
ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আবাদের শুরুতেই হোঁচট খেতে হচ্ছে পেঁয়াজ চাষিদের। গতবছরের তুলনায় এবছর দ্বিগুন দামে কিনতে হচ্ছে পেঁয়াজের বীজ। আবাদ বাড়ায় বেড়েছে বীজের চাহিদা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বীজ ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামের দ্বিগুন দামে বিক্রি করছেন পেয়াজের বীজ এমন অভিযোগ উঠেছে কৃষকদের পক্ষ থেকে।
ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ব্যাপক পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। প্রতিবছর আবাদের পরিমান বাড়ছে। শৈলকুপার পেঁয়াজ চাষিরা দুই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করে থাকেন। কেউ কন্দ রোপণ করেন আবার কেউ চারা রোপণ করেন। তবে চারা রোপণের পরিমাণই বেশি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পেঁয়াজের চারা রোপণ করবে এই অঞ্চলের কৃষকরা। অনেকেই ইতোমধ্যে বীজতলায় চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, কেউবা বীজতলা প্রস্তুত করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে এই উপজেলায় ১২হাজার ২৭৯ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
গতবছর আবাদ হয়েছিল ১২ হাজার ৩২ হেক্টর জমিতে। গতবছর এই উপজেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ২লাখ ৪০ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন। এবছর কোনো সংকট না হলে ২লাখ ৪৫ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হবে। এই উপজেলায় এবছর পেঁয়াজের কন্দ রোপণ করা হবে ৪২২ হেক্টর জমিতে ও চারা রোপণ করা হবে ১১হাজার ৮৫৭ হেক্টর জমিতে।
শৈলকুপা শহরের কৃষি নিলয় বীজ ভান্ডারের মালিক জিএম জিকু আলম বলেন, এবছর কৃষকরা লালতীর হাইব্রিড, লাল তীর কিং, ভারতীয় জাত সুখসাগরের বিভিন্ন ভ্যারাইটি, দেশিয় বীজ উৎপাদনকারী সংস্থার বাদশা, লালদিঘিসহ বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজের বীজ কিনেছে। লালতীর হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ ১ বিঘা জমিতে ১২০ মণ থেকে ১৪০ মণ পর্যন্ত ফলন হচ্ছে এই উপজেলার মাটিতে। সেখানে গত কয়েক বছর ভারতীয় সুখসাগর হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ আবাদে বিঘা প্রতি ১০০ মণের কমবেশি উৎপাদন হয়েছে। যেখানে দেশি জাতের পেয়াজ খুব ভালো ফলন হলে বিঘা প্রতি ৫৫ মণ থেকে ৬০ মণের মত ফলন হয়। কিন্তু বাজারে দেশি পেঁয়াজের চেয়ে ভারতীয় সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ মণপ্রতি ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করেছে। লালতীর হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের দাম আরও বেশি পায় কৃষকরা। ফলন বেশি ও দামও বেশি এই কারণে এই জাতের আবাদে বেশি ঝুকছে কৃষকরা।
উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, গতবছর আমি ৩৮ কাঠা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। এবছর ৩ বিঘা জমিতে আবাদ করার জন্য বীজতলায় ৩ কেজি সুখসাগর হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের বীজ বপন করেছি। উচ্চ ফলনশীল লালতীর হাইব্রিড জাতের বীজ কিনতে গিয়ে দোকানদারের শর্তে পিছিয়ে এসেছি। দোকানদারেরা বলে ১ কেজি লাল তীর হাইব্রিড বীজ নিলে ৩ কেজি লাল তীর কিং জাতের বীজ নিতে হবে। কিন্তু আমাদের অঞ্চলে লাল তীর কিং জাতের পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়না।
এই গ্রামের কৃষক মোকছেদ আলী বলেন, এক বিঘা পেঁয়াজ আবাদে কৃষকের ৭০ হাজার টাকার কমবেশি খরচ হয়। ৮০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে এই পেঁয়াজ উৎপাদন মৌসুমে বিক্রি হয় বাজারে। সংরক্ষণ করে পরে বেঁচতে পারলে অনেক লাভ হতো কৃষকদের। দোকান থেকে সার ওষুধ বাকি নিয়ে চাষ করি। পেঁয়াজ উৎপাদনের সময় আসলেই সার-কীট নাশকের দোকানদারেরা হালখাতার চিঠি দেয়। বাধ্য হয়েই তখন বাজারে কম দাম থাকলেও বেঁচে দিতে হয় আবার বেশি দিন রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে এই কারণেও বিক্রি করে দিতে হয়।
এই গ্রামের কৃষক আকুল বিশ্বাস বলেন, আমি ৪৮ শতক জমিতে পেঁয়াজের বীজ বপন করেছি। এখন চারা তৈরি করছি। আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ক্ষেতে চারা রোপণ করবো। আমাদের পেয়াজ চাষে ডিএপি সারের প্রয়োজন বেশি হয়। এখনই ডিলারদের কাছে সার কিনতে গেলে অল্প পরিমাণে দিচ্ছে। তাতে আমাদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। খোলা বাজারে কিনতে গেলে ১০৫০ টাকা দামের সার ১৭৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, এক কেজি লাল তীর হাইব্রিড বীজের মোড়কে সর্বোচ্চ দাম যা লেখা রয়েছে তার দ্বিগুন দামে বিক্রি করছে বীজ বিক্রেতারা। বেশি দরদাম করলে তারা বীজ দিচ্ছে না। সব বীজের দামই এবছর দ্বিগুন।
এই এলাকার কৃষক পলাশ হোসেন, খয়রাত আলী, ওহিদ আলী জানান, তারা অন্যান্য জাতের সাথে লালতীর হাইব্রিড জাতের পেয়াজ আবাদ করেছেন। গতবছর এককেজি লালতীর হাইব্রিড জাতের বীজের দাম পড়েছিল ২৮ জাহার টাকা। এবছর সেই বীজ দাম নিচ্ছে ৬২ হাজার টাকা। গতবছর সুখসাগর হাইব্রিড জাতের এক কেজি বীজের দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩৫০০ টাকা। সেই বীজ এই বছর সাড়ে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে। প্রত্যেক জাতের বীজই গতবছরের তুলনায় এবছর দ্বিগুন।
কৃষক পলাশ হোসেন বলেন, আমি এবছর ৬ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ করবো। নার্সারিতে যে বীজ বপন করেছিলাম তার অর্ধেক নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা বায়ার ক্রপস কোম্পানির ছত্রাক নাশক ‘নুনা’ ও সিনজেনটা কোম্পানির ‘মিরাভিস ডুয়ো’ ব্যবহার করি। পেঁয়াজের মৌসুমে এই অঞ্চলে এই ওষুধের দামও দ্বিগুন বেড়ে যায়। এক বিঘা জমিতে চারা রোপণ করতেই ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়।
সার-ওষুধ ও পরিচর্যা দিয়ে বিঘাপ্রতি ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। গতবছরের তুলনায় এবছর মজুরের দামও বেড়েছে। বীজের দাম বেশি, বেশি টাকা দিয়ে কীটনাশক ও সার কিনতে হচ্ছে কিন্তু বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারিনা। মৌসুমে সারের সরবরাহ ঠিক থাকলে ভালো ফলন হবে। সরকারের কাছে আহ্বান যেন এই মৌসুমে সারের সরবরাহ ঠিক রাখতে ব্যবস্থা রাখে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আরিফুজ্জামান বলেন, গতবছরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের তুলানায় এবছর পেঁয়াজের মৌসুমে ২৫০০০ বস্তা ডিএপি সার এই উপজেলায় বেশি বরাদ্দ পেয়েছি। এবছর ১৬ টা অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ৩ জন বিসিআইসি সারের ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে এবং অনেকগুলো সাব ডিলারকে জরিমানা করে সতর্ক করা হয়েছে। আমাদের উপসহকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। কোথাও সারের কৃত্রিম সংকটের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশাকরি এবছর সারের সংকট হবে না। তবে বীজের বিষয়ে বলতে পারবো না।
লালতীর বীজের ডিলার বাধন বীজ ভান্ডারের মালিক সুশান্ত কুমার বলেন, এবছর মাত্র ১৪ কেজি লালতীর হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের বীজ বরাদ্দ পেয়েছি। কোম্পানি থেকে শর্ত দিয়ে দিয়েছে এককেজি লালতীর হাইব্রিড পেঁয়াজ বীজ নিলে ১০ কেজি লালতীর কিং জাতের বীজ নিতে হবে। লালতীর কিং জাতের বীজের চাহিদা নেই। এই কারণে এই বীজের দাম এত বেড়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন বীজের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য রয়েছে ৩২ হাজার টাকা। বেশি দামে বিক্রি করছেন কেন? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এই বীজ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন আর বিক্রি করা হচ্ছে না। অনেকে পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও এনেছে বলে তিনি জানান।
জেলা বীজ প্রত্যয়ণ অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ফাতেমা কওসার মিশু বলেন, আমরা এমন অভিযোগ পায়নি। কেউ স্পেসিফিক অভিযোগ দিলে বিষয়টা দেখবো।