মেহেরপুরে শেষ হলো বেহুলা-ঝাঁপান গান

অন্ধ বিশ্বাস বা লোক বিশ্বাস যাই বলিনা কেন, এই বিশ্বাসের উপর ভর করেই অন্ধ হয়ে যাওয়া এক গৃহবধুকে বেহুলা, জারি ও ঝাঁপান গানের মাধ্যমে সারিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন একদল কবিরাজ।

কবিরাজ বলছে এই গান শেষ হলে গৃহবধু পুরাতন নেসা (৪৫) ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠবে। ঘটনাটি ঘটেছে মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের হিজুলী গ্রামে।

ঘটনা স্থলে গিয়ে জানা যায়, মেহেরপুর সদর উপজেলার হিজুলী গ্রামের মাবুদ আলী দুই বছর আগে তার পুরাতন মাটির বাড়ি ভেঙ্গে পাকা বাড়ি তৈরী করার সময় একটি বড় বিষধর সাপ ও চল্লিশটি বাচ্চা মাটির দেওয়ালের মধ্যে দেখতে পায়।

তার চিৎকারে এলাকাবাসি এগিয়ে এসে সাপ গুলি মেরে ফেলে। এর কিছু দিন পর গৃহকর্তা মাবুদ আলীর স্ত্রী তিন সন্তানের জননী পুরাতন নেসার পর্যায়ক্রমে দুচোখ অন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তার মাথার চুলে জটা পাকতে থাকে। গৃহকর্তা মাবুদ আলী শ্যালো ইঞ্জিনচালিত আলগামন যোগে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান পাঁ ভেঙে যায়।

পুরাতন নেসার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন স্থানে গিয়ে চিকিৎসা করালেও সুস্থ হয়নি। এমনকি মাবুদ আলীর পা ভাঙাও সেরে উঠেনি। পরে এলাকায় কবিরাজি চিকিৎসা শুরু করে তারা। স্বামী-স্ত্রীকে কবিরাজের পক্ষ থেকে জানানো হয় তাদের মাটির বাড়ি ভেঙ্গে সেখানে একটি পাকা বাড়ি তৈরী করার সময় জ্বিন সাপ রুপ ধারণ করে তার বাড়িতে ছিল ফলে ঐ সাপ মেরে ফেলার কারনে তাদের স্বামী-স্ত্রীর এই সমস্যা হয়েছে ।

কবিরাজের কথামত তারা বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়েও স্বামী-স্ত্রী সুস্থ হতে পারেনি। ডেকে আনা হয় রাজশাহী থেকে আসাদুল ইসলামকে। আসাদুলের কথামত বেহুলা, জারি ও ঝাঁপান গানের দলকে চুক্তিতে ডেকে আনা হয়। শুরু হয় ঝাঁপান ও বেহুলা লক্ষিনদারের গান। তিন দিন তিন রাত পর গতকাল বুধবার ছিল শেষ দিন।

চারদিকে কলাগাছ পুতে উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে করা হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চে রোগীকে রেখে শিল্পিরা নেচে নেচে ঝাপান গান গাইতে থাকেন। এদিকে ঝাপান গানের আয়োজনের খবর জানতে পেরে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের শত শত মানুষ সেখানে ভিড় জমায়। তিন দিন ধরে চলা এই আয়োজনে বাড়তি মাত্রা যোগ করতে বসেছে বিভিন্ন স্টল। বিক্রি করা হচ্ছে খাদ্য দ্রব্যসহ বিভিন্ন সামগ্রী।

কবিরাজ আসাদুল ইসলাম বলেন, হিন্দু শাস্ত্র মতে সাপকে দেবতা মানা হয়। বাড়িওয়ালা ৪০টি সাপ মেরে ফেলার কারণে চিকিৎসার অংশ হিসেবে এই ঝাঁপান গানের আয়োজন করতে হয়। পূর্বে এই ধরণের রোগী রোগমুক্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেহেরপুরের আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের ১০/১২ জন রোগী ভাল হয়েছে বলে দাবি করেন।

ঝাঁপান গানের দলনেতা জাব্বার আলী জানান, আমি কবিরাজ নই। কবিরাজের আমন্ত্রণে আমরা ঝাঁপান গান গাইতে এসেছি। আমার দলে ৮ জন সদস্য । আমরা চুক্তি ভিত্তিতে গান করি।

গ্রামের রাহাদুল ইসলাম জানান, নবী বলেছেন সাপ দেখলেই মেরে ফেলতে। কিন্তু এরা যা করছে সবই হিন্দুয়ানী।

সদর উপজেলার রাইপুর গ্রামের বৃদ্ধ কিতাব আলী এসেছেন গান শুনতে। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে এই গান শুনেছি। তখন এই গানের অনেক ভক্তি ছিল। এখন ভক্তি কমে গেছে।

উচ্চ মাধ্যমিক পড়–য়া চুমকি খাতুন জানান, পুরাতন নেছা তার মামি হয়। তিনি বলেন, শুনেছি এই চিকিৎসায় রোগী ভাল হয়। এখন আল্লাহ ভরসা।
আয়ুব আলী জানান, গান শুনছি তিন দিন ধরে। দেখা যাক রোগী সুস্থ হয় কিনা। এর আগে শুনেছি রোগী ভাল হয়েছে।

গৃহকর্তা মাবুদ আলী জানান, আমরা মুসলমান হলেও চিকিৎসার স্বার্থে এই ধরণের আয়োজন করেছি। কোন চিকিৎসাতেই ভাল না হওয়ার কারণে কবিরাজের কথায় বিশ্বাস করেছি বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে।

পুরাতন নেছার ভাগনি পারভেজ সন্ধার দিকে মেহেরপুর প্রতিদিন কে জানান, গান দেওয়ার জন্য লক্ষাধিক টাকা ফুরিয়ে গেলেও এখনো কোন ফল দেখা যায়নি। তবে কবিরাজ বলেছেন ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে যাবেন।

মেহেরপুর সদর থানার ওসি শাহ দারা খান জানান, আইন শৃঙ্খলা ব্যতয় যাতে না ঘটে সেদিকে পুলিশের নজর ছিল।

মেহেরপুর প্রতিনিধি