হুমকির মুখে মেহেরপুরের দলিত জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা

মাহাবুব চান্দু

ভাষা একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। জাতিসত্তা বিকাশের অপরিহার্য মাধ্যম। আর্ন্তজাতিক মার্তভাষা দিবসের বিশ্ব স্বীকৃতিতে আমারা যেমন সম্মনিত হই, মহিমান্বিত হয় আমাদের ভাষা প্রেম ও চেতনা,তেমনি আমাদের উপর আরোপিত হয় এক অনিবার্য দায়িত্ব। বাংলা ভাষার প্রতিতো বটেই অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতির প্রতিও থাকা উচিৎ সহমার্মীক সম্পর্ক ও সম্মান। ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন হতে যাওয়া ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহু ভাষা ভিওিক শিক্ষার প্রসারণ,ভাষাগত সাংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রমূল্য নির্ধারণ ও উন্নয়ন,কলোনিয়াল আগ্রাসন থেকে ভাষাকে রক্ষা করতে মার্তৃভাষাকে বিকাশিত হওয়ার সুযোগ ও মর্যাদাদান । তা না হলে, ভাষার লডাইয়ে নেতৃত্বদানকারী জাতি হিসেবে এটি হবে লজ্জার; ভাষা শহিদের প্রতি হবে চরম অপমান।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভাষার সংখ্যা ৪৮টি। উপজাতির ভাষা ৩২ টি। ১১ ভাষা বিপন্নের পথে। ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন ৩ টি, এর মধ্যে কোদা, মেনাম, পাঙ্গুখুয়া।
প্রতিটি জাতির মাতৃভাষা সে জাতির অস্বিত্বের সাথে জড়িত। মাতৃষাভা সব দেশে, সব মানুষের জীবনে একটি গর্বের বিষয়। এর অন্যতম কারণ- মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই মানুষ তার অবস্থান স্বপ্ন ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেন। মাতৃভাষার স্থান স্ব-স্ব জাতির হৃদয়ের গভীরে।

মেহেরপুরে দলিত হরিজন গোষ্ঠীর মার্তৃভাষা ভোজপুরী। প্রায় ৮ থেকে ৯ শত মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। ঘটন, সাধন, মন্টু, নিমাই এরা সকলেই রবিদাস সম্প্রদায়ের মানুষ। জুতা, স্যান্ডেলের মেরামত কাজের সাথে জড়িত। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় ভাবে নতুন জুতা স্যান্ডেল তৈরি করে বিক্রয় করে। স্থানীয়ভাবে এদের মুচি হিসেবে চেনে সকলে।

সাধন রবি দাস বলেন-৩০ বছর আগে আমরা সকলের সাথে খুব বেশি মিশতে পারতাম না। তখন আমাদের নিজেদের মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বেশি চর্চা হতো। এখন সময় পাল্টেছে- সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মেলা মেশার সুযোগ হয়েছে। বেশি সময়ই বাংলাতে কথা বলতে হয়। পরিবারের সদস্যদেরও একই অবস্থা। সেই হিসেবে চর্চার অভাবে আমাদের ছেলে মেয়েরা নিজেদের ভাষা প্রায় হারাতে বসেছে।

ভোজপুরী ভাষা ভারতের পূর্ব-উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিম বিহারের বেশকয়েকটি জেলার মূখ্য ভাষা। নেপালের তবাই অঞ্চলেও এই ভাষা বহুল প্রচলিত। ৫ কোটি ৫ লক্ষ মানুষ এই ভাষাতে কথা বলে (২০১১সালের জণগণনা)।

বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রঅজয় বাঁসফোড় বলেন- আমরা মায়ের ভাষাকে মাতৃভাষা বলি। আমরা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ, আমাদের মাতৃভাষা হলো ভোজপুরী। কিন্তু আমরা স্বাধীন ভাবে নিজের ভাষায় কথা বলে চলাফেরা করতে পারি না। যার কারণে এ ভাষার অবসান হতে চলেছে। আমরা যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বা জায়গাতে বসবাস করিনিজেদের মায়ের ভাষা ব্যবহার করলে মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যার কারণে আমাদের পরিচয় দিলে তারা অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখে। আমরা স্কুল- কলেজে গেলে নিজের ভাষা, বাংলা ভাষা হতে ভিন্ন তাই অন্যের সাথে কথা বলতে বা পরিচয় দিলেবিভিন্ন সমস্যা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। এ কারণে আমাদের বেশি ভাগ শিশু লেখা-পড়া করতে চায় না এবং অশিক্ষিত বেশি। এ ভাবে চললে দেখা যাবে নতুন প্রজন্ম এ ভাষা আর হয়ত নাও রপ্ত করতে পারে।

লক্ষি বাঁসফোড় (স্টেডিয়াম পাড়াতে ভাড়া থাকে) বলেন- আমি বাসা বাড়িতে ভাড়া থাকি। পাড়া পড়শির ভয়ে আমি ভোজপুরী ভাষাতে কথা বলতে পারি না। যার কারণে আমার ছেলে-মেয়ে ভোজপুরী ভাষায় কথা বলতে পারে না।

শাওন বাঁশফোড় বলেন- আমি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। অমি যখন স্কুলে বা খেলার মাঠে ভোজপুরী ভাষায় বলি তখন অন্যান্য বন্ধুরা হাসা-হাসি করে। তাই আমি ভোজপুরীতে বলি না।
গাংনীর দলিত হরিজন পল্লীর প্রায় ৫০ জন মানুষ ভোজপুরী ভাষায় কথা বলে। এদের আদি নিবাস বিহার। তবে অনেকের জন্মই বাংলাদেশের দিনাজপুরে। গাংনীতে বসবাস প্রায় ৪০ বছর যাবৎ।

এদেশে জন্ম হলেও এরা মাতৃভাষা ভোজপুরী ভুলে যায়নি। পরিবারের সকলে মিলে মিশে অতি অল্প জায়গায় এরা বসবাস করে। গোত্রের লোকজন নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষা ভোজপুরীতে কথা বলে। তবে অন্যদের সহিত বাংলা ভাষাতেই মনের ভাব বিনিময় করে।

দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শ্রী মানিক বাঁসফোড় বলেন -ভোজপুরী এবং বাংলা দুটো ভাষায় তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং দুটোর প্রতিই তাদের সমান ভালবাসা।
শ্রী বাবু বাঁসফোড় বলেন – চর্চা না থাকায় লিখিত রুপ তাদের জানা নেই। তবে তারা মাতৃভাষা ভোজপুরী ভুলে যায়নি। পরিবারের সদস্য ও গোত্রের সদস্যদের মধ্যে এই ভাষাতেই মনের ভাব বিনিময় করি।

শ্রী প্রদীপ বাঁসফোড়- নিম্ন লিখিত বাক্যের সুন্দর অনুবাদ করে শোনান- আপনার নাম কি? অনুবাদ করতে বললে তিনি বলেন ( তোহার নাম কাহা?), বাড়ি কোথায়? ( ঘর কাহা?) তুমি কোন ক্লাসে পড়? ( কোন ক্লাস মে পড়েলিস?), মা আমাকে ভাত দাও ( এই মায়ে ভাত দে), খাতায় লিখতে দেখে শ্রী পারুল বাঁসফোড় বলেন ভাষা কাহে লিখওয়াতা? ( ভাষা কিসের জন্য লিখছেন?)

সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে প্রধ্যান্য দিয়ে অন্য সব ভাষার বিরোধিতা করলে- অনেক জণগোষ্ঠীই তাদের মাতৃভাষাকে হারিয়ে ফেলবে। বাঙলা ভাষার গৌরব রক্ষার নামে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়াহচ্ছে। অথচ এদেশে বসবাস করছে অনেক নৃ-গোষ্ঠী বা হরিজন সম্প্রদায় যাদের নিজস্ব ভাষা অছে।

কবি, ছড়াকার ও শিক্ষক ইয়ামিন হাসান বলেন- “প্রতিটি মাতৃভাষাকেই মর্যাদা দিতে হবে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যখন স্বীকৃতি দেওয়া হলো সেখানে সুস্পষ্ট ভাবে এটি উল্লেখ ছিল। বাঙ্গালী একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য লড়াই করেছিল। আমাদের দেশের অন্যান্য ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের জন্য যদি রাষ্ট্রিয় ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয় তাহলে এই ভাষাগুলো বিলুপ্ত হবে। যেটা ভাষার জন্য নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশে^র কাছে লজ্জিত হবে।”

লেখক ও শিক্ষক শাশ^ত নিপ্পন বলেন- ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সন্তানদের নিজ নিজ ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রনয়নের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলে ভাষাগুলো বেঁচে থাকবে।

মেহেরপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিন ধুমকেত বলেন- আমরা ভাষার জন্য লড়াই করেছিলাম। এটা আমাদের গর্বের অর্জন। ভাষাকে ঘিরেই মানুষের আত্মবিকাশের সুযোগ ঘটে। ভাষা বিলুপ্ত হলে অত্মবিকাশের পথ রুদ্ধ হবে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন প্রতিটি ভাষার মর্যাদা দিতে শিখিয়েছে। যে ভাষাগুলো বিপন্ন হতে চলেছে সেগুলোকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন ভাষায় পাঠদানের ব্যবস্থা করলে অনেটাই বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।