১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তে নেমেছে ইউজিসি

দেশের সরকারি-বেসরকারি ১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এগুলোর মধ্যে ৮টি সরকারি; বাকিগুলো বেসরকারি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটির উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগসহ আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

এছাড়া আছে যৌন হয়রানি এবং গবেষণা জালিয়াতি সম্পর্কিত অভিযোগ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক, প্রশাসনিক অনিয়ম থেকে শুরু করে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যদের বিভিন্ন উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ লোপাট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অবৈধভাবে ক্যাম্পাস ও প্রোগ্রাম পরিচালনা এবং সনদ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক বছরে আরও অন্তত ৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে ইউজিসি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। একইভাবে এক ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া ইউজিসি সম্প্রতি ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এরমধ্যে ১৭টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত ও অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনার তথ্য পেয়েছে ইউজিসি।

জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আর বেসরকারি বিওটিই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। যে কারণে যে কোনো অভিযোগের তির তাদের দিকেই থাকে। বিভিন্ন সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ইউজিসিতে অভিযোগ আসে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অভিযোগ সাধারণত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখতে বলা হয়, যা আমরা তদন্ত করি। দুদকের অনুরোধেও আমরা অনেক সময়ে তদন্ত করে দেখি। কেননা, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন চাই। তবে কখনো কখনো অভিযোগের সত্যতা মেলে না।

ইউজিসি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে যেসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত চলছে সেগুলোর মধ্যে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ি উপাচার্যের ব্যাপারেই আছে দুটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও কর্মকর্তারা তার ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছিলেন। এরমধ্যে একটিতে ৭ শিক্ষক মোট ৪৫টি অভিযোগ করেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইউজিসি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি মে মাসে কাজ করে। উত্থাপিত অভিযোগের মধ্যে আছে-ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে জনবল নিয়োগ, শিক্ষক ও জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি (ভিসি) হয়েও অনুপস্থিত থাকা, ইচ্ছেমতো পদোন্নতি, আইন লঙ্ঘন করে একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদ দখল, ক্রয়প্রক্রিয়ায় নীতিমালা লঙ্ঘন, ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া এবং ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক অনুপস্থিতি।

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে চলছে নিয়োগসংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত।

এরমধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে এক নারী প্রভাষক প্রার্থী অভিযোগ করেছেন। একই ধরনের দুটি অভিযোগের তদন্ত চলছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, ছেলে ও মেয়েকে নিয়োগের পর এখন তিনি স্ত্রীকে অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত চলছে। আর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত চলছে।

ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে উঠা একটি অভিযোগের তদন্ত। তবে ইউজিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। অভিযোগটি ছিল ভুয়া। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ তদন্ত করা হয়। অভিযোগ ছিল সাবেক উপাচার্য আর কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।

এছাড়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি তদন্ত হয়। এরমধ্যে রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি সম্পর্কিত অভিযোগ আর উপাচার্যের বিরুদ্ধে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত করা হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে। এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভর্তি ও সিটিং অ্যালাউন্স বাণিজ্য, কেনাকেনা ও গাড়িবিলাস, অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইউজিসি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ও এমবিএ সংক্রান্ত দশটি প্রোগ্রামে ভর্তির ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে।

জেডএইচএন সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিরুদ্ধে একইভাবে অনুমোদনবিহীন প্রোগ্রাম চালানোর কারণে ভর্তিতে সতর্ক করা হয় শিক্ষার্থীদের।

ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিওটির এক সদস্য অভিযোগ করেছেন যে, তাকে না জানিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী ইউনিয়ন, একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানিও অভিযোগ করেছে। সে সবেরই তদন্ত চলছে।

চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত চলছে। তাছাড়া আগে থেকে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসহ বেশকিছু অভিযোগ আছে। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিওটির কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ও সনদ বাণিজ্য, লিডিং ইউনিভার্সিটিতে বেপরোয়া আর্থিক দুর্নীতি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসেই বসবাস, স্বেচ্ছাচারিতা ও শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতি সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত চলছে। আর পুন্ড্র ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য তার বকেয়া বেতনভাতা না পাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই অভিযোগ তদন্ত করা হয়। ইউজিসি শুধু কোনো ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারে। তাই তদন্ত প্রতিবেদনে তথ্যানুসন্ধান করে সুপারিশসহ তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৮টি। তবে এগুলোর মধ্যে ৯৯টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।