মেহেরপুরে গ্রামীণ নারী শ্রমিকরা শ্রমের সঠিক পারিশ্রমিক বঞ্চিত

মেহেরপুরে গ্রামীণ নারী শ্রমিকরা শ্রমের সঠিক পারিশ্রমিক বঞ্চিত

নারী দিবস আসার আগেই দেশজুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে। স্লোগান, পোস্টার, ফ্যাসন হাউসও ম্যাল্টি ন্যাশনালের ছাড়ের ছড়াছড়ি চলে। রেডিও টিভিতে বিজ্ঞাপনের বাহার। নারী তুমি প্রেরণা। নারী তুমি অজেয়। নারী তুমি সেরা। নারী দিবসের আগেই নারী আহামরি। নারীর অবস্থানকে আলোকিত করতে অজস্র কর্মশালা। অভিযান, চায়ের আড্ডায় তর্ক। খুব খুব পেরেছি আমরা। নারীরা সমাজের বড় জায়গায় পৌঁছেছে। নারীর দু‘চারটি সফলতার গল্প বাদে গ্রাম গঞ্জের লাখ নারী কী পেল? কয়জন ন্যায্য মুজুরি পায়? এসব কথা নারী দিবসে বলা হয় না। এবারতো বড়ই নিরবে চলে গেল নারী দিবস।ছুটির দিন বলে কী? কীন্তু কেন? সরকারি দিবস হলেতো ছুটির দিনেও কারো ছুটি থাকেনা। প্রয়োজনে স্কুল কলেজ থেকে বাধ্যতা মূলক শিক্ষার্থী ধরে এনে সমাবেশ করে দিনটি পালিত হয়।

মেহেরপুরের গ্রামের নারীরাও সর্ব শক্তি দিয়ে পুুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন রাত দিন। বাসা-বাড়িতে, মাঠে- ঘাটে ও কৃষি জমিসহ সর্বত্র। পার্থক্য- শহরের নারীরা কিছুটা আত্মমর্যাদা ও সম্মান পেলেও গ্রামবাংলার নারীরা আজো অবহেলিত বিভিন্নভাবে। গ্রামীণ শ্রমজীবী নারীরা শহরের বাসা-বাড়িতে কঠোর পরিশ্রম করেন। সে কাজের কোন স্বীকৃতি তো মেলেই না, পান না তেমন মজুরীও। গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের ইতিহাস এক অবিচ্ছেদ্য আলোক বিহীন রাতের গল্প। কৃষিতে এবং বাসাবাড়ীতে নারীর ভূমিকা এবং অবদান বর্ণনাতীত। যদিও কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় নারী শ্রমিকরা শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন পুরুষ শ্রমিক ও মালিকদের কাছে।

স্বাধীনতাপূর্ব মেহেরপুরের মেয়েদের বাড়ির বাইরে পর্দাবাদে বের হলে সামাজিকভাবে বিচারের মুখোমুখি হতে হতো। সেই মেহেরপুর জেলার নারীরা ঘরের গন্ডি থেকে বেরিয়ে জমিতে ধান চাষ, হাতে হাতুড়ি, মাথায় ঝুঁড়ি, কাঁখে কলসী নিয়ে অভাব অনটন ক্ষুধা আর দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে চলেছেন। ইট-পাথর ভাঙ্গা, মাটি কাটা, সিমেন্ট বালু মিশ্রন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও চা-মিষ্টির দোকানে পানি টানার মতন কঠিন পরিশ্রম করেও ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব নারী শ্রমজীবীরা। নারী শ্রমজীবীদের কাজের ঘণত্বর কারণে পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে নারী শ্রমিকের কদর অনেক বেশী। তারপরেও বৈষম্য থেকে শ্রমজীবী নারীরা হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরও ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মেহেরপুর জেলার ২০টি ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষিকাজে জড়িত রয়েছে ১০সহস্রাধিক নারীশ্রমজীবী। প্রতিদিন ৪শ টাকা মুজুরিতে ৩হাজার ৭শ জন নারী শ্রমিক গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে শ্রম বিকাচ্ছেন।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নে দেখা মেলে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে কর্মরত একদল নারী শ্রমিকের। তাদের সেনাপতি সেফালী খাতুন জানান- তাদেরকে প্রতিদিন ৪শ টাকার বিনিময়ে কাজ করিয়ে নেয়া হয়। বর্ষা বাদলের সময়েও তাদের কাজ থাকে বলে তারা এই কাজ করতে বাধ্য হন। বয়সের সাথে অপুষ্টির শিকার নারি শ্রমজীবী রুবিনা খাতুন (৬৩) জানান. শরীরে শক্তি না থাকার কারণে তাকে কেউ কাজে নেয় না। মেম্বার চেয়ারম্যানদের ধরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ পেয়েছেন।

এই ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমজীবী রাহেলা খাতুন জানান- কিছুদিন আগেও তাদের প্রতিদিনের মুজুরি ছিলো ১শ টাকা। চলতিবছর থেকে প্রতিদিনের মুজুরি হয়েছে ৪শ টাকা। এখন ৪০ দিন পর তাদের বিকাশ কিম্বা রকেটে ৪০ দিনের মুজুরি চলে আসে। তিনি অভিযোগ করেন- বর্তমান সময়ে এই ৪শ টাকাও অনেক কম মুজুরি। জেলায় ইমারত নির্মাণ কাজে শ্রমজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। পুরুষ শ্রমিকদের মুজুরি ৬শ টাকা হলেও তাদের দেয়া হয় ৪৫০ টাকা করে। জমি থেকে মরিচ সংগ্রহ, কচু ও আলু তোলাসহ মাঠের শ্রমজীবী নারীর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়না। ধারণা করা হচ্ছে অন্তত ৩ হাজার হবে এই শ্রমজীবী। কৃষিকাজে একজন পুরুষ শ্রমিকের মুজুরি ৬শ টাকা হলেও নারী শ্রমিকের মুজুরি ৪শ টাকা। কারণ হিসেবে পুরুষ শ্রমিকরা জানায় ‘নারীরা ১শ কেজির কচুর বস্তা মাথায় নিয়ে পরিবহনে তুলতে পারেনা বলেও তাদের মুজুরি কম’।

সমাজকর্মি মাহবুবুল হক মন্টু জানান- আগের চেয়ে গ্রামীণ নারী শ্রমজীবীদের মধ্যে বহুগুনে সচেতনতা বেড়েছে। তাই সময় এসেছে বৈষম্যহীন নারী সমাজ প্রতিষ্ঠার। পুষ্টিতে তুষ্টিতে যুক্তিতে নারীর পাওনা অধিকারকে সমানভাবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী সুনিশ্চিত করতে হবে; নারীকেই শিক্ষা প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো দক্ষ করে তুলতে হবে। নারী বলে কোনো রকম বৈষম্য অবহেলা করা চলবে না।

জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নাহিদা ইসলাম খাতুন জানিয়েছেন নারীরা বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ নিয়ে আয়বর্ধণের পথ সুগম করেছেনÑ বর্তমানে নারীদের কষ্টগাঁথা ইতিহাস কেবলী আর্তনাদ আর অমানবিকতায় ভরা বলা যাবেনা। জেলার প্রায় সাত হাজার দুস্থ নারী ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পে প্রতিদিন ৪শ টাকার বিনিময়ে গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছেন।

নারীরা যতদিন পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারনায় চালিত হবে, দ্বিচারিতা যতদিন না দুর হবে, ততদিন নারীর অধিকার ড্রয়িংরুমের গল্পগুজবের চেয়ে বিশী এগোবে না।