
আজকের পৃথিবীতে “নারীর স্বাধীনতা” কেবল একটি শব্দ নয়—এটি একটি সমাজকে বদলে দেওয়ার শক্তি। স্বাধীনতা মানে শুধু বাইরে কাজ করার সুযোগ নয়; স্বাধীনতা মানে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মেয়েদের ইচ্ছা–অধিকার–স্বপ্নকে অনেক সময়ই তুচ্ছ করে দেখা হয়। অথচ সমাজ যত আধুনিকই হোক, নারীর স্বাধীনতা ছাড়া কোনো উন্নয়নই সম্পূর্ণ হতে পারে না।
একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী সামনে এগোয়, প্রযুক্তি বদলায়, সভ্যতা উন্নত হয়—কিন্তু নারীর স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্নগুলো এখনো একই জায়গায় ঘুরপাক খায়। নারী স্বাধীনতা আসলে কী? “নারীর স্বাধীনতা” আজও একটি আলোচিত, বিতর্কিত এবং একই সঙ্গে জরুরি বিষয়। শব্দটি যতটা সহজ, বাস্তবে তার প্রয়োগ ততটা কঠিন। কারণ স্বাধীনতা মানে শুধু বাইরে কাজ করার অনুমতি নয়; স্বাধীনতা মানে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার। আর এই অধিকার অর্জনের পথেই সবচেয়ে বড় বাধা—সমাজের চোখে আজও নারীর প্রতি অদৃশ্য বৈষম্য।
শিক্ষার অধিকার, কাজের সুযোগ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা—এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি থাকলেও বাস্তবতার চিত্র পুরোপুরি উজ্জ্বল নয়। শহরের নারী হয়তো কিছুটা এগোতে পেরেছে, কিন্তু গ্রাম থেকে শহরতলি—এখনও অসংখ্য নারী বাল্যবিয়ে, যৌতুক, সহিংসতা, কর্মসংস্থানের অভাব আর সামাজিক নজরদারির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের স্বাধীনতা এখনও “সমাজ কি বলবে”—এই চার শব্দের কাছে বন্দি।
একজন নারীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে পরিষ্কারভাবে ওঠে আসবে নারীর জীবন কতটা ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার পেছনে যে কেবল পুরুষ সমাজ দায়ী তা নয়, বরং নারী ও পুরুষ সমানভাবে দায়ী।আমরা কথায় কথায় পুরুষের দোষ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু নিজেদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কখনোই মুখ খুলি না। নারীবাদী হতে গিয়ে, আমরা অনেকটাই পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছি, যা আসলে আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে শেখায়। কিন্তু নারীরা যদি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শেখে, নিজের জায়গাটা নিজে চিনে নিতে শেখে, পুরুষের সাধ্য নেই নারীকে আটকানোর।
নারীর স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় বাধা হলো সমাজের সেই অদৃশ্য দেয়াল, যা চোখে দেখা যায় না—কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে আটকে ধরে। স্কুলে পড়াশোনা করতে গেলে “মেয়ে হয়ে এত দূর যাবে?”, চাকরি করতে চাইলে “বাড়ির কাজ আগে শেখো, সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে “এইসব বিষয়ে মেয়েদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই—এই সব কথাই যেন তার চারপাশে অদৃশ্য শৃঙ্খল হয়ে থাকে।এক শ্রেণির জনগোষ্ঠী আছে যারা উগ্রতার দোহাই দিয়ে নারী স্বাধীনতাকে কৌশলে ধ্বংস করার চেষ্টায় মত্ত। আরেক ধরনের জনগোষ্ঠী নারী স্বাধীনতার আড়ালে উগ্রতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত। নারী স্বাধীনতা মানে উগ্রতা নয়। তাই নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হোন, উগ্রতায় নয়।স্বাধীনতার আসল অর্থ হলো—নিজের সিদ্ধান্ত নিজের হাতে থাকা, নিজের জীবনের দিশা নিজে বেছে নেওয়া, এবং নিজের সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে পারা।
নারী যদি নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তাহলে সে শুধু ব্যক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়ে না; পুরো সমাজই পিছিয়ে যায়। কারণ পরিবার, অর্থনীতি, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান অপরিসীম। একজন নারী যখন শিক্ষিত হয়, কর্মক্ষম হয়, নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়—তখন শুধু সে নয়, তার পরিবার থেকেও শুরু হয় বদল। একজন শিক্ষিত মা পুরো প্রজন্মকে বদলে দিতে পারে। তাই নারীর স্বাধীনতা মানে ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করা।
আমাদের সমাজে এখনো অনেক মেয়ে নিজের স্বপ্ন চাপা রেখে বাঁচে। কারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় বিয়ের চাপে; কারও চাকরির স্বপ্ন অন্ধকারে হারিয়ে যায় পরিবার–সমাজের ভুল ধারণায়। অথচ অধিকার চাওয়াটা কোনো অপরাধ নয়—এটা মানুষের জন্মগত অধিকার। নারীকে সম্মান দেওয়া মানে সমাজকে সম্মান দেওয়া। কারণ সমাজ চলে নারী–পুরুষ—দুজনের সমান অবদানে।
নারীর স্বাধীনতা রুখে দেওয়া মানে শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নয়—অনেক সময় নারীরাই নারীর পথ আটকে দেয়। “মানুষ কি বলবে”—এই ভয়ের বাঁধন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে যাচ্ছে।পরিবর্তন শুরু করতে হবে ঘর থেকে। মেয়ে-ছেলে উভয়কে শৈশব থেকেই শেখাতে হবে—সমতা মানে প্রতিযোগিতা নয়, সম্মান।
আজ দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারীকে বন্ধন নয়—সমর্থন দিতে হবে; সন্দেহ নয়—বিশ্বাস দিতে হবে। মেয়েরা যখন নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে, তখন তারা শুধু নিজের জীবনই আলোকিত করে না; পুরো সমাজকে আলোকিত নারীর স্বাধীনতা তাই কোনো দাবি নয়—এটা প্রয়োজন, এটা ভবিষ্যতের ভিত্তি।
সময় এসেছে—নারীকে তার প্রাপ্য স্বাধীনতাকে সত্যিকারের সম্মান দেওয়ার।নারীর স্বাধীনতা কোনো উপকার নয়, কোনো দয়া নয়—এটি তার জন্মগত অধিকার।যেদিন সমাজ এই সত্যকে স্বীকার করবে, সেদিনই আমরা সত্যিকারের অর্থে আধুনিক হব।