
শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ আর তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জাতির অগ্রযাত্রার মূল ভিত্তি। কিন্তু এখনও দেশে টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত সংক্রমণজনিত রোগ শিশুদের জন্য এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে রয়েছে। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই রোগ প্রতিবছর হাজারো শিশুকে অসুস্থ করে তোলে এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এ বাস্তবতায় শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো সারাদেশে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগ শিশু সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নের এক অনন্য পদক্ষেপ।
স্কুলের বাইরের খাবারগুলোর মধ্যে যেমন ফুচকা, ভেলপুরি, চটপটি, আচার, শরবত বা আইসক্রিম — এগুলোর টক-মিষ্টি ও ঠান্ডা খাবার বাচ্চাদের মধ্যে পানিবাহিত রোগের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে টাইফয়েড সংক্রমণ শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। খাওয়ার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে সঠিক নিয়মে হাত না ধুলে দূষিত পানি ও খাবার খেলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, টাইফয়েড হলো স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি সিস্টেমিক সংক্রমণ, যা সাধারণত দূষিত খাদ্য বা পানি গ্রহণের মাধ্যমে ছড়ায়। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা, বমিভাব, ক্ষুধামান্দ্য, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া। এসব উপসর্গ প্রায়ই অস্পষ্ট হয় এবং অনেক সময় অন্যান্য জ্বরজনিত রোগের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। গুরুতর অবস্থায় জটিলতা বা মৃত্যুও ঘটতে পারে। অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানির অভাব টাইফয়েডের প্রকোপ বাড়ায়। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই রোগ থেকে বাঁচার উপায় হলো বাসায় রান্না করা খাবার খাওয়া, পানি ফুটিয়ে খাওয়া এবং বাসি খাবার পরিত্যাগ করা।
টাইফয়েড ভয়াবহ রূপ নিতে পারে যদি চিকিৎসা করতে দেরি করা হয়। এই টাইফয়েড হলো নাড়িতে ঘা বা অন্ত্রে ঘা; যার ফলে আস্তে আস্তে নাড়িটা ফুটো পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, তখন সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। আবার লিভারে কিন্তু এটার প্রদাহ ছড়িয়ে যেতে পারে তখন লিভারের এনজাইম বেড়ে যায় তখন এটাকে বলা হয় হেপাটাইটিস। আবার অগ্নাশয়ে এটার প্রদাহ ছড়িয়ে যেতে পারে তখন এটাকে বলা হয় প্যানক্রিয়াটাইটিস। এছাড়া গলব্লাডার বা পিত্তথলিতে প্রদাহ ছড়িয়ে যেতে পারে তখন এটাকে বলা হয় কোলেসিস্টাইটিস। এমনকি ফুসফুসে এটার প্রদাহ হতে পারে তখন এটা হতে পারে নিউমোনিয়া। আবার হার্টে এটার প্রদাহ ছড়িয়ে গিয়ে মায়োকারডাইটিস হতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ যেটা ব্রেনে যদি প্রদাহ শুরু হয়, হতে পারে মেনিনজাইটিস, এনক্যাফালাইটিস, এনক্যাফালোপ্যাথি এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। কাজেই কোনোভাবেই এত বড়ো রিস্ক নেয়া ঠিক না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বর্তমানে টাইফয়েড জ্বর নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় ও প্রাদুর্ভাব উভয় পরিস্থিতির জন্য তিন ধরনের ভ্যাকসিন সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) সব বয়সের জন্য রুটিন টিকাদান কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে কারণ এটি উন্নত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়। এটি কম বয়সি শিশুদের জন্য উপযোগী এবং দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা প্রদান করে।
শিশুর সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারের বহুমুখী পরিকল্পনার একটি নজির শিশুদের বিনামূল্যে টাইফয়েডের টিকা দান কর্মসূচি। এক ডোজ টিকা নিয়ে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার আগামী ১২ অক্টোবর ২০২৫ হতে সারাদেশে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। প্রথমবারের মতো সরকার প্রায় ৫ কোটি শিশুকে বিনামূল্যে এই টিকা দেবে। ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি সব শিশু এই ভ্যাকসিনের আওতায় আসবে।
টিকা পেতে https://vaxepi.gov.bd/registration/tcv এ অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন হবে ১৭ সংখ্যার জন্ম নিবন্ধন সনদের নম্বর। বাচ্চা কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়ালেখা করে সেটা লাগবে। নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১ আগস্ট থেকে। নিবন্ধনের পর জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যবহার করে সরাসরি ভ্যাকসিন কার্ড ডাউনলোড করা যাবে। ১২ অক্টোবর থেকে টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু হবে। যারা রেজিস্ট্রেশন করবে প্রত্যেককে দিন ও সময় জানিয়ে দেওয়া হবে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে ভ্যাকসিন দিতে হবে। যদি বাচ্চা অসুস্থ থাকে অথবা যদি কোনো কারণবশত সেদিন ভ্যাকসিন না নেওয়া যায় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই, পরবর্তীতে বাচ্চা সুস্থ হলে তার যেকোনো একদিন বাচ্চার স্কুলে বা যেখানে টিকাদান কর্মসূচি চলছে সেখানে গিয়ে টিকা দেওয়া যাবে। প্রথম ১০ দিন স্কুল ও মাদ্রাসায় ক্যাম্পের মাধ্যমে এবং পরবর্তী ৮ দিন ইপিআই সেন্টারে টিকা দেওয়া হবে। জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকলেও শিশুরা টিকা নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বাবা–মায়ের মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করা হবে এবং টিকা গ্রহণের তথ্য কাগজে লিখে দেওয়া হবে।
টাইফয়েড প্রতিরোধে এক মাস ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ টি অঞ্চলে শিশুদের টিকা দেওয়া হবে। ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচি চলবে। এ সময়ের মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সি প্রায় ১৩ লাখ শিশু টিকা পাবে। মোট ১৮ কর্মদিবসে ২ হাজার ১৮১ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার ২৭৯ শিশুকে টাইফয়েড টিকা দেওয়া হবে। ১২ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকা দেওয়া হবে (শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া) আবার ১৩ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ইপিআই টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় মোট ১৮ দিন টিকা দেওয়া হবে। এছাড়া ১ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত স্যাটেলাইট বা আউটরিচ ইপিআই কেন্দ্রগুলোয় টিকা দেওয়া হবে এছাড়াও নেই। টাইফয়েড টিকা দান কর্মসূচি সফল করতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থা ও অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তথ্য অধিদফতর, জেলা তথ্য অফিস, বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার নিয়মিত পরিচালনা করছে।
টিকা গ্রহণের পূর্বে সকলকে সকালের নাস্তা খেয়ে আসতে হবে, অর্থাৎ খালি পেটে আসা যাবে না। টিকা গ্রহণের পর অন্তত ৩০ মিনিট টিকা দান কেন্দ্রে বসে থাকতে হবে। এই টিকা নতুন হলেও অন্যান্য টিকার মতোই যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সেটা খুবই কম। যেমন: দেহের যে স্থানে প্রয়োগ করবে সেখানে সামান্য একটু ব্যথা হতে পারে, লাল হতে পারে, অল্প জ্বর, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি ভাব এবং মাংসপেশিতে ব্যথা দেখা দিতে পারে। এগুলো খুবই সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এগুলো খুবই সাভাবিক একটা বিষয়। অনেকের বেলায় হয় আবার অনেকের বেলায় হয় না। আবার যে স্থানে প্রয়োগ করবে সেই স্থান একটু লাল হতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা
টাইফয়েড প্রতিরোধে সরকারের এই টিকাদান কর্মসূচি নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ। শিশুদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটি শুধু একটি টিকা কর্মসূচি নয় বরং একটি জাতীয় অঙ্গীকার। একটি সুস্থ, সক্ষম ও সংক্রমণমুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের প্রত্যয়। অভিভাবকদের সচেতনতা, শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে এই কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রতিটি শিশুকে টাইফয়েড ভ্যাকসিনের আওতায় এনে একটি সুস্থ, নিরাপদ ও টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধদফতর।