাদ্য সহায়তা। তালিকাতেও রয়েছে স্বজনপ্রীতি। সেই সাথে কিছু পরিবার একাধিকবার পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে দরিদ্র অসহায় কর্মহীন জনগনের চাল ও নগদ অর্থ বিতরণের লক্ষে মেহেরপুর জেলায় ৯৪১ মেট্রিক টন চাল, ২৭লাখ ৭৫ হাজার নগদ অর্থ এবং শিশু খাদ্যের জন্য নগদ ৫লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

এর মধ্যে গতকাল ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৩০ হাজর ৩৯৭ পরিবারের মধ্যে ৪১৬ মেট্রিক টন চাল, ১২ হাজার ৮শ পরিবারের মাঝে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫শ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত শিশু খাদ্যের অনুকুলে কোন টাকা বিতরণ করা হয়নি।

এদিকে সরকারি খাদ্য সহায়তা হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ, স্থানীয় সংসদ সদস্যর খাদ্য সহায়তা, জেলা পরিষদের খাদ্য সহায়তা, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক ভাবে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করায় অনেক পরিবার এ সুবিধা না পেলেও কিছু পরিবার রয়েছে যারা একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ সহায়তা পেয়েছেন। ফলে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া, কুতুবপুর, শোলমারী, শুভরাজপুর, তেরঘরিয়া আশ্রয়ন, বুড়িপোতা, নবিনগর খাল পাড়া, যাদবপুর, রাজাপুর, রাধাকান্তপুর, বন্দর, বামনপাড়া, সুবিদপুর, সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে সঠিকভাবে পৌছাইনি ত্রাণ সুবিধা। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সরকারি ত্রাণ সামগ্রী এসেছে বলে জানিয়েছে জনপ্রতিনিধিরা।

সেই সাথে মেহেরপুর পৌর এলাকাতেও ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সজনপ্রীতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে কর্মহীন অনেক মানুষ। আবার অনেকেই বলছে ভোটার আইডি নিয়েছে অনেক আগেই কিন্তু কোন খোঁজ নেই।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সারা বংলাদেশে চলছে অঘোষিত লক ডাউন। এরই ধারাবাহিকতায় মেহেরপুরেও গত ২৪ মার্চ চলছে লক ডাউন। সেই সাথে সবাইকে ঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে ও সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখতে ইতিমধ্যে মাঠ নেমেছে সেনাবাহিনী।

এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অনেকেই। নিম্ন ও মধ্য বিত্তদের দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে এই সব কর্মহীন মানুষদের খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হলেও খাদ্য না পেয়ে হতাশায় পড়েছে অনেকে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের শুকুর আলী, লালন, রেশিয়া, সিদ্দীক, বাহাদুর, হাফেজ জানান, আজ প্রায় ২১ দিন হতে চললো কোন কাজ নাই। যে গুলো বাড়তি ছিল তাও শেষ। এখনো পর্যন্ত কোন ধরণের সরকারি সুবিধা পাইনি।

কুতুবপুর ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া গ্রামের ইউপি সদস্য ঘেন্টু জানান, আমাদের গ্রামে এ পর্যন্ত আমার হাতে ২৫টি ত্রাণের বস্তা এসেছে। কিন্তু চাহিদা অনেক আছে এই সিমিত ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে কিভাবে চাহিদা মেটাবো।

নিশ্চিন্তপুরের প্রায় ৫০টি পরিবার তাকিয়ে আছে সরকারি সহযোগীতার দিকে। এ নিয়ে আগেও সংবাদ প্রকাশ হয় কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। আজও তাদের মাঝে পৌছানি ত্রাণ সামগ্রী। এই গ্রামের সাহারুল নামের একজন জানান আমি ত্রাণেন জন্য উপজেলা পর্যায়ে এক কর্মকর্তার সাথে মোবাইলে কথা বলেছিলাম উনি বলেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করতে।

তেরঘরিয়া আশ্রয়ন কেন্দ্রে প্রায় শতাধীক পরিবারের বাস। এদের মধ্যে কেউ কেউ কৃষি কাজ করে আবার কেউ ছোট খাট ব্যবসা করে। এখানে এখনো পর্যন্ত পৌছাইনি কোন ত্রাণ সুবিধা। সেই সাথে করোনা সচেতনতায় প্রশাসনের এখানে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
শোলমারী গ্রামে প্রায় হাজার পাঁচেক ভোটার। বেশির ভাগই মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। এই কৃষি ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অনেকেই।

বুড়িপোতা গ্রামের ফয়েজ আলী, আদু মিয়া, আশুরা খাতুন, বুলু খাতুন, তোফাজ্জেল ইসলাম, ফুলজান খাতুন, বাবলুু, জাবলু, খোদেজান, ছোটবুড়ি খাতুন, চমপা খাতুন, হাওয়া খাতুন, সাত্তার আলী, হোসেন আলী জানান, মেহেরপুর লক ডাউন হওয়ার পর থেকেই কর্মহীন । নতুন করে আয় রোজগারের কোন উৎস নেই। অথচ ত্রাণের তালিকাতে তাদের কোন নাম নেই।

সদর উপজেলার রাজাপুর গ্রামের ইউপি সদস্য ওয়াসিম জানান, সরকারি ত্রাণ সুবিধা থেকে আমাদের গ্রামের অনেকেই এখনো বঞ্চিত। গ্রামের চায়ের দোকানদার থেকে শুরু করে অনেক কর্মহীন মানুষ এখনো পর্যন্ত পাইনি ত্রাণ সুবিধা। এদের মধ্যে আছে কাউছার আলী, জুল্লু, মশিউর, আশরাফ, আরিফুল ইসলাম হুড়ু, আব্দুর রহমান, সুজন টন্টের ঘাট, পাচ রাস্তার মোড়ের মিজার, উত্তর পাড়ার খোকন, মজিদ, আফসার আলী, হামিদুল ইসলাম ভুবন, ইদু মিয়া, দুখু মিয়া, দুবির, সাইরুল, হাফিজুল, বারাকপুরের খোকন জানান, আমাদের সংসার চলে চায়ের কাপে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দোকানপাট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় ইনকাম না থাকায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছি। এখনো পর্যন্ত কোন ত্রাণ সুবিধা আমরা পাইনি।

সদর উপজেলার বন্দর গ্রামের রিক্সা চালক হাশেম আলী, কালু, জামাল শেখ, শুকুর আলী, কলা ব্যবসায়ী মনি, স্বামী হারা টুনা খাতুন, নজরুল ইসলাম, আরতী খাতুন। বামনপাড়ার রিভামদ্দি, কুদরত, দোকান কর্মচারি শাহাবুদ্দিন, কলিমদ্দিন, আবু তাহের, সেলুন দোকানি এরশাদ জানান, আমাদের দিন কাটছে অনাহারে কখনো অর্ধাহারে। আমরা কোন সরকারি বা বেসরকারি কোনভাবেই ত্রাণ সুবিধা পাইনি। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।

মেহেরপুর শহরের নতুন পাড়ার বাসিন্দা সুফিয়ান বলেন, ৪ নং ওয়ার্ডের নতুনপাড়া ও মাঠপাড়াতে ৬শ পরিবার এদের মধ্যে ৫শ পরিবার দারিদ্র সীমার নিচে। এর মধ্যে ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ১৫-২০টি পরিবার।

এছাড়াও নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক মেহেরপুর শহরের বেশ কয়েকজন রিক্সা চালক জানান, আমাদের সমিতি ভোটার আইডি নিয়েছে অনেক আগেই। অনেক চালক ইতিমধ্যে ত্রাণ সুবিধা পেয়েছে কিন্তু আমরা পাইনি। বাধ্য হয়ে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হলেও পুলিশের ভয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে।

এদিকে গত ১২ এপ্রিল ‘মেহেরপুর প্রতিদিন’ এ “মেহেরপুরে ২৩ হাজার পরিবার পেয়েছে ত্রাণ সামগ্রী” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর সেখানে সাধারণ মানুষের রয়েছে ভিন্ন মতামত। এদের মধ্যে রাফসান সানি নামের একজন লিখেছেন, পেয়েছে কম বেশি কিন্তু স্বজনপ্রীতি হয়েছে। প্রকৃত দরিদ্রদের তালিকা সঠিকভাবে করা উচিত ছিল।

এইচ এম সাহেব নামে আইডি থেকে লিখেছেন, অফিসিয়ালি দেওয়া হয়েছে কিন্তু ন্যাচারালি একটু ভিন্ন ছিলো। ইএস ইমন নামের আইডি থেকে লিখেছে, শুনেন স্যার ২৩ হাজার ত্রাণ আপনার খাতায় থাকতে পারে মানুষের বাড়িতে না। খোজ নিন আপনার ২৩ হাজার ত্রাণ কোথাই গেলো মানুষের ঘরে না চোরের ঘরে।

রুহুল আমিন রুহুল লিখেছেন, চাউল বিতরণের নামে দলবাজি চলছে। সৌদি প্রবাসী আইডি থেকে লিখেছেন কোথায় কোথায় গেলো বুঝলাম না।
চাঁদবিল গ্রামের হাবিবুল্লাহ লিখেছেন, আমাদের আমঝুপি ইউনিয়নের চাঁদবিল গ্রামে এসে দেখে জান কতজন ত্রাণ পেয়েছে, আমার জানামতে যে কয়জন পেয়েছে তারা পাওয়ার উপযোগী নই। নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে ব্যস্ত। গ্রামের গরিব অসহায় লোকজন পেলো কিনা সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়।

রফিকুল ইসলাম পথিক লিখেছেন, আওয়ামীলীগ দেখে তালিকা হয়েছে, ভিন্ন মতের মানুষ পাইনি বললেই চলে।

আরিফুর রহমান লিখেছেন, ২৩ হাজার আইডি কার্ড নিয়ে সরকারি ত্রাণ বৈধ করা হয়েছে। আরে ভাই কাগজ কলম ঠিক তো সব ঠিক।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদুল আলম মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, যে পরিমান বরাদ্ধ এসেছে তাতে আমরা সকল নিম্ম আয়ের মানুষকে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আপনারা জানেন বেশ কিছুদিন ধরে মেহেরপুর সদরসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খাদ্য সামগ্রী বিরতণ করা হচ্ছে।

আজকেও যারা টাইলস মিস্ত্রি আছেন তাদের ১৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। গ্রামের অনেকেরই অভিযোগ প্রকৃত মানুষের কাছে ত্রাণ যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তালিকাতে এমন হতে পারে। এছাড়াও যারা পাইনি তারা পর্যায়ক্রমে পাবে।