
আজকাল শীশুদের দিন রাতের অধিকাংশ সময়কাটে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাব বা অন্যান্য ইন্টারনেট কানেকটেড আধুনিক ডিভাইসের সাথে। বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে ডিজিটাল সামাজিক সংকটের যুগ। এই সমস্ত ডিভাইসের কারণেই সমাজে শীশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্রমেই ঝুকিপূর্ণ আকার ধারণ করছে। একক পরিবার, চাকুরীজিবী বাবা-মায়ের সময়ের অভাব ছাড়াও স্কুল সময়ের বাইরে সন্তানদের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য অভিভাবকরা অনেকটা নিরুপায় হয়েই সন্তানের হাতে স্মার্ট ডিভাইসগুলো তুলে দেন। অনেক বাবা মা বা কাজের বুয়া ছোট সময় থেকেই বা”চাদের জিদ থেকে দুরে সরানোর জন্য পশুপাখি, কার্টুন ইত্যাদি দেখিয়ে খাওয়ানো বা ঘুমাতে অভ্য¯’ করেন। এখান থেকেই শুরুহয় আসক্তি। এর পরথেকেই শীশুদের যাপিত জীবনের দৃশ্যপট দ্রুতই বদলাতে থাকে। স্কুলের অবসরে,বাবা মার সাথে বেড়ানো বা ঘোরার সময়,যানবাহনে বসেও আজকাল চোখে পড়ে দুনিয়া ভুলে শীশুরা আপনমনে স্মার্টফোনে চোখ রেখে বসে আছে। এখন বা”চাদের প্রধান অনুসঙ্গ বা সাথী হয়ে গিয়েছে আপনজন নই,তার হাতের স্মার্টফোনটা।
একটু বড় হলে এরা গেম খেলে, টিক টক সহ অনেক অনাকাঙ্খীত সাইটে ঘােরাফেরা শুরু করে। আস্তে আস্তে তারা ডুবেযায় অবাস্তব জগতের অতল গহীনে, এখান থেকে তাদের আর বাস্তব জগতে ফেরানো সম্ভব হয় না। ভার্চুয়াল জগতের মোহে এরা হয়ে ওঠে ভিনজগত-সভ্যতার কোন অজানা মানুষ। হারিয়ে ফেলে মানুষ্য সমাজের স্বভাবিক রীতিনিতী, আচার-আচরণ বা মানবিকতাবোধ। এরা অনেকটাই মূল্যবোধহীন, দায়বদ্ধহীন যন্ত্র মানবে পরিনত হয়। একাকী থাকা, কারো সাথে না মেশা। কোন সামাজকি বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়া, মানুষকে এড়িয়ে চলা এদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিনত হয়। শুধু তাই নয়, বয়সের সাথে সাথে এরা মাঠেগিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান বা খেল-ধুলাা দেখে না, ঘরেবসে স্ক্রীনে দেখতে ভালবাসে। ঠিকমত ঘুম, খাওয়া দাওয়া না করা ,অগোছালো থাকা এদের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ঠ হয়ে উঠে। অল্পেতে এদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, সামান্য কারণে অতিরিক্ত প্রতিক্রীয়া দেখানো বা কখনো আপন পর নাদেখে গায়ে হাত তোলার মত অপকর্ম করতেও এরা দ্বিধা করে না।
এ ধরণের জেনারেশন নিয়ে আজকাল অভিভাবকরা যেমন দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত তেমনি সমাজও বিব্রত বটে। উদ্বেগের বিষয় হল এমন আসক্তির ফলে বেড়ে ওঠা প্রজন্মদিয়ে একটি ভবিষ্যত রাষ্ঠ্রীয় কাঠামো ঠিক রাখোর জন্য যে পরিমানে কাঙ্খিত তরুণ প্রজন্ম প্রয়োজন সেই মানের শাররীক গঠন, মেধা ও মননশীল জেনারেশন পাওয়া কি সম্ভব? এটা এক কঠিন প্রশ্ন। এমন জেনারেশন বিধংশী কর্ম কান্ডে পুরো জাতি আজ চিন্তিত।
বর্তমান সময়ে শহুরে ও শিক্ষিত পরিবারের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় তাদেও সন্তান সংখা তুলনামুলক কম। বড়জোর একটা সন্তানই বেশি,বড়জোর দুটো। আজকাল প্রবাসি ও মধ্যেবিত্ত পরিবারের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে যোগাযোগের জন্য একটা স্মার্টফোন পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয়। অনেকে আবার বা”চাদের সখ মেটানোর জন্য তাদের হাতেও তুলে দেন একাধিক স্মার্ট ডিভাইস। আবসরে মায়েরাও চ্যাট করেন,মার্কেটে ঘোরেন, অনলাইনে কেনাকাটা করেন। রান্নার রেসিপি দেখেন কিছু না হলে টিকটক নিয়ে মগ্ন থাকেন। বা”চাদেও জন্য দেওয়ার মত সময় থাকে না। কারণে অকারণে বা”চাদের জন্য অনলাইনে খাবার অর্ডার করেন,যার অধিাকাংশই ফার্স্টফুড। শাররীক শ্রমছাড়া খাবার গ্রহণই সন্তানদের ওজন বাড়ার জন্য যথেষ্ঠ। বর্তমানে দেশের শীশুদের ওবিসিটি বাড়ার এটাও একটা অন্যতম কারণ। শিশুদেও মুটিয়ে যাওয়া ও কর্মে অনিহার প্রবনতা একসুত্রেগাথা। এই অব¯’ার নিরসনে অব¯’া সম্পন্ন পরিবারের বাবা-মার মধ্যে সঠিক মাত্রায় সন্তানদের শাররীক শ্রমে উৎসাহিত করারমত আগ্রহটুকুও তেমন দেখো যায় না।
অধীকাংশ আভিভাবক বলে থাকেন যে, বা”চাদের হাটাচলা, খাওয়া ঘুমানো, এমন কি পড়ার সময়েও এক প্রকার বাধ্য হয়েই মোবাইল দিতে হয়। নিষেধ করলেও কাজ হয়না। বরং জিদের বসে খাওয়া বন্ধ করে বা জিনিষপত্র ভাংচুর করে। এ নিয়ে আত্মহননের মত ঘটনাও রিরল না। একটু বড়দের আচরণীক দিকটা হয় ভিন্ন। চুপচাপ ভাল মানুষের অন্তরালে নির্জন ¯’ান বা কক্ষেই এদের একমাত্র ভ’বণ। এরা ফেসবুক,ইউটিউব,টিকটকের গন্ডিপেরিয়ে চলে যায় গেম সাইেটে, নিষিদ্ধ পেজে। টাকার বিনিময়ে খেলে জুয়া, সারারাত ধরে চলে নিষিদ্ধ চ্যাট। আস্তে আস্তে শুরু হয় অসামাজিক সম্পর্ক ¯’াপন, মেয়েদেও প্রলুব্ধ করা,সমপ্রেমাসক্তি বা ভাগিয়ে নেওয়া, প্রতারণা সহ এক সময় সব ধরণের নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ে। কেউ হয়ে ওঠে গ্যাং লিডার। যাকে আর কখনোই স্বাভাবিক জগতে ফেরানো সম্ভব হয় না।
মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলিস্টরা এই উপসর্গকে ডিজিটাল মাদক হিসেবে আক্ষায়ীত করে ’২০ এর দশকেই সরকারকে সতর্ক করে ছিলেন। এর পর থেকেই উন্নত বিশে^ মোটামুঠি বিষয় গুলো বা”চাদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য স্কুলের নিয়ম ও কারিকুলামে অনে ব্যাপক পরির্বতন। যার সাথে অভিভাবক বৃন্দও জড়িত থাকেন বাধ্যতামুলক ভাবে। কিš‘ দুঃজনক হলেও আমাদের দেশে বিষয়গুলো একদম ল্যাজে গোবরে অব¯’া। এর ক্ষতিকর দিকগুলো আমরা দেখছি, এবং ভয়াবহতা উপলব্ধি করছি কিš‘ এখনও কোন করণীয় নির্দ্ধারণ করতে পারছি না এটাই বাস্তবতা। এটা নিয়ে ব্যাপক কোন গবেষণার বা কারো কোন মাথাব্যাথার কথাও কখনো শোনা যায় না।
ভারতের চার্টার বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, স্ক্রীন আসক্তির জন্য বড়দের চোখের রেটিনা, কার্নিয়া সহ অন্যান্য অংশের যেমন ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীশুদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যার পাশাপশি ক্ষুধামন্দা,অতিরিক্তক্ষুধা,অনিদ্রা, বান্ধব হীনতা,আগ্রাসি মনোভাব ও আত্মবিশ^াসহীনতা প্রকট আকার ধারণ করে। এই বিষয়ের উপরে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেন্সসনের পক্ষ থেকে ১৯২২ সনে আমাদের দেশে একটি জরিপ পরিচালিত হয়েছিল। রিপোর্টে দেখা যায় বাংলাদেশের ৪-১৭ বয়সি ৬০ লক্ষ শীশু কিশোর শুধুমাত্র ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তির কারণে শাররীক সমস্যা ছাড়াও নানাবিধ মানসিক জটিলতায় আেক্রান্ত। বর্তমানে এই সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগন মনে করেন। এই অব¯’াথেকে বেরিয়ে আসার সহজ কোন পথ দেশে এখনও পরিলক্ষিত হয় না। এদেশে এখনো মানুষের শিক্ষা, আর্থসামাজিক অব¯’া ও মানুষের জীবনজাপন প্রকৃয়ার মধ্যে রয়েছে বিরাট অসমঞ্জস্যতা ও অস”ছতা। এমন অসম সমাজে র্দূবৃত্যায়ন থাকে সহজাত। সরকারী সদি”ছা,সমাজ সচেতনা,কিছু কিছু ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রন ও বিকল্প বের করতে পারলে এই অসহায় অব¯’া থেকে পরিত্রান পাওয়া অসম্ভব কিছু না। উন্নত বিশে^র দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রনের জন্য সমস্যাগুলো আমাদের মত এত প্রকট না।
সমাজ বিজ্ঞানিদের মতে দেশ ও জাতির সার্থেই সমস্যার মধ্যেথেকেই আমাদের যথার্ত সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। শীশুরা স্বভাবগত ভাবেই প্রকৃতি প্রেমিক হয়ে থাকে। প্রকৃতির মধ্যে বেড়াতে খেলেতে তারা পছন্দ করে। ফলে স্কুল কম্পউন্ডে প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা সহ শহর ও গ্রাম পর্যায়েও শিশুতোষ র্পাক ¯’াপন জরুরী। প্রতিদিন অন্তত ঘন্টাদুই শীশুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি,খেলাধুলা করলে বা প্রকৃতির উপাদানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ওরা মানসিক দিক থেকে পজেটিভ চিন্তা করতে শেখে। এক ঘেয়েমি দূর করতে তাদের নিয়ে গ্রামেরবাড়ি,যাওয়া বোনভোজন,সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও বা”চারা প্রচুর উৎফুল্ল হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক হয়ে ওঠে। সম্ভব ও সমর্থ অনুযায়ী একটু দূরে কোন পর্যটন ¯’ান বা ভ্রমন কেন্দ্রে ঘুরেআসা যায়। আবার পাঠ অভ্যাস বাড়ালে নিজেদের মোবাইল আসক্তি অনেকটাই কমে আসে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। শিশুদের মানসিক বিকামের জন্য বাবা মাকেই র্সবাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে হতে হবে সচেতন। বাবা মাকেও পাঠ অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দেশবিদেশের গল্প- ছড়া শোনাতে হবে এবং ধীরে হলেও বই এর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। শীশুরা সব সময় রঙিন জগৎ ও প্রকৃতির সব উপকরণকেই নিজের মতকরে দেখে,কল্পনাকরে তাই চেস্টা করতে হবে ঘরের একটা কর্ণার শিশুতোষ সো-পিস, বই ও আসবাবদিয়ে যেন সাজানো থাকে সেদিকটা খেয়াল রাখেেত হবে। আমরা হয়ত আমাদের সময়ের সাদাকালো যুগের মা,দাদি নানির আচঁলের তলায় শুয়ে ঠাকুমার ঝুলি বা শিব্রাম চক্রবর্তী বা”চাদের শোনাতে পারব না বা পারব না পুতুল খেলতে, বাতাবি লেবুর বল দিয়ে ঝুম বৃস্টির মধ্যে বল খেলতে অথবা নদীরপাড়ে কাদা মাটিতে ওয়াটার ডাইভ দিতে। কিš‘ সামর্থের মধ্যে বা”চাদের উপরে রাগ বা বিরক্ত না হয়ে তাদেও ই”ছাকে প্রধান্য দিয়ে কিছুটা সময়তো দিতে পারি? সন্তানদের সাথে ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক আচরণ, অভিবাদন, আপ্যায়ন সব সময় ঠিক রাখতে হবে এবং বিষয়গুলো তাদের মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ছোট থেকে শীশুদের যেমন ধর্মীয় কাজে যুক্ত করতে হবে তেমনি সামাজকি ও সে”ছাসেবি সংগঠনের সাথে তাদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ করেদিতে হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলের পরিবেশ ও আচরণ হতে হবে শীশুবান্ধব ও সামাজিক পরিবেশমন্ডিত এমনটাই সবার প্রত্যাশা। এভাবেই একদিন শীশুদের মাঝে পরপকার ও আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে আসবে।
সমজবিজ্ঞানিরা মনে করেন র্স্মাটডিভাইস বন্ধ করা সম্ভব না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে, পড়া ও বেড়ানোর সময় র্স্মাট ডিভাইস নিয়ন্ত্রনে সরকার,শিক্ষক,অভিভাবক ও সচেতনদের আন্তরিকতা ও সদি”ছাই আমাদের আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথে চলতে অনেকটাই সহায়ক ভ’মিকা রাখবে।
লেখক: অবঃ শিক্ষক গাংনী ডিগ্রি কলেজ।