মেহেরপুর জেলার সীমান্তে কৃষকদের জমিতে ফসল তোলার ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাধা প্রদান করছে। ওপারে নিজ ভূখন্ডে বিএসএফের প্রহরা ও টহল জোরদার করেছে।
ভারত ভুখন্ডে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে ১৫০ গজের মধ্যে থাকা ভারতীয় কৃষকদের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ বন্ধ, ভারতীয় কৃষকদের জমির আইল কাটাতেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিএসএফ মাইকিং করছে।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীও (বিজিবি) সীমান্তে না যাবার জন্য নিজ দেশের কৃষকদের আহবান জানিয়েছেন মসজিদের সাউন্ড সিস্টেমে। যা উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে কৃষকদের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
মেহেরপুর সীমান্তে কাঁটাতারের এপারে ১৫০ গজের মধ্যে ভারতীয় জমিতে বাংলাদেশী কৃষকরা বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে আসছে বহুবছর ধরে। কাঁটাতারের বেড়া দুই বাংলার মানুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে পারলেও ভাঙ্গেনি তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
ভারতীয়রা তাদের অনাবাদি জমি বাংলাদেশি কৃষকদের লিজ দিয়ে চাষাবাদ করতে সহায়তা করে আসছেন। গত মঙ্গলবার ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বোমা হামলার পর ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যার অংশ হিসেবে সীমান্তের কাটাতারের বেড়ার এপারে ১৫০ গজের মধ্যে ভারতীয় কৃষকদের ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এই পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের কৃষকদের জমিতে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। যা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে প্রভাব ফেলছে।
গতকাল সরেজমিনে বেলা ১০টার দিকে মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাঁঝা সীমান্তে গিয়ে দেখা যায় সীমান্ত এলাকায় চাষাবাদের কৃষকদের চোখে মুখে আতংকের ছাপ।
ঝাঁঝাঁ ক্যাম্প এলাকার সামাদ আলী জানান, ওপারে বিএসএস ক্যাম্প থেকে মাইকিং করা হয়েছে সীমান্তের এপারে ভারতের ১৫০ মিটারের জমিতে বাংলাদেশের কোন কৃষককে না যাওয়ার জন্য। ফলে কেউ জমিতে চাষাবাদে যেতে সাহস পাচ্ছে না। একই গ্রামের দাউদ হোসেন জানান- সীমান্তে নোম্যান্স ল্যান্ডে ভারত অংশের কাাঁটাতারের বেড়ার এপারে ১৫০ মিটারের মধ্যে ভারতের কৃষকদের প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমি এপারের কৃষকরা বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। প্রতিবিঘা জমিবাবদ বার্ষিক ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় বর্গা নেয়া হতো। বিএসএফের নিষেধাজ্ঞার পর আবাদি জমির ফসল তুলতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।
দুলাল শেখ নামের এক কৃষক বলেন, বর্গা নেয়া দেড়বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে ভুট্টা সংগ্রহ করেছি। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর ভয়ে ওইসব জমিতে চাষাবাদের আগ্রহ হারিয়েছি।
ঝাঁঝা ক্যাম্পের কমান্ডার হারুন অর রশিদ বোন তথ্য দিতে অপরাগত প্রকাশ করলেও তিনি জানান গ্রামের মসজিদ থেকে কৃষকদের বর্গা নেয়া জমিতে না যাবার জন্য আহবান করা হচ্ছে প্রতিদিন।
মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী ইচাখালী সীমান্তে ৫৬টি দাগে ৭৪ বিঘা ৫ কাটা জমির মালিক ২৮ জন মালিক বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে বেশীর ভাগই বুড়িপোতা ইউনিয়নের গোভিপুর গ্রামের বাসিন্দা। এই জমিগুলোর মালিকানা নিয়ে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও এখনও কোন স্থায়ী সমাধান হয়নি। এসব জমি দেশভাগের সময় ভারতের অংশে চলে যায়। তবে বাংলাদেশী কৃষকরা সেগুলো বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিষেধাজ্ঞার কারণে কৃষকরা তাদের জমিতে ফসল তুলতে পারছেন না। আবার ভারতের কৃষকরাও ওই জমিতে আসতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশের অনেক জমি অতিক্রম করে ওই ৫৬ দাগের জমিতে তাদের আসতে হবে।
মেহেরপুর জেলার তিনদিক ভারত সীমান্ত বেষ্টিত। সীমান্তের মোটদৈর্ঘ প্রায় ৮৯ কিলোমিটার। এই সীমান্তটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে সংযুক্ত।
মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী তিনটি উপজেলা মুজিবনগর, গাংনী ও মেহেরপুর সদর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবীননগর, শিকারপুর, তাজপুর, ভাদুপাড়া, নবচন্দ্রপুর, লালবাজার, করিমপুরসহ অনেকগুলো গ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত।
এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে দুই দেশের বাসিন্দাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে ৭৪টি সীমান্ত গেট রয়েছে। যেগুলো দিয়ে প্রতিদিন অন্তত সহস্রাধিক ভারতীয় কৃষক কৃষিকাজ করতে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে নিজ জমিতে আসেন। অজানা আতংকে তারাও এপারে তেমন আসছে না। যারা আসছে তারাও বিএসএফের প্রহরায়।
ভারতের নিকটবর্তী বিজিবির ইচাখালী সীমান্তে গিয়ে দেখা যায়-ইচাখালী বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার হারুন অর রশিদ দুজন সিপাহী নিয়ে সীমান্তের ভারতের নবচন্দ্রপুর বিএসএস ক্যাম্পর নিকটবর্তী বাংলাদেশ অংশে একটি বাগানে অবস্থান করছেন। তিনি নোম্যান্স ল্যান্ডে যেতে বারণ করেন।
তিনি বলেন, ওপারে ভারতের নবচন্দ্রপুর বিএসএফ ক্যাম্প সদস্যরা অস্ত্র তাক করে অবস্থান করছেন। আমরা গ্রামের মসজিদ থেকে প্রতিদিনই মাইকিং করছি সীমান্তের কোন জমিতে না যাবার জন্য। কারণ ভারতীয় কৃষকদের জমি বর্গ নিয়ে চাষাবাদ করা আইনত দণ্ডনীয়।
এই পরিস্থিতিতে, সীমান্তবর্তী কৃষকদের জমিতে প্রবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। এবং কৃষকদের মধ্যে সচেতনতাবৃদ্ধির এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।