
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার অন্যতম শীর্ষ এজেন্ট মুর্শিদ আলম লিপু ও তার সহযোগী মুছায়েদ আলম ক্যামেলকে সাইবার সুরক্ষা আইনের পৃথক দুইটি মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছেন মেহেরপুরের আদালত।
রবিবার (১০ নভেম্বর) দুপুরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাদের বিরুদ্ধে দুটি পৃথক সাইবার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করলে মেহেরপুর সিনিয়র জুডিসিয়াল আমলী আদালত-১ এর বিচারক মেহেদী হাসান মোবারক মুনিম ও সিনিয়র জুডিসিয়াল আমলি আদালত-২ এর বিচারক জুয়েল রানা আবেদন মঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। লিপু ও ক্যামেলকে ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর মেহেরপুর সদর থানায় দায়েরকৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩–এর অধীন ২৬ নম্বর মামলা এবং একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিবনগর থানার ৯/২২ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে বিচারক তা নামঞ্জুর করেন।
আদালতের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন এপিপি মোখলেছুর রহমান খান স্বপন এবং তাকে সহযোগিতা করেন মেহেরপুর জেলা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মারুফ আহমেদ বিজন। আর আসামি পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান, অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী ও অ্যাডভোকেট এহান উদ্দিন মনা।
ডিবি সুত্রে জানা গেছে, আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিগগিরই আবেদন করবে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
এছাড়াও বর্তমানে সাতক্ষীরায় লিপুকে সাইবার সুরক্ষা আইনের ৩ টি মামলা এবং যশোরের ২ টা মামলাতেও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এর আগে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের অভিযানে অনলাইন জুয়ার শীর্ষ এজেন্ট মুর্শিদ আলম লিপু ও তার সহযোগী মুছায়েদ আলম ক্যামেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ অক্টোবর দুপুরে প্রেস ব্রিফিংয়ে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১৬টি মোবাইল ফোন ও ৩টি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়, যা অনলাইন জুয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো বলে জানিয়েছিল পুলিশ। বর্তমানে সাতক্ষীরায় সাইবার সুরক্ষা আইনে লিপুর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। যশোরের আরও দুটি মামলায়ও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি বিরল দৃশ্য, মুজিবনগর থানার সাবেক এসআই সাহেব আলীর হঠাৎ উপস্থিতি। বর্তমানে তিনি মাগুরা জেলা সিআইডিতে কর্মরত। জানা যায়, লিপুকে আদালতে তোলা হবে শুনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মেহেরপুরে আসেন এবং তার সঙ্গে দেখা করেন। এই একই এসআই সাহেব আলীর অনলাইন জুয়া চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার একটি অডিও কল গত জানুয়ারিতে দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। অডিও ফাঁসের পরও তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়দের অনেকে।
বিষয়টি নিয়ে মেহেরপুর জেলা পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও, কালবেলা প্রতিবেদককে তিনি জানান এই ঘটনাটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মুর্শিদ আলম লিপুর নামে এর আগেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একাধিক মামলা বিচারাধীন। ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর ডিএমপির পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত এক মামলায়ও তার নাম রয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দৈনিক কালবেলায় ‘অনলাইন জুয়ার রাজধানী মেহেরপুর, হেডকোয়ার্টার রাশিয়া' শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। ওই সময় থেকেই আত্মগোপনে চলে যান লিপু। ঢাকা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের অনুসন্ধানে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একাধিক সিমকার্ড সংগ্রহ করে অনলাইন লেনদেন পরিচালনা করতেন। কখনো মাগুরা, কখনো সাতক্ষীরা, আবার কখনো ঢাকার বসুন্ধরায় অবস্থান পরিবর্তন করতেন তিনি।
দেশের অনলাইন জুয়া ও মানি লন্ডারিং তদন্তে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ যে ১৯ জন শীর্ষ এজেন্টের অনুসন্ধান করছে, তার মধ্যে প্রথম নামেই রয়েছে মেহেরপুরের এই মুর্শিদ আলম লিপু। ২০২১ সালের অভিযানে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে যুক্ত ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল সিআইডি; তখনও লিপুর নাম উঠে আসে। সেদিন থেকেই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় দেশজুড়ে অনুসন্ধান।
সাইবার অপরাধ, মানি লন্ডারিং, অনলাইন জুয়া সব কিছুর ছায়া যেন একত্রে জড়ো হয়েছে লিপু নামের এই তরুণের চারপাশে। একদিকে আদালতে কঠোর সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে প্রশাসনের নিরবতা। সব মিলিয়ে মেহেরপুরের আকাশে আবারও ভেসে বেড়াচ্ছে একটিই প্রশ্ন, 'জুয়ার এই নেটওয়ার্কের শেষ কোথায়?'