জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো------, রবি ঠাকুরের এই গানটি সত্যি অসাধারণ। একদম মিলে যায় প্রবীণ ভাই-বোনদের সাথে। বয়েসের ভারে নুয়ে পড়া জীবন এ যেন করুণার জীবন, স্বপ্নহীন জীবন। এই সময় কেবল দিনকাটে প্রবীণদের ধর্মচর্চা করে আর অপেক্ষায় পার করতে হয় ওপারের ডাকের।
১লা অক্টোবর আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রবীণদের জীবনযাএার মানোন্নয়ন করা এবং সমাজে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।
প্রতিবছর নতুন নুতন থিম বা প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ^ব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। এবার ৩৫তম আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস পালন করা হচ্ছে। এবছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘‘Older Persons Driving Local and Global Action: Our Aspirations, Our Well-being, Our Rights” অর্থাৎ স্থানীয় ও বৈশি^ক পর্যায়ে প্রবীণদের প্রত্যাশা,কল্যাণ ও অধিকার আদায়ে এবং সার্বিক কর্মকান্ডে প্রবীণ হোক চালিকা শক্তি। বাংলাদেশ সরকার এবার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- “একদিন তুমি পৃথিবী গড়েছো আজ আমি স্বপ্ন গড়বো সযতেœ তোমায় রাখবো আগলে”।
জাতিসংঘ ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর ১লা অক্টেবরকে আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষনা করেছে। প্রতি বছরই একটি নতুন প্রতিপাদ্য বা থিম নিয়ে দিবসটি উদযাপন করা হয়, যা প্রবীণদের জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং তাঁদের প্রতি সমাজের করনীয় বিষয়ে আলোকপাত করে।
মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বার্ধক্য। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ প্রবীণ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে জনসাংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বেশি হচ্ছে। আমাদের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। এটি সৃষ্টিকর্তার আর্শীবাদ বলা যায়। বার্ধক্যকে মানব জীবনের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করে প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়ন,প্রবীণদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি সহনশীল আচরণ প্রর্দশন এবং তাদের সমস্যাগুলো সর্ম্পকে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর ১লা অক্টোবরকে আর্র্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস ঘোষণা করেছে। প্রতিবছর ১লা অক্টোবরকে আমরা প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করলেও এবছর সরকারী সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রবীণ দিবস পালন করা হচ্ছে ৭ই অক্টোবর। আমাদের দেশের চলমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ প্রবীণকে দূর্বল স্বাস্থ্য, বিভিন্ন ধরনের বার্ধক্যজনিত রোগ, আর্থিক দৈন্যতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করতে হয়। দেশে অনেক দক্ষ, অভিজ্ঞ, কর্মঠ ও সৃজনশীল প্রবীণ রয়েছেন; তাঁদের কোথাও কোনো কাজে লাগানো হয়না। বিধায় ঘরে বসে কর্মহীন জীবনযাপনের ফলে তাঁরা বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও মানসিক রোগে ভুগতে থাকেন। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য তাঁদের সম্মানজনক কাজে নিয়োগ করে সমাজ জীবনের মূল ¯্রােতধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল দেশের মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্রতা থেকে মুক্তি, সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। কিন্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠী এ সমাজের জ্যেষ্ঠ নাগরিক হলেও তাঁরা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত। ১৯৮২ সালে প্রবীণ বিষয়ক সম্মেলন ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল বার্ধক্য স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া । কিন্ত বাস্তবতা হলো ২০২৫ সালে এসেও অর্থাৎ দীর্ঘ ৪৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এ অবস্থা এখনো বিরাজমান। ২০১৩ সালে দেশে প্রবীণ নীতিমালা ও পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্ত অদ্যাবধি এর বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি দৃষ্টিগোচর হয়না, তৈরী হয়নি বিধি। এ অবস্থার উত্তোরণ ঘটাতে হবে।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে এ দেশের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ ড.একেএম আব্দুল ওয়াহেদ ১৯৬০ সালে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রতিষ্ঠান, যা ঢাকার ধানমন্ডিতে তাঁর নিজ বাসভবনে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে রাজধানী আগারগাঁওয়ে সরকারের দেওয়া প্রায় এক একর জায়গার উপর ১৯৮৮ সালে হাসপাতাল ও একটি প্রবীণ নিবাস স্থাপন করা হয়। পরে একটি জেরিয়াট্রিক ইনস্টিটিউটসহ এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ৯২টি শাখা রয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০হাজার।
প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: বার্ধক্যে যতটা সম্ভব শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বস্তিতে থেকে প্রবীণরা যেন তাদের পরিপক্ক অভিজ্ঞতার আলোকে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান অব্যাহত রাখতে পারেন, সে লক্ষ্যে তাঁদের জন্য নানামুখী কর্মকান্ড পরিচালনা করা। প্রবীণ বয়সে সবার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা এবং চিন্তাভাবনাহীন শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় জীবনযাপনের দিকনির্দেশনা দেওয়া।
প্রবীণদের প্রধান সামাজিক সমস্যাসমুহ:
১) আর্থিক সহায়তা ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের অভাব প্রবীণদের একটি বড় অংশকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে দেয়।
২) বার্ধক্যজনিত রোগ, যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হদরোগ, কিডনী জটিলতা ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যার চিকিৎসা সুবিধার অভাব প্রবীণদের ভোগান্তি বাড়ায়।
৩) একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে প্রবীণরা একা হয়ে পড়ছেন, যার ফলে তাঁরা অবহেলা ও একাকিত্বের শিকার হচ্ছেন।
৪) নগরায়ণ ও আধুনিকীকরণ প্রবীণদের জীবনধারাকে প্রভাবিত করছে, যার ফলে তাঁরা সমাজে নিজেদের মূল্যহীন মনে করেন।
৫) আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং পর্যাপ্ত বিনোদন কেন্দ্র ও আবাসন ব্যবস্থার অভাব প্রবীণদের জীবনকে কঠিন করে তোলে।
৬) আধুনিক সমাজের অংশ হিসেবে পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তন হওয়ায় প্রবীণরা অনেক সময় নিজেদের পরিবারেই অবহেলিত হন।
৭) প্রবীণরা চুরি, নির্যাতন এবং অন্যান্য সামাজিক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন, যার কারণে তাঁদের নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগ।
বড় দুখের বিষয়,যে হাতে একদিন সন্তানের মুখে আহার তুলে দিত সে হাতই প্রবীণদের চোখের পানিতে ভিজছে। তারপরেও বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা পরিবারে ঘরের কোণায় একাকী বসে প্রিয়জনকে একপলক দেখার আশায় যেন বেঁচে আছেন তাঁরা। নিজ ঘরে বা ঘরের বাহিরে প্রবীণরা অনেকেই শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন বছরের পর বছর, আর এই মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কেউ বা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে একটু স্বাধীনভাবে বাঁচার আশায় । বাড়ীর পথ ভুলে কেউ বা পড়ে থাকচ্ছেন পথে ঘাটে, কেউ বা যন্ত্রণায় মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছেন বাধ্য হয়ে। যদিও আমি এখানে উল্লেখ করতে চাচ্ছি না, এমনও অনেক শিক্ষিত সন্তান বড় বড় পেশায় নিয়োজিত আছেন তাঁদের পিতামাতাও একরকম মনের কষ্ট নিয়েই বৃদ্ধাশ্রমে দিনাতিপাত করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্ত:প্রজন্ম সংযোগ তৈরীর পাশাপাশি বয়স্ক ভাতা বৃদ্ধি করা অতি প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ্যের উপরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধিত এনজিও রয়েছে এর মধ্যে হয়তো ৫টি এনজিও পাবেন না যারা প্রবীণদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে কাজ করছে। এর কারণটা হলো প্রবীণদের নিয়ে কাজ করলে দেশী বিদেশী অর্থ সহযোগিতা নাও পেতে পারে। আর তাই সরকারের প্রয়োজন প্রবীণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা গ্রহনণ করা। জন্মের পর যে সন্তান নিজের বাবা মায়ের হাত ধরেই খুঁজে পেয়েছিল অবলম্বন আজ সেই সন্তানদের অবহেলা, নির্যাতনেই অনেক প্রবীণ শেষ অবলম্বন খঁজে নেন বৃদ্ধাশ্রমে। দেখুন বৃদ্ধশ্রমে কেউ কারোর আপন নয় তবু সবাই এখানে একে অপরের গল্পে নিজেকে খুঁজে নেয়, পায় স্বান্তনা। যে প্রবীণদের অবদানে রচিত হয় আমাদের বর্তমান, অথচ পারিবারিক অবহেলা ও নির্যাতনে একসময় তাদেরই শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। আর এতেই বোঝা যায় প্রবীণরা বয়সের ভারে নয় অবহেলার ভারে নুয়ে পড়ছে ।
তাই আসুন আমরা প্রবীণদের অধিকার আদায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমাজ সেবার সাথে একসঙ্গে কাজ করি । আজ প্রবীণ দিবসে বাবা মায়েদের বলছি, সন্তানদের নিজের সর্বস্ব দিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি একজন সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন, সাথে সাথে সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি, পিতামাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে ধর্মীয় অনুশাসন কি বলে সে বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরার জন্য । তাহলে সেই সন্তানই হবে একদিন- বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রবীণদের প্রত্যাশা, কল্যাণ ও অধিকার আদায়ে এবং সার্বিক কর্মকাণ্ডে প্রবীণদের জন্য চালিকাশক্তি।
লেখক: সাংবাদিক ও সহ-সভিাপতি, প্রবীন হিতৈষী সংঘ, মেহেরপুর জেলা।