সরকারি স্কুলের মসজিদের স্টিয়ারিং প্রভাবশালীদের হাতে

মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে গড়ে ওঠা মসজিদে কথিত কমিটি গঠণ করে মসজিদটি দখল নিয়ে পরিচালনা করছে একটি প্রভাশালী মহল। কথিত ওই কমিটির সদস্যরা এখন শুধু মসজিদ নয়, বিদ্যালয়ের আরও জমি দখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ করেছেন প্রধান শিক্ষক।

বিদ্যালয়ের অন্যান্য জমিতে অবৈধভাবে মাটি ভরাট ও টিনের বেড়া দিয়ে ১০ তলা ভবনের জন্য নিদির্ষ্ট যায়গা ও প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টার ক্যাম্পাস এলাকা মসজিদের সীমানার অন্তর্ভূক্ত করার অভিযোগ এনে প্রধান শিক্ষক খোরশেদা আলম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অদিপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ইতোমধ্যে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।

এদিকে জমি দখলের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ওই মহলটি এখন প্রধান শিক্ষক খোরশেদা আলমকে বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সামনে বিভিন্ন সময় অশালিন ভাষায় কথাবার্তা বলছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

সম্প্রতি কার্যনির্বাহী সভাপতি ঠিকাদার জহিরুল ইসলাম মিয়া, সাধারণ সম্পাদক ঠিকাদার আবু সালেহ আবলু, সহ-সভাপতি আবুল কাশেমকে দেখিয়ে একটি কমিটি গঠণ করেছে ওই প্রভাবশালী মহলটি। তবে, প্রধান শিক্ষককে কোনো কিছু না জানিয়েই মসজিদের সকল কার্যক্রম করে থাকেন কমিটির ওই সদস্যরা।

মসজিদের সিঁড়ি ও দ্বিতীয় তলা নির্মাণ কাজ শুরু হলেও প্রধান শিক্ষক খোরশেদা আলমকে কিছুই জানাইনি কমিটি।
প্রধান শিক্ষক খোরশেদা আলম বলেন, সরকারি জমি জোর করে দখল নিয়ে একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়া। সেখানে নামাজ হবে কিনা এ প্রশ্ন করেন তিনি। মসজিদটি বিদ্যালয়ের জমিতে হলেও কমিটি গঠণ করেছে প্রভাবশালী একটি মহল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আমি, সরকারি এই জায়গাটির তত্বাবধায়কও আমি। এখানকার এক ইঞ্চি জমি বেদখল হলেই সরকারের নিকট জবাবদিহি করতে হবে আমাকে।

তাহলে এখানে আমাকে না জানিয়ে বাইরের একটি কমিটি মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে কিভাবে ? বাইরের কোনো কমিটি দিয়ে স্কুলের মসজিদ পরিচালনা করার কোনো সুযোগ নেই।

মসজিদটি ওই কমিটির দখলে থাকলেও প্রতি মাসে মোটা অংকের বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে স্কুলকে। ২০২২ সালের জুন মাসের বিদ্যুৎ বিলে দেখা গেছে ১৮ হাজার ৬০৪ টাকা। প্রতি মাসেই এই ধরণের মোটা অংকের বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে বিদ্যালয়কে। বিদ্যুৎ বিলের কাগজ প্রধান শিক্ষক বরাবর আসছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, আমার সাথে আলোচনা না করে বিনা অনুমতিতে মসজিদটির সিঁড়ি ও দ্বিতীয় তলার উন্নয়ন কাজ করছেন আবু সালেহ আবলু ও সহসভাপতি আবুল কাশেম। তাদের নিষেধ করতে যাওয়ায় অকথ্য ভাষায় কথাবার্তা বলেছেন আমাকে। এই বিনিয়োগের অর্থের উৎস কি, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে এই ধরণের বিনোয়োগ আইনসিদ্ধ না।

বিদ্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি কয়েক দিন আগে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে আবুল কাশেম বলেন, তোমার হেড ম্যাডাম তো বাচ্চা পড়াই। সে আবার আমাদের পেছনে লাগতে আসছে কেনো ? তোমার হেড ম্যাডামকে বাচ্চাদের পড়াতে বলো।

একই বিদ্যালয়ের অপর সহকারী ধর্মীয় শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আবু সালেহ আবলু আমাকে বলেন আপনার প্রধান শিক্ষক বাচ্চা পড়ানো রেখে আমাদের সব কাজে হাত লাগাচ্ছে কেনো। তাকে নিষেধ করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যালয়ের ডাবল শিফট ভবনের উর্দ্ধমুখি কাজের সাথে টয়লেট ব্লকটি পশ্চিম দিকে থাকলেও ওই চক্রটির বাধার মুখে পড়েন ঠিকাদার ও স্কুল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে তাদের বাঁধার কারণে ভবনের পিছনে টয়লেটটি করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

মেহেরপুর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সদর উপসহকারী প্রকৌশলী মেহেদী জামান খাঁন বলেন, ডাবল শিফট ভবনের উর্দ্ধমুখী উন্নয়ন কাজের টয়লেট নির্মাণ করতে গিয়ে মসজিদ কমিটির বাধার মুখে পড়ি। পরে সেই ডিজাইন পাল্টিয়ে ভবনের পশ্চিম পাশে না করে পিছনের দিকে করতে বাধ্য হয়েছি। এর ফলে ভবনটির যেমন সৌন্দর্য্য হানি ঘটেছে, তেমনি সরকারের ব্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেখানে বিদ্যালয়ের ১০ তলা ভবনের মাটি থেকে শুরু করে সব কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে সেখানেই তারা টিন দিয়ে ঘিরে রেখেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদটি সরকারি বিদ্যালয়ের জমিতে হলেও কথিত কমিটির সদস্যরা সবাই বাইরের একটি প্রভাবশালী মহল। মসজিদটি বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি প্রাচীরের মধ্যে থাকার কথা থাকলেও সেটি বেদখল হয়ে চলে গেছে সাধারণের দখলে। বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনের পাশে মাটি ভরাট করেছে। এছাড়া আনুমানিক ৫/৬ কাঠা জমি দখল করে টিন দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ওই প্রভাবশালী মহলটি একই স্থানে এর আগে একটি কওমি মাদ্রাসার স্থাপন করলেও সেটি ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।

প্রধান শিক্ষক খোরশেদা আলম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে দেওয়া অভিযোগের তিনি লিখিছেন, মসজিদ কমিটির সহসভাপতি ও সেক্রেটারীকে মৌখিক নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা কোনো রকম যোগাযোগ করেনি। নিষেধ করলেও তারা সেখান থেকে ফিরে আসেনি। বরং মসজিদের সীমানার বাইরের জমিতে পাকা ঢালাই দিয়ে সীমানা বৃদ্ধি করে নিয়েছে। তিনি আরো উল্লেখ করে মসজিদটি বিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত হলেও মসজিদের কমিটি গঠণ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত কোনো বিষয় কর্তৃপক্ষকে অবগত করানো হয়না।

বাইরের লোকজন নিয়ে সরকারি বিদ্যালয়ের জমির মসজিদের কমিটি, এই কমিটির বৈধতা আছে কি এমন প্রশ্নের জবাবে সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ আবলু বলেন, এ নিয়ে সরকারি কোনো পরিপত্র নেই। মসজিদটি স্থাপন হওয়ার পর থেকেই আমার বাপ দাদারা এভাবেই কমিটি তৈরী করে চালিয়েছেন। আমরাও করেছি। এভাবেই আগামীতে এই মসজিদের কার্যক্রম চলবে বলে জানান তিনি। মসজিদের সিঁড়ি ও দোতালার উন্নয়ন কাজ সমন্ধে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি জানেনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি মেহেরপুর শহরের ঠিাকাদার জহিরুল ইসলাম মিয়া। তাকে দিয়েই সব কাজ চলে। এছাড়া আমাদের এই মসজিদ নিয়ে সব কিছুই জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে জানানো হয়। তার নলেজে দিয়েই সব কাজ করা হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মেহেরপুর এর নির্বাহী প্রকৌশলী , মেহেরপুর সদর থানার ওসি, মেহেরপুর সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ, মেহেরপুর ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতালের সুপরিনটেন্ডেন্ট ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মসজিদ সম্পর্কে বলেন, এখানকার প্রতিটি মসজিদের কার্যক্রম নিজেরাই পরিচালনা করে থাকেন। নিজেদের কর্মকর্তা/কর্মচারী দিয়েই মসজিদ পরিচালনা কমিটি গঠণ করে থাকি। বাইরের কোনো লোকের কমিটিতে থাকার সুযোগ নেই এখানে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মুসল্লিদের সাথে কথা বললে তারা জানান, এটি সরকারি জমির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ। এখানে বাইরের লোকের কমিটি ও তদারকি করার কি আছে? মসজিদ নিয়ে দরদ থাকলে তারা জমি কিনে মসজিদ তৈরী করুক।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় কোনো মসজিদ বা অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাকলে সরকারি কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নেবেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় কারা থাকবেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে বাইরের লোকজনের থাকার কোনো সুযোগ নেই।