২০২২: সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিষাদ!

আর মাত্রয় কয়েকদিন। আসবে নতুন বছর ২০২১। বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে ২০২২। বিনোদন জগতের জন্য এ বছরটি ছিল বেশ ঘটনাবহুল। বছরজুড়ে স্টারদের বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ঘটনা শিরোনামে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে ২০২২ সাল ছিলো বিষাদের। এবছর দেশের কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে হারিয়েছে দেশে।

মাসুম আজিজ
ক্যানসারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যায়ও ভুগছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার মাসুম আজিজ। অবশেষে ১৭ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ১৮ অক্টোবর বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই অভিনেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানেই মায়ের পাশে মাসুম আজিজের দাফন সম্পন্ন হয়।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার
গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায় মারা গেছেন। এদিন সকাল ১০টায় তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। দুপুরে দিকে শ্রদ্ধা জানাতে মরদেহ নেওয়া হয় এফডিসিতে। সেখানে তাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান তার সহকর্মী ও প্রিয় মানুষেরা। এরপর গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরদিন সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বনানীতে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বেতার, টেলিভিশন ও সিনেমাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। গীতিকবিতায় অবদান রাখার জন্য ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি। এছাড়া পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্য কালজয়ী গানের এই গীতিকার। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শীষ দিয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’। এছাড়া তার লেখা কালজয়ী গানগুলো হলো ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ প্রভৃতি।

আলম খান
বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলম খান চলে গেছেন ৮ জুলাই বেলা ১১টায়। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি অসংখ্য কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। আলম খান তার ক্যারিয়ারে ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচবার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে এবং একবার শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে।

আলম খানের গান সৃষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালবাসা চায়’, ‘ভালবেসে গেলাম শুধু’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী’, ‘জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প’, ‘মনে বড় আশা ছিল’, ‘সাথীরে যেও না কখনো দূরে’, ‘বেলি ফুলের মালা পরে’, ‘কাল তো ছিলাম ভাল’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’, ‘তুমি কি এখন আমারই কথা ভাবছো’, ‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটাইরে’ ইত্যাদি।

শর্মিলী আহমেদ
৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে না ফেরার দেশে চলে যান ঢাকাই সিনেমার বরেণ্য অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। মঞ্চ, টিভি ধারবাহিক, খণ্ড নাটক ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর অভিনয় জীবন শুরু হয় মাত্র চার বছর বয়স থেকে। সেই থেকে প্রায় চারশোটি নাটক ও দেড়শোটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয় জীবনে মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে সহজেই জিতে নিয়েছেন দর্শকের মন।

কে জি মোস্তফা
৮ মে রাত ৮টার দিকে আজিমপুরে নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন গীতিকার ও সাংবাদিক কে জি মুস্তাফা। ৯ মে বাদ জোহর কে জি মোস্তফার মরদেহ জাতীয় প্রেস ক্লাবে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তার দাফন করা হয়। ১৯৬০ সাল থেকে চলচ্চিত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে তার লেখা প্রচুর গান প্রচারিত হয়। হাজার গানের গীতিকার কে জি মুস্তাফার সিনেমার গানগুলোর জন্যও জনপ্রিয়।

আজিজুর রহমান
১৫ মার্চ ১১টা ৫৫ মিনিটে কানাডার টরন্টোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি শ্বাসকষ্ট ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। শেষ এক বছর কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া চলতে পারতেন না। ২০ মার্চ তার মরদেহ দেশে এসে পৌঁছায়। শহীদ মিনার, এফডিসিতে শ্রদ্ধা ও জানাজা শেষে ২১ মার্চ বগুড়ার সান্তাহারের কলসা গ্রামে মা আবেজান বেগমের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন তিনি।

আজিজুর রহমান ৫৪টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘অশিক্ষিত’, ‘মাটির ঘর’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘সাম্পানওয়ালা’, ‘ডাক্তার বাড়ি’, ‘গরমিল’ ও ‘সমাধান’ ইত্যাদি।

আকবর
ডায়াবেটিস ও কিডনি জটিলতায় ভুগে ১৩ নভেম্বর দুপুরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কণ্ঠশিল্পী আকবর। ১৪ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে যশোর শহরতলীর সুজালপুরে গ্রামের বাড়িতে মায়ের কবরের পাশে আকবরকে শায়িত করা হয়।

২০০৩ সালে যশোর এমএম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন আকবর। সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বাগেরহাটের এক ব্যক্তি হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে চিঠি লিখে এই গায়কের কথা জানান। এরপর ‘ইত্যাদি’ কর্তৃপক্ষ আকবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই বছর ‘ইত্যাদিতে’ কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে’ গানটি আলোচনায় নিয়ে আসে আকবরকে। পরে প্রথম মৌলিক গান ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’ তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় আকবরকে।

রাইমা ইসলাম শিমু
১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টার ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুর (৩৫) বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা করে পুলিশ। প্রথমে তার হত্যার দায় চাপানো হয়েছিলো তৎকালীন শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের দিকে। পরী পুলিশ জানায়, পারিবারিক কলহের যেরে তিনি খুন হয়েছেন।

সূত্র: ইত্তেফাক