মেহেরপুরে প্রবাসীর স্ত্রীকে ফেন‌সি‌ডিল দিয়ে ফাঁসানো ও টাকা নিয়েও না ছাড়ার অ‌ভিযোগ তিন পু‌লি‌শ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে

অন্যে’র জমির উপরের একটি বিচালীর স্তুপের নিচ থেকে ফেনসিডিল উদ্ধার করে প্রবাসীর স্ত্রী হাদিছা খাতুনকে আটক করে মামলায় ফাঁসিয়েছে পুলিশ এমন অভিযোগ প্রবাসীর পরিবার ও প্রতিবেশীদের। শুধু তাই নয়, ছেড়ে দেওয়ার নাম করে ৬০ হাজার টাকাও নিয়েছে, কিন্তু না ছেড়ে মামলা দিয়ে চালান করা হয়েছে।

এসকল অভিযোগ করা হয়েছে অভিযানে যাওয়া সদর থানা পুলিশের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন- এরা হলেন, মেহেরপুর সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অরুক কুমার, এসআই সঞ্জীব কুমার পাল ও এএসআই ইব্রাহিম।

এদিকে হাদিছার বাড়ির সামনে থেকে বিচালীর পালা থেকে ফেনসিডিল উদ্ধার অভিযান চালানোর সময় স্থানীয় এক যুবক মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। সে ভিডিও ফুটেজ পত্রিকা অফিসে পৌঁছালে মেহেরপুর প্রতিদিনের একটি টিম ঘটনাটি অনুসন্ধান শুরু করে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, পুলিশের আভিযানিক দলটি বিচালীর পালার পাশ থেকে ফেনসিডিলগুলো নিয়ে গিয়ে হাদিছার ঘরের সামনে জড়ো করেন। পরে তাকে ডাক দিলে সে ঘুম থেকে উঠে আসেন। এসময় এক এসআই ভিডিও ধারণকারী ওই যুবককে বলতে শোনা যাচ্ছে ভালো করে ভিডিও করো। আমাদেরও ওই ভিডিওি দিবা।

সোমবার (৮ আগষ্ট) বিকালে মেহেরপুর প্রতিদিনের ওই টিমটি দক্ষিণ শালিকা গ্রামে সরেজমিনে গেলে প্রত্যক্ষদর্শিরা এভাবেই অভিযোগ করেন পুলিশের ওই টিমের বিরুদ্ধে।

এঘটনার পর এএসআই ইব্রাহিম আটক হাদিছার প্রতিবেশীদের কাছে কয়েক দফা গিয়ে বিভিন্ন লোকজনকে হুমকিও দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে কেউ যেনো মুখ না খোলে এজন্য তিনি এলাকার মানুষের মাঝে এক অজানা ভীতি তৈরী করেছেন।
ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনার বর্ণনা দেন প্রবাস ফেরৎ প্রতিবেশী নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, পুলিশের ওই দলটি হাদিছার বাড়ির সামনে জনৈক ইস্রাইল হোসেনের বিচালীর পালার নিচ থেকে ফেনসিডিলগুলো উদ্ধার করে ওই মহিলাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। এরপরই তারা হাদিছাকে গ্রেফতার করে।

একই গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, হাদিছার ভাই আনারুল খারাপ মানুষ এটা সবাই জানে। কিন্তু তার বোন হাদিছা খাতুন কোনো ধরণের খারাপ কোনো কাজ বা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত নন। পুলিশের দল প্রকাশ্যে সবার সামনে বিচালীর পালা থেকে ফেনসিডিল উদ্ধার করে হাদিছা খাতুনকে ঘুম থেকে তুলে গ্রেফতার দেখালো। এটা খুব অন্যায় করেছে পুলিশ।

প্রতিবেশী বারেক আলী ও রোজিফা খাতুন বলেন, এএসআই ইব্রাহিম প্রায় তিন চারদিন ধরে এখানে আসছেন। তারা বলেন পুলিশের কাজ তো মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো না। যেখানে ফেনসিডিল পাওয়া গেছে সেটা তো হাদিছার জমি না। এটা ইসরাইল ও জাহাঙ্গীর হোসেনদের জমি। পুলিশ ফেনসিডিলগুলো উদ্ধার করলো বিচালীর পালা থেকে অথচ মামলায় উল্লেখ করলো একজন নিরীহ মানুষের বাড়িতে। বিষয়টি পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন তারা।

প্রতিবেশী হাসিনা খাতুন বলেন, হাদিছাকে ফাঁসানোর পর ইব্রাহিম দারোগা আবারো এলাকায় এসে হুমকী ধামকী দিয়েছে। সে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে নানাভাবে জিজ্ঞাসা করেছে তার বাবা কোথায় ? তার বাবা কিভাবে টাইলসের বিল্ডিং বানিয়েছে। এই ঘরে বসবাস করা বের করবে বলেও হুমকী দেই সে। তার হুমকির প্রতিবাদ করাই সে আমাকেও গ্রেফতার করবে বলে হুমকি দেই।

তিনি আরো বলেন, হাদিছাকে ছেড়ে দেওয়ার নাম করে ২ লাখ টাকা দাবী করেন তারা। পরে ইব্রাহিমের হাতে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমি ও বারেক আলী মিলে টাকা দিয়েছি।

প্রতিবেশী সবেদা খাতুন, সিমা খাতুন সুর্মিলা খাতুন বলেন, এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের না ধরে একজন নিরীহ নারীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে পুলিশ। আমাদের চোখের সামনে হাদিছার বাড়ির সামনের বিচালীর পালা থেকে ফেনসিডিল উদ্ধার করলেও পুলিশ সেটি হাদিছার ঘর থেকে উদ্ধার করেছে বলে মামলায় উল্লেখ করাই ওই তিন দারোগার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

তবে, হাদিছার মা খোদেজা খাতুন বলেন, আমার ছেলে আনারুল খারাপ মানুষ। তার ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। কিন্তু আমার মেয়েকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমি তাদের বিচার চাই।

রোজিফা নামের স্থানীয় এক নারী বলেন, এলাকার মানুষ কিভাবে পাকা ঘর বানিয়েছেন সেই হিসাব নেই ইব্রাহিম দারোগা। এই এলাকার মানুষ কি ওই দারোগার ভাত খেয়ে ঘর বানাচ্ছে ?

হাদিছা খাতুনের মেয়ে পাপিয়া খাতুন বলেন, আমার মা কে কোনদিন কোন অন্যায় করতে দেখি নি। ষড়যন্ত্র করে আমার মাকে ফাঁসানো হয়েছে। এর ফলে ফলে আমার মা ও আমার সংসার ভাঙার পথে। আমার একমাত্র ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়ার পথে। এর দায় কে নেবে? আমরা ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।

অভিযুক্ত এএসআই ইব্রাহিম বলেন, হাদিছার ভাই আনারুল ইসলাম একজন মাদক ব্যবসায়ী। হাদিছার বাড়িতে মাদক মজুদ রেখে ব্যবসা করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিত্বে তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বাড়ির ছাদ ও শিড়ির নিচে থেকে ১৬০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করি। এসময় আনারুল ইসলামসহ দুই জন পালিয়ে যায়। হাদিছার বাড়ি থেকে ফেনসিডিলগুলো উদ্ধার হওয়ার কারনেই তাকে আটক করা হয়েছে। তাকে আটক করে কি ভুল করেছি আমরা বলে সাংবাদিকদের উল্টো প্রশ্ন করেন। তবে, ৬০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ ও প্রতিবেশীদের হুমকী দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

অপর অভিযুক্ত উপপরিদর্শক (এসআই) সঞ্জীব কুমার পাল বলেন, আমরা সুনিদৃষ্ট তথ্য নিয়েই অভিযানে গেছি। হাদিছার বাড়ির শিড়ির নিচ থেকে ফেনসিডিলগুলো পাওয়ায় তাকে আটক করা হয়েছে।

মেহেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, হাদিছার নামে আগের কোনো মামলা নেই। তার বাড়িতেই ফেনসিডিলগুলো জব্দ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্ত করে বিষয়টি প্রকৃত অবস্থা বলা যাবে।

তবে এ ব্যাপারে মেহেরপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি সুষ্ঠ তদন্ত করা হবে। যদি পুলিশ কর্মকর্তারা দোষী হয়ে থাকেন তাহলে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার শনিবার দিবাগত রাতে মেহেরপুর সদর থানার উপরিদর্শক (এসআই) অরুক কুমার, এসআই সঞ্জীব কুমার, এএসআই ইব্রাহীমসহ সঙ্গীয় ফোর্স সদর উপজেলার দক্ষিণ শালিকা গ্রামে অভিযান চালিয়ে প্রবাসী আনিছুর রহমানের বাড়ি সামনে থেকে ১৬০ বোতল ফেনসিডিলসহ হাদিছা খাতুনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেন।