
মেহেরপুর সীমান্ত পেরিয়ে আসা মাদকের বস্তা টানছেন নারীরা। কেউ খুচরা বিক্রি করছেন পাড়ায় পাড়ায়, কেউবা দেহে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শহর বা অন্য জেলায়। গেল ছয় মাসে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২০২৫) শুধু মেহেরপুর জেলাতেই ৩১ জন নারী মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক বহনের শ্রমিক হিসেবে আটক হয়েছেন। পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ পৃথক ও সম্মিলিত অভিযানে তাদের আটক করে।
তাদের মধ্যে কেউ প্রথমবার নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো ধরা পড়েছেন। কারো বয়স ২২, কেউ ৪০ এর কোটায়। বেশির ভাগই স্থানীয়, দরিদ্র এবং স্বশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত। অধিকাংশ নারীই জড়িত মাদকের খুচরা বিক্রিতে বা মাদক বহনে শ্রমিক হিসেবে। হেরোইন, গাঁজা, বিদেশী মদ. ফেন্সিডিল পৌঁছে দেয়া ও খুচরা ব্যবসার সাথে জড়িত আটক নারীরা।
জেলার গাংনী উপজেলার কাজিপুর, তেকালা, বামুন্দি, মেহেরপুর সদরের শালিকা, বাজিতপুর ও মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর সীমান্ত এখন মাদক পাচারের নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারত থেকে নিয়মিতভাবে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য আসছে এই সীমান্ত দিয়ে। এসব মাদক সংগ্রহ করে স্থানীয় পর্যায়ে খুচরা বিক্রির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে একটি চক্র। এই চক্রই বেশি আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র নারীদের নিয়োগ করছে বাহক বা বিক্রেতা হিসেবে।
মেহেরপুর সদরের একটি গ্রামে বসবাসকারী এক নারী, যিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন, দ্বিতীয়বারের মতো আটক হয়েছেন গত আগস্টে। পুলিশের ভাষ্য মতে, তিনি প্রতি সপ্তাহে দু’বার করে সীমান্ত থেকে মাদক সংগ্রহ করে শহরে পৌঁছে দিতেন। প্রতিবার কাজে তিনি পেতেন ১২শ থেকে ১৫শ টাকা।
স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেহেরপুর অঞ্চলে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ অপ্রতুল। দিনমজুর বা গৃহকর্মীর কাজের বাইরে বিকল্প নেই বললেই চলে। যদিও কাজ মেলে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারীরা পান কম মজুরি।
স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এই চক্রের নিয়ন্ত্রকেরা বেশির ভাগ সময় রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। নারী বাহকদের ধরে হয়তো মামলা হয়, কিন্তু মূল নিয়ন্ত্রকদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ যথাযথ নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মেহেরপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক বিদ্যুৎ বিহারী নাথের বয়ানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পারিবারিক সহিংসতা ও সহজে অর্থ আয়ের আকাঙ্ক্ষা এই চারটি মূল কারণ নারীদের এই পথে ঠেলে দিচ্ছে। অধিকাংশ নারীই জানেন না, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে খুচরা মাদক বিক্রেতাদের সকল নারীই অর্থের লোভে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। বেশ কয়েকজন স্বামী স্ত্রী মাদক বিক্রেতার সাথে জড়িত। এদেরমধ্যে জেলা শহরের পেয়াদা পাড়ার চায়না খাতুন ও তার স্বামী হাফিজুল ইসলামকে বেশ কয়েকবার মাদকসহ আটক করা হয়েছে।
মেহেরপুরের মানবাধিকার কর্মী দিলারা পারভিন বলেন, মাদক ব্যবসায় জড়িত নারীরা অপরাধী তো বটেই, কিন্তু এক অর্থে তারা ব্যবহৃতও। প্রশ্ন হলো, তাদের এই অবস্থান সৃষ্টি হওয়ার পেছনে দায়ী কারা? নারীদের বিকল্প জীবিকা গড়ে তোলা জরুরি। মাদক সংক্রান্ত মামলায় নারীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র ও বিশেষায়িত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
মেহেরপুরের অতিরিক্ত পলিশ সুপার জামিনুর রহমান খান বলেন, বংশ পরম্পরা মেহেরপুুরের সীমান্ত গ্রামগুলোর পরিবার দারিদ্রতার সাথে বসবাস করে। গত ছয়মাসে বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্যসহ ৩১ জন নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি বড় ধরণের গাঁজার চালানও ধরা পড়েছে। মাদক চোরাচালানে অল্প সময়ে অনেক টাকা পাবার কারণে এমন বিপথে নামে নারীরা। মাদক চক্রের মূল হোতারা ধরা ছোার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাদের বিচারের আওতায় আনা না গেলে এই প্রবণতা সহজে বন্ধ হবে না।