সংকুচিত হচ্ছে সাংবাদিকতা ?

সংকুচিত হচ্ছে সাংবাদিকতা ?

মফস্বল শহরে আমার সাংবাদিকতা প্রায় ২৮ বছর। এসসসি পাশের গন্ডি পেরিয়ে একাদশ শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা দিয়ে আমার হাতে খড়ি হয়েছিল। এরপর বেশ কয়েটি জাতীয় দৈনিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও পরে অনলাইন মিডিয়া। মুলত প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন সবগুলো মিডিয়াতে কাজ করার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে।

এর মধ্যে মেহেরপুর থেকে প্রকাশিত এ অঞ্চলের বহুল প্রচারিত দৈনিক মেহেরপুর প্রতিদিনের বার্তা সম্পাদক ও গাংনী থেকে প্রকাশিক আমাদের সূর্যোদয় পত্রিকাতে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা আমাকে অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছে বলা যেতে পারে। যাই হোক, সংবাদপত্র, সাংবাদিক পাঠক, রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নানাবিধ বিষয় নিয়ে আজকে দু একটি কথা লিখবো বলেই কম্পিউটার নিয়ে বসা। একজন সাংবাদিক তার দৈনন্দিন কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত হাজারও পাঠকের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। একজন পাঠক একজন সচেতন সাংবাদিকের কাছে সব সময় বিচারকের আসনে থাকেন। অর্থাত একজন সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত বিচারকের মুখোমুখি হয়ে থাকেন।

বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা, মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন, যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দটি দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকেই সাংবাদিকতা বোঝায়।

সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সংবাদপত্রকে রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভবলা হয়ে থাকে। সাংবাদিকদের দেশ ও জাতির বিবেক,সমাজের আয়না, দর্পণ, বিবেক, তৃতীয় চোখ নানাভাবে বিশেষায়িত করে থাকেন। সাংবাদিকতা পেশা মহৎ ও সম্মানজনক হলেও এটি এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

একজন “কলম সৈনিক” সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যান। দেশ ও মানবতার কল্যাণে কাজ করতেই সমাজের সকল বিষয়ে জাতির কাছে তুলে ধরতে সাংবাদিকরা কাজ করে থাকেন।

সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেও কারো মনজয় করতে পারেন না, ছোট একটি ভুল করলেই সাংবাদিকদের উপর হামলা, মামলা করা হয়, এমনকি সাংবাদিককে হত্যার শিকার হতে হয়।
রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা, তাদের ক্যাডার, সন্ত্রাসী ও দূর্বৃত্তদের হামলা শিকার হন হরহামেশাই। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও রোশানলে পড়তে হয় মাঝে মাঝে।

সাংবাদিকরা সারাক্ষণই অসহায়, নিপিড়ীত, নির্যাতিত মানুষের খবর নেন। তাদের দু:খ কষ্টগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু, কেউ কি খবর নিয়েছেন, কেমন আছেন সাংবাদিকরা? জনগণের কল্যাণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, এর বিনিময়ে কি পাচ্ছেন? হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, হয়রানিমূলক মামলার শিকার হচ্ছেন।

আমরা রাজধানীতে নিজ বাসায় দূর্বৃত্তদের নারকীয় হত্যাকান্ডের শিকার সাগর রুনির কথা না হয় বাদ দিলাম। তাদেরকে নিয়ে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও অনেক কথা বলেছে। এই নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে দেশব্যাপী মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন সাংবাদিকরা। মামলাটি তদন্ত চলছে বছরের পর বছর। তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের জন্য শতাধিকবার সময় নেয়া হয়েছে কিন্তু এখনো অধরা রয়ে গেছে এই হত্যাকান্ডের আসল ঘটনা।

নিশ্চয় মনে আছে, জামালপুরে নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের কথা। গত বছরের ১৪ জুন রাত সোয়া ১০টার দিকে একদল সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি মারধরে মারাত্মক আহত হন এবং পরের দিন ১৫ জুন ময়মনসিংহ মেডিকেল মারা যান।

সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের উপর হামলা, মিথ্যা মামলায় জেল জরিমানা ও অব্যাহত হুমকির বিষয়টি সাংবাদিকদের আবারও ভাবিয়ে তুলছে।

চিটাগং এর একটি আবাসিক হোটেলের মাদক ব্যবসা নিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের এনসিএ ভিত্তিক অনুষ্ঠান “তালাশ” টিমের সিনিয়র প্রতিবেদক নাজমুল সাঈদ ও তার সহকর্মী ক্যামেরা পার্সনের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কয়েকদিন পর ঢাকা তিতুমীর কলেজের এক অনুষ্ঠানে ছাত্র লীগের এক নেতা ও তার সহকর্মীদের হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সময়ের আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সাব্বির হোসেন, দৈনিক খোলা কাগজ পত্রিকার কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের স্থানীয় প্রতিনিধি সেলিম রেজা রনির উপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা। শুধু সেলিম রেজা রনি নয়, তার মাকেও রক্তাক্ত করা হয়। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দূর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন বেসরকারি টিভি এটিএন বাংলার প্রতিবেদক তুহিন ও তার ক্যামেরা পার্সন। এর আগে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দূর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন বেসরকারি টিভি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের মেহেরপুর জেলার স্টাফ রিপোর্টার রাশেদুজ্জামান ও জবাবদিহি পত্রিকার মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি সিরাজুদ্দোজা পাভেল নামের দুই সাংবাদিক। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার একটি গ্রামে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এলাকার চিহ্নিত একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের হামলার শিকার হন বেসরকারি টিভি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি শরিফ বিশ্বাস, কালবেলা পত্রিকার সাংবাদিক এসআই সুমন সাংবাদিক খন্দকার বিদ্যুৎ। পাবনার সাথীয়া উপজেলার একটি গ্রামে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন কালবেলার সাংবাদিক মানিক মিয়া, সংবাদ প্রতিদিনের সাংবাদিক খালেকুজ্জামান পারভেজ, আরটিভির প্রতিনিধি তাইজুল ইসলাম, মোহনা টিভির প্রতিনিধি ইকবল হোসেন,আনন্দ টিভির মনোয়ার হোসেন ও মানবকন্ঠের জেলা প্রতিনিধি এমজে মুলক।

এইগুলো ছিল দূর্বৃত্তদের দ্বারা সাংবাদিক নিগৃহীতের ঘটনা। প্রশাসনের কাছেও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। সাম্প্রতিক সময়ে লালমনির হাটের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল নোমানের কাছে তথ্য চাওয়ায় পাঁচ সাংবাদিককে আটকে রেখে নানাভাবে গালাগালি ও ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে জেলে দেওয়ার হুমকি দেন। সাংবাদিকরা হলেন, মাইটিভি ও অবজারভার প্রতিনিধি মাহফুজ সাজু, কালবেলা প্রতিনিধি এসকে সাহেদ, এশিয়ান টিভির প্রতিনিধি নিয়ন দুলাল, সাংবাদিক ফারুক হোসেন ও আবরদুল মান্নান। পরে ওই জেলার এডিসি এসে তাদের মুক্ত করেন।

তবে এর মধ্যে সবচেয়ে দু:খজনক ঘটনা ঘটেছে শেরপুরের নকলা উপজেলায়। শেরপুরের নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া উম্মুল বানিনের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করার ঘটনায় এক সাংবাদিককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

গত ৫ মার্চ নকলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী হাকিম মো. শিহাবুল আরিফ তাকে এ দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। দণ্ড পাওয়া শফিউজ্জামান রানা দৈনিক দেশ রূপান্তরের নকলা উপজেলা সংবাদদাতা।

এর আগে কুড়িগ্রামের নিজ বাড়ি থেকে ঢাকা ট্রিবিউন সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে তুলে নিয়ে একবছরের জেল দেন জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট।

রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিসি অফিসের দুই-তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ও বেশ কয়েকজন আনসার সদস্য। তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৫-১৬ জন আনসার সদস্য দরজা ভেঙে তার বাড়ির ভেতর ঢুকে আরিফুলকে মারতে থাকে এবং একপর্যায়ে তাকে তুলে নিয়ে যায় সাংবাদিকদের উপর হামলা মালা, নির্যাতন ও হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়।

অপরাধবিষয়ক যে কোনো সংবাদ, বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষমতাবানরা যুক্ত আছেন, তাদের বিষয়ে অনেক অভিযোগ পেলেও এখন আর সেসব অনুসন্ধানে খুব বেশি উৎসাহ পান না সাংবাদিকরা। কারণ অনুসন্ধান করে রিপোর্ট প্রকাশ করলেও ওই রিপোর্টের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে ফাঁসানো হতে পারে—এমন ভয়ে থাকেন। অর্থাৎ একধরনের স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ সাংবাদিকদের আঁকড়ে ধরছে। এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকিমুক্ত রিপোর্ট করবেন।

বস্তুত ‘সাংবাদিকতা’ করা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। ‘সাংবাদিকতা’ শব্দটিকে বন্ধনীর ভেতরে রাখার কারণ এখানে সাংবাদিকতা বলতে প্রকৃত সাংবাদিকতাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে সাংবাদিকতার মানে দল-মত-আদর্শ ও ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে ফ্যাক্ট অনুসন্ধান করে নির্মোহভাবে সঠিক তথ্য বের করে আনার চেষ্টা। যে সাংবাদিকতায় প্রশংসার চেয়ে প্রশ্ন বেশি। যে সাংবাদিকতায় প্রশংসা থাকলেও সেখানে যৌক্তিক সমালোচনা, প্রশ্ন ও সংশয় প্রকাশেরও সাহস থাকে। সেই সাংবাদিকতা করা এখন কেন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। কেন কঠিন—তার উত্তর খোঁজার জন্য এই লেখা।

রাষ্ট্রের সাধারণ ও নিরীহ মানুষ কাউকে হত্যা করতে পারে না। হত্যা করতে হিম্মত লাগে। সাহস লাগে। হত্যা করার পরে পার পেয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক, সামাজিকও আর্থিক সক্ষমতা লাগে। যে সক্ষমতার কারণেই প্রায় এক যুগেও সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরা সম্ভব হয়নি। এমনকি কারা তাদের খুন করলো সেটিও অধরা।

মেহেরপুর-২ আসনের সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেন দীর্ঘদিন যাবৎ একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই বাড়ির মালিকের অভিযোগ ছিলো এমপি মকবুল হোসেন অনেকটা জোর করে বাড়িট দখলে রেখেছেন। তাকে বাড়ি দেওয়া হচ্ছে না। বাড়ির মালিকের অভিযোগের ভিত্তিতে মেহেরপুর প্রতিদিনে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ক্ষিপ্ত হয়ে মকবুল হোসেনের নিকট আত্মীয় পত্রিকাটির প্রকাশক এমএএস ইমন, সম্পাদক ইয়াদুল মোমিনসহ প্রতিনিধি আলামিন হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা ঠুকে দেন।
এদিকে সম্প্রতি মেহেরপুর প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মাহবুব চান্দু মেহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র মোতাচ্ছিম বিল্লা মতুর পরিচালিত ক্লিনিকের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে মেয়র মতুর রোশানলে পড়েন। তার উপর হামলা করা হয়েছে। শুধু হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মতু তার ক্লিনিকের ম্যানেজারকে বাদী করে সাংবাদিক মাহবুব চান্দুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলা ঠুকে দেন।

২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে নিহত হন দৈনিক সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল। শোনা যায়, শিমুল দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় অস্ত্র মহড়ার ছবি তোলার সময় পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা হালিমুল হক মিরুর অস্ত্রহাতে ছবি তুলছিলেন, এতে পৌর মেয়র মিরু রাগে সাংবাদিক শিমুলকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। যেভাবেই হোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ফলেই এ ঘটনা, এটিই সত্য। সেই খুনের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি গোলাম রব্বানি নাদিমের নাম।

গত বছরের ১৪ জুন রাত সোয়া ১০টার দিকে একদল সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি মারধরে তিনি নিহত হন।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পরে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু গ্রেফতার হন। তিনি মাহমুদুল আলম সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক।
সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক শিমুল হত্যার আসামিরা কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে এসেছেন। সাংবাদিক হত্যা কিম্বা নির্যাতন যাইহোক, সাগর-রুনির মতো এসব মামলাগুলোও বছরের পর বছর ঝুলতে থাকবে। স্বজন ও সহকর্মীরা প্রতি বছর বিচারের দাবিতে রাস্তায় মানববন্ধন করবেন। প্রকৃত সাংবাদিকতা করা দিনদিন যেকোনো সময়ের চেয় কঠিন হয়ে পড়ছে।

এবার আসি, সরকারি অফিস থেকে তথ্য পাওয়া প্রসঙ্গে। সরকারি অফিসে তথ্য পাওয়া এখন খুবই কঠিন। যদিও দেশে তথ্য অধিকার আইন পাশ হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন সাংবাদিকের তথ্য পাওয়ার পথ আরও কঠিন করে তুলেছে বলে মনে করেন সাংবাদিকরা।

এই আইন পাশ হওয়ার পর ছোটখাটো কোনো তথ্যের জন্য গেলেও সরকারি কর্মকর্তারা নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে বলেন। আবেদন করার পর নানা কারন দেখিয়ে দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা জানিয়ে দেন যে, তথ্যটি সন্নিবেশিত নেই। অথবা কোনো উত্তরও দেবেন না। এর বিরুদ্ধে আপিল এবং তথ্য কমিশনে যাওয়ার জন্য যে ধৈর্য ও সময় লাগে, সেটি অনেকের পক্ষেই ব্যয় করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ আইনি কাঠামোই সাংবাদিকতাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে।

কোনো ঘটনার ছবি তুলতে গেলে সেখানে পুলিশ বা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এসে বাধা দিচ্ছেন, এরকম অভিযোগ নিয়মিতই শোনা যায়।

অবশ্য সাংবাদিকতার প্রধান শত্রু এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনের এমনই সব ধারা রয়েছে যেগুলো দিয়ে যে কোনো একটি টেলিভিশন বা পত্রিকা কোনো একটি সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করলেই মামলা করার সুযোগ রয়েছে। অবশ্য একটু ঘুরিয়ে সুযোগটা রাখা হয়েছে। ছাপা পত্রিকা বা টেলিভিশনের খবরের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া যায় না, কিন্তু ওই খবরটিই যদি কেউ ফেসবুকে শেয়ার করেন বা ওই টেলিভিশন বা পত্রিকার অনলাইন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাহলে ডিজিটাল আইনে মামলা করা যায়। অথচ সংবাদটি ভুল হলে তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠানো, প্রেস কাউন্সিলে অভিযাগ দায়ের এমনকি মানহানির মামলা করারও সুযোগ আছে। কিন্তু ক্ষমতাবানরা এখন আর ওইসব ভদ্রোচিত পথে যেতে নারাজ। তারা চান তাৎক্ষণিক শাস্তি এবং এমন একটি ভয়ের পরিবেশ জারি রাখতে যাতে কেউ ক্ষমতাবানদের নিয়ে কোনো ধরনের সমালোচনামূলক লেখা, অপরাধের অনুসন্ধান করার সাহস না করে। কারণ ডিজিটাল আইনে মামলা দিলে তাতে সাংবাদিকদের হয়রানি ও নাজেহাল করা অনেক সহজ। এর শাস্তিও কঠিন। সাধারণত এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সহজে জামিনও মেলে না। এই আইনটি পাস হওয়ার পরে এ পর্যন্ত সাংবাদিকতার প্রধান শত্রু এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

একটি অনলাইন পত্রিকার এক তথ্যে জানা গেছে, ২০১৮ সালে এই আইনটি পাস হওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে। যেটি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেই। আর এসব মামলার বিরাট অংশেরই ভিকটিম হয়েছেন সাংবাদিকরা। এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়, বরং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন। ক্ষমতাবানরা গণমাধ্যমকে ‘সাইজ’ করার জন্য এই অস্ত্রটি ব্যবহারেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

সব আমলে সব সরকারই চায় গণমাধ্যম বা সাংবাদিকরা তার পক্ষে থাকবে। প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধু প্রশংসা করবে। (অসমাপ্ত)

লেখক: মেহেরপুর প্রতিদিনের জৌষ্ঠ প্রতিবেদক