গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে এ উপত্যকায় জাতিগত হত্যা চালাচ্ছে। উপত্যকাটিতে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত কম-বেশি ৬৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘শিশুদের ওপর (যুদ্ধের) প্রভাব শুধু শারীরিক আঘাত বা ক্ষুধায় সীমাবদ্ধ নয়। তাদের ক্ষত গভীর ও অদৃশ্য। এর মধ্যে আছে উদ্বেগ, দুঃস্বপ্ন, আক্রমণাত্মক আচরণ ও ভয়। অনেক শিশুকে ভিক্ষা, চুরি বা শিশুশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি এক হারানো শৈশব।
এ অবস্থা যত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে, শিশুরা তাদের চলমান ও গভীর ট্রমার ছায়ায় প্রজন্ম ধরে ভুগবে।‘ গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা প্রতিদিনই শিশু নির্যাতন ও হত্যার সংবাদ জানতে পারছি। আমাদের দেশেও শিশু নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। শিশুদের ওপর অমানবিক আচরণ বন্ধ করা যায়নি। মাতা-পিতা, অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় দিন কাটান। নিষ্পাপ এসব শিশুর ওপর নির্যাতন ও হত্যায় আঁৎকে উঠেন সচেতন সব মানুষ। আমাদের ব্যর্থতা হলো আমরা শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ আবাস গড়তে তুলতে পারিনি,তবে এটা ঠিক নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যহত আছে।
শিশু আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী আমাদের দেশের অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে শিশুদের প্রধান ১২টি অধিকার রয়েছে। এই অধিকারগুলো মূলত জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের আলোকে প্রণীত শিশু আইন ২০১৩ এবং জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ অধিকারগুলো হলো: বেঁচে থাকা ও বিকাশের অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সুরক্ষার অধিকার, অংশগ্রহণের অধিকার, নাম ও জাতীয়তার অধিকার, বিনোদন ও খেলার অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার অধিকার, নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অধিকার, আরাম ও বিশ্রামের অধিকার এবং বৈষম্যহীনতার অধিকার । সমাজের সকল প্রকার বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকার এবং সকল স্তরে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার প্রতিটি শিশুর রয়েছে।
এ অধিকারগুলো আইনদ্বারা স্বীকৃত হলেও বাস্তবে আমরা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছি সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। এ দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত শিশুকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে মা-বাবা, অভিভাবক, রাষ্ট্রসহ সর্বোপরি সমাজের সব মানুষকে।
শিশুদের সহিংসতা, শোষণ, অবহেলা এবং যেকোনো ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য শিশু সুরক্ষার ৬টি নীতি রয়েছে। এগুলো হলো: প্রতিরোধ (Prevention), সুরক্ষা (Protection), ক্ষমতায়ন (Empowerment), আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া (Proportionate Response), অংশীদারিত্ব (Partnership), এবং জবাবদিহি (Accountability)। শিশুদের প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা, শোষণ, এবং অবহেলা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো প্রতিরোধ বা Prevention ।
সুরক্ষা বা Protection হলো ক্ষতি বা ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য দ্রুত সাড়া দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদান করা হলো ক্ষমতায়ন বা Empowerment । আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া বা Proportionate Response হলো ঝুঁকির মাত্রা ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে আনুপাতিক এবং উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জানানো। অংশীদারিত্ব বা Partnership হলো পরিবার, সমাজ এবং বিভিন্ন সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যারা শিশুদের ক্ষতি করেছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো জবাবদিহি বা Accountability।
সমাজে শিশুর প্রতি ভালোবাসা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাদের প্রতি হিংগ্রতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থার অবসান না হলে বিপন্ন হবে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন। আমাদের সমাজে অনেক শিশু তাদের বাবা-মা, শিক্ষক এবং সেবাদানকারীদের দ্বারা শারীরিক শাস্তি ও মানসিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের হাতেই শিশুরা প্রায়শই সহিংসতার শিকার হয়, যা একটি বড়ো সমস্যা। অর্থনৈতিক কারণে অনেক শিশু, পরিবারকে সাহায্য করার জন্য কাজে যেতে বাধ্য হয় অথবা অপরিণত বয়সে তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে শিশুকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাংলাদেশে শিশু অধিকার লঙ্ঘন একটি সাধারণ বিষয়।
শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, সুষম খাদ্য, সুরক্ষা, নিরাপদ পানি, অংশগ্রহণ, বিনোদন, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির মৌলিক অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিশু এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
আমাদের সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধানের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার-কর্তব্য, জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অথচ শারীরিক ও মানসিক জটিলতা অথবা আর্থসামাজিক কারণের জন্য অনেক শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোর শিশুরা শিক্ষা লাভ করতে পারে না। সামাজিক বৈষম্য তাদের শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পথশিশুদের একটি বিশাল অংশ পথেই থাকে এবং তারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায় না, কারণ তারা অনাথ। তারা নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
শিশু আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী শিশুকে দিয়ে ভিক্ষা করানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনের ৭১ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেন বা কোন শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করান অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশুনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে প্রশ্রয়দান করেন বা উৎসাহ প্রদান করেন বা ভিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রদান করেন, তাহা হলে তিনি এই আইনের অধীনে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড অথবা অনধিক (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এছাড়াও ৭২ ধারায় শিশুর দেখাশুনার দায়িত্বে থাকাকালে কোন ব্যক্তিকে যদি প্রকাশ্য স্থানে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং এই কারণে যদি তিনি শিশুটির যথাযথ তত্ত্বাবধান করিতে অসমর্থ হন, তাহা হলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনি সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও শিশু ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
শিশুরা আমাদের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। তারা আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা কি আমাদের শিশুদের সত্যিই তৈরি করছি বা করার চেষ্টা করছি ভবিষ্যতের জন্য।শিশুর আবেগীয় অনুভূতিগুলোকে সঠিকভাবে বুঝে সে অনুযায়ী যদি তাকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যায় তাহলে সে একজন সৎ মানবিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।একটি শিশুর জীবনের প্রথম ৮ বছরে যে মানসিক বিকাশ লাভ করে, তা তার সমগ্র জীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর মস্তিষ্কের শতকরা ৯০ ভাগ বিকাশ হয় এ সময়ে।
শিশুর সুরক্ষা প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। শিশুর সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা হলো সহিংসতা, শোষণ, অপব্যবহার এবং অবহেলা থেকে শিশুদের রক্ষা করা এবং তাদের সুস্থ, নিরাপদ বিকাশ নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করার জন্য পারিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ সুরক্ষত হয় এবং তারা সমাজে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে এটাই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখকের নাম: ইমদাদ ইসলাম, সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধদফতর।