পঁচাত্তর বছরেরও আগে, মেহেরপুরের গ্রামের মাঠে, কলার খুঁটির ছায়ায় গড়া হত দুর্গামণ্ডপ। প্রতিমা তখন মাটির নয়নজুড়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বিশ্বাসের দীপ্তি ছিল অপার। ধানের খেত থেকে ফিরে আসা কৃষকেরা যেমন হাতে মাটির ঢেলা নিয়ে দেবীর সামনে দাঁড়াতেন, তেমনি সন্ধ্যার আলোয় গ্রামের শিশুরা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকত রঙিন কাগজের ঝালর আর মাটির প্রদীপে।
কালের পরিক্রমায়, সেই মণ্ডপে এখন উঠে এসেছে থার্মোকল-তুলির বাহার, বৈদ্যুতিক আলো আর ডিজিটাল ঢাকের শব্দ। তবে, রয়ে গেছে একটি অদৃশ্য সুতো যা ধর্মকে ছাপিয়ে মানুষে মানুষে মিলনের উৎসবে পরিণত করেছে দুর্গাপূজাকে।
চলতি বছর, মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় (সদর, গাংনী ও মুজিবনগর) মিলিয়ে ৪৩টি দুর্গাপূজার মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। মণ্ডপগুলোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে কোথাও রঙতুলির শেষ আঁচড়, কোথাও লাইটিংয়ের পরীক্ষামূলক চালনা।
শহর থেকে গ্রাম সবখানেই যেন দেবী পূজাকে ঘিরে ছুটে চলেছে উৎসবের বাতাস। হালদারপাড়া, ভবেরপাড়া, আনন্দবাস, দারিয়াপুর, ভবানীপুর প্রতিটি জায়গাতেই আলাদা আবহ, আলাদা আয়োজন। তবে এক জায়গায় সবার মিল, ভক্তি আর সম্প্রীতির মেলবন্ধন।
পূজাকে ঘিরে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে জোরদার পদক্ষেপ। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা কমিটির বিশেষ সভা, যাতে অংশ নিয়েছেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তারা, পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। সভায় নিশ্চিত করা হয় প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তা দিতে থাকবে আনসার সদস্য, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিজিবির সহায়তা। যা ইতোমধ্যে গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে।
স্থানীয় রাজনীতিকদের মধ্যে বেশ ক’জন ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মণ্ডপ পরিদর্শন করেছেন। মণ্ডপ উদ্বোধন, দান বা শুভেচ্ছা জানানোর ঘটনা একাধিক। যদিও সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অর্থায়নের তথ্য মেলেনি, তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহানুভূতি ও উপস্থিতি সমাজে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। এবারই প্রথম পূজোর একটি উল্লেখযোগ্য দিক রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে একযোগে অংশগ্রহণ।
জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব অশোক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, দলের চেয়ে বড় উৎসব, ধর্মের চেয়ে বড় মিলন। এখানে আসলে সবাই এক, আমরা শুধু দেবী দুর্গার আশীর্বাদ চাই সব মানুষের মঙ্গল হোক। তবে, আশার পাশে ছিলো কিছু চ্যালেঞ্জও। শহর এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও অতিরিক্ত ভিড় সামলানো এক সমস্যা, আবার গ্রামাঞ্চলে রয়েছে প্রতিমা পরিবহন ও বাজেট সংকট। যা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সব ধরণের সহায়তা করছে।
মেহেরপুর জেলা কালি মন্দিরের পুরোহিত তপন বন্দোপাধ্যায় বলেন পূজা মানে শুধু ধর্ম নয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর সামাজিক বন্ধন। যত দিন যাচ্ছে, ততই অর্থসঙ্কটে পূজার মহিমা হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যদিও এবার সে সমস্যা নাই। প্রতিমার চোখে এখনো দেখা যায় এক ধরনের শান্ত বিশ্বাস যেন সব কিছুর পরেও, মানবতা ও শুভবোধের জয় হবেই। ঢাকের তালে তালে, সিঁদুরের উজ্জ্বলতায়, সন্ধ্যার আরতিতে, আজও জেগে থাকে সেই চিরচেনা মেহেরপুর যেখানে উৎসব মানেই একসঙ্গে থাকা, ভেদাভেদের দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া।
গৃহবধূ পল্লবী সাহা বলছেন, পুজো মানেই নতুন শাড়ি, সিঁদুর, মিষ্টি, আর নতুন আলপনার ছোঁয়া। সন্তানদের খুশি করতেই এখন একটু হিসেব করে চলতে হয়। তবুও উৎসব থেমে থাকে না। কারণ পুজো তো শুধু কেনাকাটা নয়, এ এক আবেগ, এক ঐতিহ্য।
মেহেরপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনজুর আহমেদ সিদ্দিকী জানিয়েছেন প্রতিটি মণ্ডপে থাকবে পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক। ট্রাফিক ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। এছাড়াও মণ্ডপে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে যানজট নিরসনে কাজ করছে অতিরিক্ত ফোর্স।
জেলা প্রশাসক মো. আবদুল সালাম বলেন, উৎসব যেন নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। দেবীর দশভুজায় যেন স্থান পায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যেন তাঁর অস্ত্র শুধু মহিষাসুর নয় বিভেদের কালো ছায়াকেও নির্মূল করে এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।