১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল ও মুজিব নগর সরকার- একটি সাক্ষাৎকার

আজ ঐতিহাসিক সতেরই এপ্রিল। ১৯৭১ সালের ঠিক এই দিনে মেহেরপুর মহকুমাধীন বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে বাংলাদেশের মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা-সনদ ঘোষণা করা হয়।

১৭৫৭ সালে পলাশীর এক আ¤্রকাননে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে বাংলার স্বাধীনতা সুর্য অস্ত যায়। আবার ১৯৭১ সালের এই দিনে বৈদ্যনাথতলায় আর এক আ¤্রকাননে স্বাধীনতার রক্তেভেজা সনদ ঘোষিত হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমনের মুখে এক রক্তভেজা দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দশ সহ¯্রাধিক মানুষের গণবিদারী শ্লোগান, বিপুল করতালি আর উল্লাসের মাঝে এই স্বাধীনতা সনদটি পাঠ করেন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির তদানীন্তন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী (পরে শিক্ষামন্ত্রী)।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৯৭২ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর দিবস উপলক্ষ্যে দৈনিক বাংলায় একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন যা ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন শওকত আনোয়ার। সাক্ষাৎকারটি অবিকল উপস্থাপন করা হল:

“১৬ই এপ্রিল। উনিশশো একাত্তর সাল। রাত দশটা। মুজিব নগরে একটি বাড়ীতে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হঠাৎ এসে উপস্থিত। এসেই বললেন- কালকে তোমাকেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে হবে। এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। তৈরী থেকো। অপেক্ষা করলেন না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব চলে গেলেন। আমি চমকে উঠলাম। সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল বাঙালীর স্বাধীনতার ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে আমিই পাঠ করবো? একদিকে শংকা ও ভয়। অন্যদিকে অপ্রত্যাশিত আনন্দ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছি- আগামীকাল একথা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দখলদার পাক বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। প্রতিশোধ নিতে চাইবে। তখনো আমার মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন দিনাজপুরে আছে বলেই শুনেছি। তবে কেমন ও কি অবস্থায় আছে জানিনা। তাই ভয়-দস্যু বর্বর বাহিনী ক্ষেপে গিয়ে তাদেও উপরই প্রতিশোধ নিতে পারে। সাথে সাথে মনে এক অনাস্বাদিত অনুভূতি- বিশ্বে কজনার ভাগ্যে এ সুযোগ আসে? একটি নতুন জাতির স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের গৌরব এতো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

কথা কটি বললেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী। গত বছর ঠিক এই ১৭ই এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে তাঁরই কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা। ঘরোয়া পারিবেশে গত শনিবার রাতে তাঁরই সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী বললেন, বিশ্বাস করুন সেদিন রাতে ভালো ঘুম হয়নি। একটা অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসে। মনে আসে নানা কথা। নানা স্মৃতি এসে ভীড় করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আজ কোথায়? কেমন আছেন? আদৌ বেঁচে আছেন কিনা? তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই- একথা বিশ্বাস হতে চায় না। তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিটি নির্দেশ কানে বাজছে। মনে হল, এইতো বঙ্গবন্ধু কাছেই আছেন। পাশের ঘরেই হয়তো ডাক পড়বে। নির্জন কক্ষে শুয়ে আছি। চোখে ঘুম নেই। প্রতিটি মুহুর্তই একটি নতুন অনুভূতি। কতকগুলো মুখ আমার চোখের সামনে ভাসছে। মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন। ভাসছে গ্রামের মানুষের মুখ। বাংলাদেশের মানুষের মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি। স্মৃতির উত্তাপ বাড়ছে। বাড়ছে অস্থিরতা। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিনের কথা ভাবতে গেলেই আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। হয়তো এ আমার দুর্বলতা। হয়তো নয়। কিন্তু এ আমার জীবনের মধুরতম স্মৃতি।

সাক্ষাৎকারের এখানে কিছুক্ষণ বিরতি। স্মৃতির রথে চড়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ফিরে গেছেন একটি বছর পিছনে। হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে হেসে ফেলেন।

জানেন, পরদিন সকালে উঠেই কি বিপদে পড়েছিলাম। আমার পরনে তো লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী। তাও ধোয়া নয়। সাথে দ্বিতীয় কোন কাপড় নেই। এখন উপায়? সভায় কি পরে যাব? ছুটলাম কামরুজ্জামান সাহেবের (মন্ত্রী) আস্তানায়। আমার অবস্থা শুনে তাঁর মুখেও ম্লান হাসি। বললেন, এক সেট পাজামা-পাঞ্জাবী আছে। কিন্তু মানাবে কিনা। বললাম, তাই সই। বেঢক সেই পাজামা-পাঞ্জাবীই পড়ে নিলাম। আর এমনই ভাগ্য- পাঞ্জাবীর দুটো পকেটই ছেঁড়া। সাত-আটদিন সেভ করিনি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরে দেখলাম অন্যদের অবস্থাও প্রায় এক।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলে চলেন, ১৭ই এপ্রিল বেলা দশটার দিকে আমরা গাড়ীতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছি। সুদৃশ্য আম্রকাননে বিরাট মঞ্চ। মঞ্চের উপর দুটো টেবিল। সাতখানা চেয়ার পাতা রয়েছে। মঞ্চের তিনপাশে কয়েকশো চেয়ার ও বেঞ্চ। মঞ্চের ঠিক সামনে কিছুটা জায়গা চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। একপাশে এমএনএ ও এমপিএগণ, একপাশে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও প্রেস ফটোগ্রাফার আর সামনে কয়েক হাজার মানুষ।

বৈদ্যনাথতলা বর্ডার আউটপোস্টে আমরা চা-বিস্কুট খেয়ে নিলাম। আমাদের সশস্ত্র জোয়ানবাহিনী ও আওয়ামী লীগ কর্মীরাই এর ব্যবস্থা করেছেন। কয়েকজন বাঙালী তরুণ সিভিল অফিসারকেও দেখলাম। তাদের মাঝে দুজনের নাম এখনো মনে আছে- তৌফিক-ই-এলাহী ও ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দীন।

চা পানের মধ্যেই আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রটি আমার হাতে দিলেন। আর বললেন, এটি এক্ষুণি বাংলায় অনুবাদ করে নাও। দেখলাম ঘোষণাটি ইংরেজীতে টাইপ করা। তখন হাতে একদম সময় নেই। সবাই একে একে আম্রকানন মঞ্চের দিকে চলে গেলেন। আমি ও বরিশালের এমপিএ জনাব নুরুল ইসলাম ঘোষণাটি বাংলায় অনুবাদ করছি। অনুবাদ কেমন হচ্ছে খেয়াল নেই। সময়ের দিকেই লক্ষ্য। সময় যে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। বেশী দেরী করা চলবে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতেই হবে।

এমন সময় ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রব দৌড়ে এসে আমাকে বললো, স্যার, জাতীয় সঙ্গীত তো কেউ গাইতে জানে না। আপনাকেই গাইতে হবে।

আমি কয়েকটি ছেলেকে নিয়ে আসতে বললাম। আবদুর রব আবার দৌড়ে গিয়ে চার-পাঁচজন ছেলেকে এনে আমার সামনে উপস্থিত করল। বিনা হারমোনিয়ামেই ওদের নিয়ে তক্ষুণি বসে গেলাম। একটি কাগজে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’- গানের প্রথম আট লাইন লিখে ওদের হাতে দিলাম; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুরটা তুলে ওদেরকে প্রস্তুত করে নিলাম। পরে বললাম, জাতীয় সঙ্গীতের পরই আমার ঘোষণা পাঠ থাকবে। তাই তোমাদেরই গাইতে হবে।

মঞ্চ থেকে পবিত্র কোরান পাঠের সুর এল। আমরা দ্রুত পায়ে সেখানে উপস্থিত হলাম। অনুবাদ কপিতে যথেষ্ঠ কাটাছেড়া রয়েছে। কিন্তু ভাল করে লেখার তখন আর অবকাশ নেই।

মঞ্চে উপস্থিত রয়েছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য জনাব মোহাম্মদ মনসুর আলী ও জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান। সবার ডানে রয়েছেন প্রধান সেনাপতি কর্নেল (এখন জেনারেল) আতাউল গনি ওসমানী।

কোরান তেলোয়াতের পর জাতীয় সঙ্গীত। সমবেত কণ্ঠে যখন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানের সুর, তখন অলক্ষ্যে আমার চোখে অশ্রু। লক্ষ্য করে দেখলাম- সবার চোখই অশ্রুসিক্ত। সে এক অনন্য মুহুর্ত। অনাস্বাদিত উষ্ণ অনুভূতি।

সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউসুফ আলী আরও বলেন, এরপরই টাঙ্গাইলের এমএনএ (এখন স্বরাষ্টমন্ত্রী) জনাব আবদুল মান্নান স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা পাঠ করতে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন।

হঠাৎ একটি আশ্চর্য পরিবর্তন। এতক্ষণের ভয়-ভীতি, শংকা, আনন্দ, অস্থিরতা থেকে আমি মুক্ত। ধীর পদক্ষেপে মঞ্চে উঠলাম। অসংখ্য ক্যামেরা আমাকে ঘিরে রেখেছে। আমি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলাম। পাঠ শেষে ঘোষণাটি আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের হাতে অর্পণ করি। তখন বেলা আনুমানিক এগারটা। মন্ত্রিপরিষদের সকলে আমার হাতে হাত মিলালেন। তখন তুমুল করতালি।

এরপরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক তেজদীপ্ত ভাষণ দেন। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকদের উদ্দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক নীতির ব্যাখ্যা দেন। সাংবাদিকদেরও আগ্রহের যেন শেষ নেই।

হঠাৎ চারদিক থেকে হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হল- ‘জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’। শ্লোগান ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে আম্রকাননে। পড়ছে সমবেত সবার হৃদয়ে। সাগরের কল্লোল জাগে সবার প্রাণে। হৃদয়ের উষ্ণ আবেগে একে অন্যকে আলিঙ্গনে কাছে টেনে নিচ্ছে। একটা অব্যক্ত আনন্দ ও বেদনা গেঁথে আছে সকলের মনে। মাথার উপর মধ্যাহ্নের সুর্য যেন তখন আলোর স্পর্শে আমাদেরকে আশীর্বাদ করল। আমরা ধন্য হলাম।”

এটিই মুজিব নগর সরকারের ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিলের ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের কাছে এভাবে অবিকল তুলে ধরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এমন ইতিহাস শিশুতোষ পুস্তকে পাঠ্য হতে পারে, যাতে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত ঘটনা প্রকৃত উৎস থেকে জানতে পারে। সময়ের সাথে নিজের অবস্থানটা ঠিক রেখে লিখিত ইতিহাস, ইতিহাস হতে পারে না।

লেখক: মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, প্রকল্প পরিচালক, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর।