মেহেরপুরে রিনিউয়েবল এনার্জি ফেস্ট উপলক্ষে সচেতনতামূলক র‍্যালি

রিনিউয়েবল এনার্জি ফেস্ট ২০২৫ উপলক্ষে মেহেরপুরে এক সচেতনতামূলক র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার (২১ এপ্রিল) সকাল ১০টায় মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর থেকে র‍্যালিটি শুরু হয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে শেষ হয়।

সুবাহ সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার আয়োজনে এবং একশনএইড বাংলাদেশ, বুয়েট ও জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (জেটনেট-বিডি)-এর সহযোগিতায় এই র‍্যালির আয়োজন করা হয়।

র‍্যালিতে উপস্থিত ছিলেন মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ক্যাব মেহেরপুর জেলা শাখার সভাপতি রফিক-উল-আলম, ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক ও আরটিভির জেলা প্রতিনিধি মাজেদুল হক মানিক, সোসাইটি ফর দি প্রোমোশন অব হিউম্যান রাইটস (এসপিএইচআর)-এর নির্বাহী পরিচালক আবু আবিদ, পল্লী জন উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক গোলাম কিবরিয়া, ব্র্যাকের জেলা প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম, হেলফ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক দিলারা জাহান এবং অপাজিতা মেহেরপুর-এর নির্বাহী পরিচালক রেহেনা খাতুন।

র‍্যালিতে শতাধিক নাগরিক, নারী ও যুবা নেতৃবৃন্দ, পরিবেশকর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। তারা “সৌর-বায়ু শক্তিই ভবিষ্যৎ”, “জ্বালানি রূপান্তরে নারী-যুবার অংশগ্রহণ চাই” এবং “রিনিউয়েবল এনার্জি ফেস্ট ২০২৫ সফল হোক” এই ধরনের নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার বহন করেন।

র‍্যালি শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা, নীতিগত সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

সুবাহ সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মঈন-উল-আলম বলেন, “জ্বালানি খাতের টেকসই রূপান্তর শুধু সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়; এর জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এই র‍্যালি সেই প্রয়াসেরই সূচনা।”




কন্টক পথ পাড়ি দিয়ে যেতে চাই বহুদুর -ইয়াদুল মোমিন

সীমান্তবর্তী ছোট একটি জেলা মেহেরপুর। স্বাধীনতার সূতিকাগার খ্যাত ঐতিহাসিক জেলা মেহেরপুর। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে নতুন বাংলাদেশে এখনও বৈষম্য এ জেলার উন্নয়নে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, কলকারখানা, শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এখনও বৈষম্যর শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমন একটি জেলাতে অনেক নেই এর মধ্যে আছে আমাদের গৌরব করার মত একটি দৈনিক। আমি মেহেরপুর প্রতিদিনের কথা বলছি। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে কথা বলছি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কথা বলছি। কথা বলছি মেহেরপুরের একজন নাগরিক হিসেবে। আমি এখন অবশ্যই গর্ব করি আমার জেলাতে একটি দৈনিক পত্রিকা আছে। যেখানে আছে অনেক অসঙ্গতি, কিন্তু অনেক অসঙ্গতির মধ্যেও প্রতিদিন একটি দৈনিক পাঠকের হাতে পৌছাচ্ছে পত্রিকা কতৃপক্ষ। ২০১৮ খ্রি. থেকে ২০২৫ খি.। সাত বছর পেরিয়ে ৮ম বছরে আমাদের প্রিয় পত্রিকা মেহেরপুর প্রতিদিন। অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে একটি বৈষম্যহীন, উন্নয়নশীল, অসঙ্গতিমুক্ত একটি জেলাকে আলোকিত করার চেষ্টা আমাদের প্রতিনিয়িত। কতটুকু পারবো, কতটুকু পেরেছি এ বিচারের ভার মেহেরপুরের আপামর জনগণের, আমাদের সকল স্তরের পাঠকের। তবে আমরা এ কন্টাকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে বহু দুরে যেতে চাই।

আমরা গর্বিত আমরা একটি ইতিহাস গড়তে চলেছি। আমরা পেরেছি, আমাদের পারতেই হচ্ছে। আমাদের একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে, তা হলো সব অসঙ্গতিকে দুরে সরিয়ে আমাদের আলোকিত করতেই হবে। এ ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ নিতে পেরে মেহেরপুর প্রতিদিনের পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি অহংকার করি।

অহংকারের এ যাত্রায় আমাদের সঙ্গে আছেন অগণিত পাঠক আর শুভানুধ্যায়ী। মে‌হেরপুরসহ দ‌ক্ষিণ-প‌শ্চিমাঞ্চ‌লের সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা আমাদের প্রধান শক্তি। পাঠকসাধারণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে পত্রিকাটি আমরা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, পাঠকই আমা‌দের সবচাইতে বড় শক্তি, বড় শ্রদ্ধার জায়গা। তাদের হাতে প্রতিদিন একটি গ্রহণযোগ্য পত্রিকা তুলে দেওয়ার চেষ্টা ৭ বছর ধরে আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছি। আগামী দিনেও এই নিষ্ঠা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখব।

‘জনগ‌ণের মুখপত্র’ এই স্লোগা‌নের স্বাক্ষর রে‌খে যা কিছু জনগ‌ণের জন‌্য কল্যাণ ব‌য়ে আ‌নে সে ধর‌ণের সংবাদ প‌রি‌বেশ‌নের ক্ষে‌ত্রে আমা‌দের সহকর্মীরা নিরলস কাজ কর‌ছে।

সংবাদের ভিতরকার সকল স‌ত‌্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। অসততা আমাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তবে আমরা নিরপেক্ষ নই। আমরা মানুষের পক্ষে। প্রতিটি সাধারণ মানুষ, প্রতিটি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পক্ষে আমা‌দের কলম চলবে।

শুধু পত্রিকা প্রকাশ করেই আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করিনি। মেহেরপুরের খেলাধুলার প্রাণ ফিরিয়ে নিতে আমরা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি।পত্রিকার পাশাপাশি জাতীয় মানের টকশো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি দুর করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

মেহেরপুর প্রতিদিনের ৮ম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সফল হোক।




প্রসঙ্গ ‘কেয়া পাতার নৌকা’: দাঙ্গা বিধধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্র -ড. শামস্ আল্দীন

মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে সংগ্রামেরই ইতিহাস। ইতিহাসের ছোট বড় দাঙ্গা যুদ্ধ সবই এই সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। আর কথাসাহিত্যের কারবার যেহেতু মানুষ এবং মানুষের ছোট বড় সূক্ষ্ম ও অতি সূক্ষ্ম নানান বিষয় নিয়ে সেহেতু মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া এবং ঘটে চলা সংগ্রামের ইতিহাস ও কথাসাহিত্যে স্থান করে নেয় অনায়াসেই। বিশে^র সমস্ত দেশের কথাসাহিত্য সম্পর্কেই একথা সত্যি। বাংলা কথাসাহিত্য এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা কথাসাহিত্যের আদি থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কথাসাহিত্যের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন দাঙ্গা ও আন্দোলন বারেবারে বাংলা কথাসাহিত্যের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। তবে এখনো পর্যন্ত যে দাঙ্গাটি বাংলা কথাসাহিত্যকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করেছে সেটি হল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মুহূর্তে দেশভাগকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গা এতটাই ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী ছিল যে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই। এই দাঙ্গা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে খুব অল্প সময়েই তা ব্যক্তি মানুষের মনকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। এই দাঙ্গার অভিঘাত এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে দাঙ্গা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ব্যক্তি মানুষ তার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। এই দাঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুসহ কেওই বাদ পড়েনি। ‘কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসে প্রফুল্ল রায় দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সময়ের এই চালচিত্রকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন। সেই বিষাক্ত সময় একটি নারীর জীবনকেও কীভাবে বিষিয়ে দিয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় কীভাবে এই দাঙ্গা ব্যক্তি নারীর জীবনে ট্রাজিক পরিণতি নিয়ে এসেছে  ‘ কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসে প্রফুল্ল রায় তা অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে অঙ্কন করেছেন।
দেশভাগ এবং দেশভাগের অভিঘাত প্রফুল্ল রায়কে যে জীবন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল তা এতটাই গভীর ছিল যে সমগ্র জীবন তার প্রভাব থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি। মানুষের জীবনের সবথেকে সুন্দর সময় শৈশবের প্রায় পুরোটাই, ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গে। এরপর দেশভাগের ফলে উদ্বাস্ত হয়ে তাঁকে চলে আসতে হয় কলকাতায়। সে অভিজ্ঞতা মোটেই ভাল ছিল না। একবস্ত্রে পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। প্রতিমুহূর্তে ছিল খুন হয়ে যাওয়ার ভয়। পূর্ববঙ্গের একশ্রেণির মুসলমান তখন খুনের খেলায় মেতে উঠেছে। রাম দা নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক মুসলমান প্রতিবেশী হিন্দুদের এই দুর্দিনে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এদের সহযোগিতায় অতি কষ্টে প্রথমে জাহাজে এবং পরে রিফুজি স্পেশাল ট্রেনে উদ্বাস্ত হিসেবে কলকাতায় প্রবেশ করেন তিনি। এরপর জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন দাঙ্গার কারণে উদ্বাস্ত মানুষের জীবন যন্ত্রণা। এই গভীর জীবন অভিজ্ঞতা সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়কে বরাবরই চালিত করেছে।  ‘কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসটি লেখকের গভীর জীবন অভিজ্ঞতার ফসল।
 ‘কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসে লেখক অনেকগুলি চরিত্র অঙ্কন করেছেন। এই চরিত্রগুলি দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভয়াবহ পরিণতিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। ‘কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসে বিনু, ঝিনুক, যুগল, লারমোর প্রভৃতি চরিত্র, তাদের ক্রিয়াকলাপ এব তাদের পরিণতি তো দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের চরম পরিণতিকেই মনে করিয়ে দেয়। যে বিনু পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে গিয়ে পূর্ববঙ্গের মাটিকে অন্তর দিয়ে ভালো ভেসে ফেলেছিল সেই বিনুকেই বিনা দোষে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কাণে রাতের অন্ধকারে ব্যথাহত হৃদয়ে পালিয়ে চলে যেতে হল কলকাতায়। সত্যিই এই চিত্র মর্মান্তিক।
‘কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসে বহু চরিত্রের মধ্যেও আলাদা করে নজরে পড়ে ঝিনুক। বিনুর পাশাপাশি ঝিনুককে অত্যন্ত মমতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন লেখক প্রথম থেকেই। ঝিনুক অভাগী। উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় সবটা জুড়েই তার উপস্থিতি। উপন্যাস শেষ হয়েছে তার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের মাধ্যমে। মানব সংসারে এরকম কিছু চরিত্র থাকে, যারা জন্ম থেকেই অভাগী। বিত্তের কারণে নয় সম্পূর্ণ ভাগ্যের দোষে ঝিনুক সেরকমই একটি চরিত্র। হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কীভাবে তার জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে তারই এক অনবদ্য ছবি অঙ্কিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। উপন্যাসের শুরুতে হেমনাথের সঙ্গে স্টিমার ঘাটে যখন ঝিনুককে প্রথম দেখা যায় তখন তার বয়স মাত্র আট।
“ছোট মেয়েটির চুল কোঁকড়া। নাকটি একটু বোঁচাই হবে। ফুলো
ফুলো নরম লালচে গাল। রূপোর কাজল লতার মতো চোখের কালো
মণি দু’টো টলটল করেছে। একটু নাড়া দিলেই টুপ করে ঝরে পড়বে। নীল
ফ্রক লাল জুতোয়, মনে হয়, মোমের পুতুলটি”১
এই নিষ্পাপ কোমল পবিত্র ছোট্ট মেয়েটি তখনও জানে না যে কি ভীষণ দুঃখের ইতিহাস রচিত হতে চলেছে তার জীবনে। বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবনের মিলহীনতার খেসারত দিতে হয়েছে এই ছোট্ট মেয়েটিকে। ঝিনুকের মা অন্য কিছুর প্রতি প্রবল আকর্ষণে শুধু স্বামী ভবতোষকে ছেড়ে যায়নি, ছেড়ে চলে গেছে দুধের শিশু ঝিনুককেও। অভিব্যক্তি শুধু চোখে জল এনে দেয় না, হৃদয়কেও ভারাক্রান্ত করে তোলে। এরপর যখন ভবতোষ ও স্নেহলতার কথোপকথন আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনে নিয়েছে তখন ঝিনুক সত্যিই জেনে গেছে যে তার মা আর ফিরবে না। তখন ছোট্ট ঝিনুকের কান্না পাঠককেও কান্নায় ভাসিয়ে দেয়।
ঝিনুকের জীবনের দুঃখের অধ্যায় এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ঝিনুক তখনো জানতো না যে কি ভয়ানক দুঃখ তার জন্য অপেক্ষা করে আছ্।ে দেশভাগের পর সারা পূর্ব বাংলা জুড়ে শুরু হওয়া সাম্প্রাদিয়ক দাঙ্গার সময় অসুস্থ মাকে দেখতে ঝিনুক বাবা ভবতোষের সঙ্গে ঢাকায় রওনা দিয়েছে। সেখানে গিয়ে তারা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গার মধ্যে পড়েছে। ভবতোষকে সেখানে খুন হতে হয়েছে। আর তাকে হতে হয়েছে ধর্ষিতা। ধর্ষিতা ঝিনুককে উদ্ধার করে নিয়ে বাড়ী ফিরে এসে হেমনাথ সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করেছে স্নেহলতাকে:
“…. এখান থেকে ঢাকা পৌঁছবার পর ভবতোষ দাঙ্গার ভেতর পড়ছিলেন। ঘাতকের দল ভবতোষকে মেরে ফেলেছে। তারপর ঝিনুককে নিয়ে চলে গিয়েছিল। হেমনাথ ঢাকায় গিয়ে পুলিশ দিয়ে ঝিনুককে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ভবতোষের মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
শ^াপদেরা ষোল সতের দিন একটা বাড়িতে ঝিনুককে আটকে রেখেছিল। যে অবস্থার তাকে উদ্ধার করা হয়েছে, তার চাইতে সে যদি মরে যেত!”২
এরপর ঝিনুক প্রায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যায়। অপ্রকৃতিস্থ ঝিনুককে নিয়ে বিনু পাড়ি দেয় কলকাতায়। বিনুর বিশ^াস ছিল ঘনিষ্ঠজনেরা দুহাত বাড়িয়ে ঝিনুককে বুকে জড়িয়ে নেবে। জীবনের দগদগে ক্ষত স্নিগ্ধ প্রলেপ লাগিয়ে জুড়িয়ে দেবে। যাবতীয় যন্ত্রণা, ভুলিয়ে দেবে সেদিনের যত মর্মান্তিক স্মৃতি। কিন্তু ঝিনুকের অদৃষ্ট তেমন নয়। সেখানে হেমনলিনী মানে তার জামাই বাবু আনন্দের মা তাকে মুখের ওপর স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে:
“দেখ মা, তোমাকে আমি এমন একটা কথা বলব যাতে দুঃখ পাবে, কিন্তু না বলেও পারছি না। শুনেছি ঢাকায় গিয়ে তুমি রায়টের মধ্যে পড়েছিলে। গুন্ডারা ক’দিন তোমাকে আটকে রেখেছিল। খবরটা শোনার পর খুব কষ্ট হয়েছিল। জানি তোমার কোন অপরাধ নেই, তুমি নির্দোষ। কিন্তু আমি পুরনো দিনের মানুষ। নানা সংস্কারে আটকে আছি। এই বয়েসে সেসব কাটানো সম্ভব নয়। একটু থেমে বললেন, ‘যে ক’দিন আছ, এক তলাতেই থাকবে। দোতলায় আমাদের ঠাকুর ঘর। তুমি ওপরে না উঠলেই ভাল হয়।”৩
এখানেও ধর্ষিত হতে হয়েছে ঝিনুককে। শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে। তবু এই জগত সংসারে তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল বিনু। বিনুই তাকে শত ঝড় জল আঘাত থেকে রক্ষা করেছে। ঝিনুকের হয়তো ভরসা ছিল বিনুর পিতা অবনীমোহনের প্রতিও। কাশী থেকে ফিরে এসে বিনু ও তাঁর পিতা অবনীমোহনের কথোপকথন জীবনের সবচাইতে কঠিন বাস্তবের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে:
“তোমার সঙ্গে আমার একটা দরকারী কথা আছে। সেটা তোমাকেই শুধু
বলতে চাই। ঝিনুক, তুমি পাশের ঘরে যাও।
ওখানে খাট বিছানা চেয়ার টেয়ার সবই আছে।
নত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঝিনুক। অবনীমোহন সোজাসুজি ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘ঝিনুকের খবরটা অনেক আগেই আমি পেয়েছি। ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা। শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু–’৪ক
অবনীমোহন বলে যেতে লাগলেন: “ঝিনুককে যে পাকিস্তান থেকে আনলে, ওকে নিয়ে কি করবে ভেবেছ? ঠিক এই ধরণের প্রশ্ন সেদিন ঝুমাও করেছিল। বিনুর বুকের ভেতরটা আমূল কেঁপে যায়। সে উত্তর দেয় না।” ৪খ
অবনীমোহন বলে যান: “ কোনও আত্মীয়-স্বজন এমন মেয়েকে শেল্টার দেবে কিনা সন্দেহ। তুমি যদি আলাদা বাড়ি ভাড়া করে ওকে নিজের কাছে রাখতে চাও, হাজারটা প্রশ্ন উঠবে। লোকে জানতে চাইবে মেয়েটা কে। তোমার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক। কী জবাব দেবে তখন? শুধু একটা পথ খোলা আছে–’
আবছা গলায় বিনু জিজ্ঞেস করল, ‘কি?’
‘যদি তুমি ওকে বিয়ে কর, সমস্যাটা মিটতে পারে। কিন্তু আত্মীয়রা তোমাদের ত্যাগ করবে। তা ছাড়া, এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করার সাহস কি তোমার আছে?”৪গ
পিতার মুখ থেকে এই কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল বিনুর। অনেক কথাই তখন মনে হল তার। বিষবাষ্পে-ভরা পূর্ব বাংলা থেকে কী নিদারুণ আতঙ্কের মধ্যে ঝিনুককে সীমান্তের এপারে নিয়ে এসেছে, তা শুধু সে-ই জানে। কিন্তু অবনীমোহন তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে দুরূহ সংকটের সামনে দাঁড় করিয় দিয়েছেন। বিপন্ন, দ্বিধাগ্রস্থ, শ^াসরুদ্ধ বিনু কী জবাব দেবে, ভেবে পেল না। অবনীমোহন বললেন:
“একটা কথা ভেবে দেখতে পার। এ জাতীয় মেয়েদের জন্য গভর্নমেন্টের হোম আছে।
সেখানে আপাতত ঝিনুককে রাখা যেতে পারে।’
বিনু তখন কথা বলার অবস্থায় ছিল না। অবনীমোহন বলে যেতে থাকেন:
‘তুমি ঝিনুকের কাছে যাও।’ এক্ষুনি নয়, সময় নিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ‘হোম’-এর
ব্যাপারটা বোলো।’
শরীর এবং মন কঠিন আঘাতে অসাড় হয়ে গেছে। নিজেকে ধীরে ধীরে টেনে তুলল বিনু। পাশের ঘরে এসে দেখল, সেটা একেবারে ফাঁকা। সে ডাকতে লাগল, ‘ঝিনুক–ঝিনুক–’ সাড়া নেই।
তেতলার অন্য ঘরগুলো আতিপাতি করে খুঁজল বিনু। কোথাও ঝিনুককে পাওয়া গেল না। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে দোতলায়, তারপর একতলায় নেমে এলো সে। ঝিনুক কোথাও নেই।” ৪ঘ
ঝিনুকের জীবনের এই পরিণতি মেনে নিতে কষ্ট হয়। তার এই পরিণতি কোনমতেই প্রত্যাশিত ছিল না। ঝিনুকের তো কোন দোষ ছিল না। সে তো দাঙ্গাবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অস্থির সময়ের শিকার। কোনভাবেই যেন এর থেকে তার নিস্তার নেই। শুধু ঝিনুকই নয় তার মতো হাজার হাজার নারীকে বাংলাদেশের দাঙ্গা বিধ্বস্ত সেই উত্তাল সময়ে এই নারকীয় যন্ত্রণার শিকার হতে হয়েছে। ইতিহাস বইয়ের পাতায় দু একটি শব্দের খোঁচায় হয়তো বা তার ইতিহাস তুলে রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নারীর জীবনে ঘটে যাওয়া সেই যন্ত্রণাময় ইতিহাস জীবন্ত হয়ে আছে সাহিত্যের পাতায়। যে সমস্ত সাহিত্যিক এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রফুল্ল রায়। তাঁর ‘কেয়া পাতার নৌকা’ উপন্যাসের ঝিনুক দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলাদেশের হাজার হাজার ত্রস্ত নারীর প্রতিনিধি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ^বিদ্যালয়



মেহেরপুরের দুই কৃষ্ণ কবি -মুহাম্মদ রবীউল আলম

সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূবনে মেহেরপুরের রয়েছে সুদীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল এক ঐতিহ্য। এ অঞ্চলের মাটি যেমন রাজনৈতিক আন্দোলনে রেখেছে সাহসিকতার ছাপ, তেমনি কাব্যচর্চার ইতিহাসেও রেখেছে এক অনন্য পরিচিতি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা আজকের আলোচনায় মেহেরপুরের দু‘জন পুরোধা কবির কথা আলোচনা করবো। তারা হলেন মধ্যযুগের সাহিত্যের অনতম কবি কৃষ্ণহরি দাস ও নদীয়ার রাজা গিরিশচন্দ্রের সভাকবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী (১১৯৮ বঙ্গাব্দ – ১২৫১ বঙ্গাব্দ)। তারা তাদের কাব্যচর্চার মাধ্যমে মেহেরপুরকে সম্মানিত করেছেন। কবি কৃষ্ণহরি দাস মেহেরপুরকে আলোকিত করে যখন লেখেন ‘কৃষ্ণহরি দাস ভনে বাস মেহেরপুর’, তখন আমাদের গর্বে বুকটা ভরে যায়। অপর দিকে মেহেরপুরের বাড়ীবাঁকা গ্রামের সন্তান কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী যখন নদীয়ার রাজার সভাসদে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে সবাইকে তাঁক লাগিয়ে দেন, তখন আমাদের আনন্দে মনটা নেচে উঠে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর‌্যন্ত বিস্তৃত এই ধারায় এই দুই প্রাজ্ঞ কবির অবদান মেহেরপুরকে করেছে গর্বিত ও শ্রদ্ধাভাজন।

কৃষ্ণহরি দাস বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষার্দ্ধের কবি ও গীতিকার। তিনি নদীয়ার বনগাঁও জন্ম নিলেও মেহেরপুরে বসবাস করতেন এবং মেহেরপুরে বসে কাব্য চর্চা করে গেছেন। এখানেই তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য পুথি ও গীতিকাব্য। তার কাব্যে উঠে এসেছে বাউল-দরবেশ সংস্কৃতির প্রভাব, যেখানে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মমতের এক অনন্য সমন্বয় দেখা যায়।

সত্যপীরের পাঁচালী কাব্যের মধ্যে তার রচিত ‘বড় সত্যপীর ও সন্ধ্যাবতী কন্যার পুথি’ বৃহত্তর। তিনি বাউল-দরবেশ সম্প্রদায়ের শিষ্য। তার কবিতায় হিন্দু ও মুসলমানের সমন্নয়মূলক ভণিতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তার কবিতায় দেখা যায় বিশেষ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যপীরকে সংগ্রামী ভূমিকায় আসতে হয়েছে।

কৃষ্ণহরি দাস তার “ভনে বাস মেহেরপুর’ কবিতায় লিখেছেন-‘কৃষ্ণহরি দাস ভনে বাস মেহেরপুর/শতেক বন্দেগী মোর সত্যপীরের পায়/তোমার আদেশে গান কৃষ্ণহরি গায়।/তাহের মামুদ গুরু শামস নন্দন/হরনারায়ন দাসে লেখে রচে কৃষ্ণহরি/
শিরে যার সত্যপীর কন্ঠে বাগেশ্বরী/ পঞ্চমীর পুত্র আমি নাম কৃষ্ণহর ‘।

কৃষ্ণহরি দাস রচিত ‘বড় সত্যপীর ও সন্ধ্যাবতী কন্যার পুথি’-তে “অকুমারী সন্ধ্যাবতী” একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও তাৎপর‌্যপূর্ণ নারী চরিত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে মেহেরপুরে বসবাসকারী এই কবি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ধারক হিসেবে সত্যপীরকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি সন্ধ্যাবতীকেও করেছেন এক প্রতীকী নারী-অভিযাত্রী।

রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী উনিশ শতকের এক প্রখ্যাত কবি, যিনি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে হাস্যরসাত্মক ও ছন্দনির্ভর কবিতা রচনার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ১১৯৮ বঙ্গাব্দে মেহেরপুর জেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের বাড়ীবাঁকা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কবির জন্মস্থানের ইতিহাস এবং সাহিত্যিক ধারা-উভয়ই মিশে রয়েছে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে।

বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণকান্ত মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন। এই অসাধারণ প্রাকৃতিক প্রতিভা পরবর্তীতে পূর্ণতা পায় রাজসভায়। দস্যুদের হাতে পৈত্রিক সম্পদ হারিয়ে তিনি জীবিকার সন্ধানে কৃষ্ণনগরে আগমন করেন এবং তদানীন্তন নদিয়া রাজা গিরীশচন্দ্র তাকে মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তিতে রাজপরিবারের সভাকবির পদে নিযুক্ত করেন।

তিনি সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি ও ফারসী ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। মুখে মুখে পয়ার, ত্রিপদী ও চতুষ্পদী ছন্দে কাব্য রচনায় তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। কারও দ্বারা উপস্থাপিত যে-কোনো সমস্যা তিনি কবিতায় রূপ দিতে পারতেন মুহূর্তেই। রাজা গিরীশচন্দ্র তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে “রসসাগর” উপাধিতে ভূষিত করেন।

রসসাগরের সাহিত্যজীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘সমস্যা পূরান’, যেখানে তিনি মুখে মুখে সমস্যার সমাধান কবিতার মাধ্যমে করেছেন। তার কাব্যে যেমন ছিল তীক্ষè বুদ্ধি ও রসবোধ, তেমনি ছিল গাঁথুনির নিখুঁত ছন্দ। সমসাময়িক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে তার ছিল গভীর হৃদ্যতা। একে অপরের প্রশংসায় তারা যে ছন্দ ও কবিতার মাধ্যমে সাড়া দিতেন, তা আজও কাব্যপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী লিখেছেন, ‘বাঙ্গালীর মত কাঙ্গালী কে আর/বাঙ্গালীর জল বায়ু অতি চমৎকার,-/একবার সেবিলেই চক্ষু অন্ধকার।/ম্যালেরিয়া ছারখার করিল এ দেশ/ধনে প্রাণে ক‘রে দিল মানুষের শেষ।’

জীবনের শেষ পর্বে রসসাগর শান্তিপুরে তার কন্যার কাছে থাকতেন এবং সেখানেই ১২৫১ বঙ্গাব্দে তার মৃত্যু হয়। আজও বাংলা সাহিত্যের রসাত্মক ধারায় রসসাগরের নাম উজ্জ্বলভাবে উল্লিখিত হয়, যিনি ছিলেন একাধারে প্রতিভাবান কবি, ভাষাপন্ডিত এবং রাজসভার আনন্দদাতা।

কৃষ্ণহরি দাস ও রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী-এই দুই কবির সাহিত্য সাধনা কেবল মেহেরপুর নয়, বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকেই করেছে সমৃদ্ধ। একজন মধ্যযুগের পুথিকবি হিসেবে ধর্মীয় সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক, অন্যজন আধুনিক যুগের প্রথমাধ্যে হাস্যরসাত্মক ছন্দের শিল্পী। তাদের জীবন ও কর্ম আমাদের সংস্কৃতির প্রাচীন শিকড়কে নতুন করে চিনতে ও গর্বিত হতে শেখায়। আজকের প্রজন্মকে তাদের সাহিত্য পাঠে আগ্রহী করে তোলা, কেবল অতীতকে জানার জন্য নয়-বরং আগামী দিনের সাহিত্য-সংস্কৃতির পথরেখা নির্মাণে সহায়ক হবে। মেহেরপুরের মুখ উজ্জলকারী মধ্যযুগের সাহিত্যের অনতম কবি কৃষ্ণহরি দাস ও নদীয়ার রাজা গিরিশচন্দ্রের সভাকবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।




৭১ এর কোন একদিন

দিন আসে দিন যায় মাস পেরিয়ে আসে নতুন কোন বছর। আবার সে সবই জাগতিক নিয়মে বিলিন হয় মহা অতিতের গর্ভে। ধারাবাহিক সে সময়ের মধ্যে এমন কিছু ক্ষণ, সময় বা ঘটনা হৃদয়ে দাগ কেটে যায় যা কখনো ভুলে যাবার নয় বিস্তৃতি হবার নয়। সে স্মৃতিগুলো বার বারই হৃদয় পটে ভেসে ওঠে ধ্রুপদী চলচিত্রের মতো। এমনই একটি শৈশব স্মৃতি যা আমাকে কখনো হাসায় আবার কখনো বা গভীর বেদনায় কাঁদিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও জীবনের পাতা থেকে বাদ দিতে পারিনি সেই স্মৃতি।

মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলায় সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে আমার জন্ম। শৈশব এর কথা মনে পড়তে স্মৃতিপটে ভেসে আসে বাড়ির উঠোনে চাঁদের আলোয় দাদির পাশে বসে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু হঠাৎ করেই জীবন থেকে মিলিয়ে গিয়েছিলো সেইসব মধুর সময়। কিছুদিন থেকেই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শুনছিলাম যে কোন সময় গ্রামে মিলটারি আসতে পারে। দুদিন হলো মেহেরপুর শহরের প¦ার্শবর্তী গ্রাম গোভীপুর থেকে ফুফুদের বাড়ির সবাই আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমার এক চাচা আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন তিনি তার চাকুরি ছেড়ে চলে এসেছেন। আমাদের সতর্ক করে বললেন এখানে থাকা আর নিরাপদ হবে না প্রয়োজনে ভারতে চলে যেতে হবে। আমি লক্ষ করছিলাম দেশের ভিতর থেকে অনেক মানুষ পায়ে একেবারে হেটে ভারতে পালানোর নিমিত্তে গ্রামের পথ ধরে সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাদের কষ্ট দেখে আমার কান্না পাচ্ছিলো।

দিনটি আমার ঠিক ঠিক মনে পড়ে না তবে ২৫ অথবা ২৬ মার্চ ১৯৭১ হঠাৎ করেই পাকিস্তানি মিলিটারিদের একটি হেলিকপ্টার এই এলাকার আকাশে ঘুরে ঘুরে উড়ে চলছিলো। এতখানি নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার চলা জীবনে আমার প্রথম দেখা। দ্রুত আতংকে গ্রামের সর্ব সাধারন পালাতে লাগলো। পার্শবর্তী মাঠের দিকে কোন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বিশেষ করে মেয়েদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিলো। শোনা গিয়েছিলো পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেয়েদের সম্মানহানিসহ যেকোন অত্যাচার করতে দ্বিধা করে না। ঠিক ঐ সময় আমি পাশেই নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলাম। এসেই দেখি আমাদের বাড়ির কেউ নেই শুধু আমার বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমাকে পাবার পর আমাকে সাথে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। পরক্ষনেই তথাকথিত মিলিটারি নামক পাক হানাদার বাহিনী দাপটে প্রবেশ করেছিলো গ্রামে। অস্ত্র হাতে তারা নিরীহ জনগনের ওপর চালিয়ে ছিলো অত্যাচার। মহুর্তে যারা ঘর থেকে পালাতে পারেনি এমন মেয়েদের ওপর তারা চালিিেছলো পাশবিক নির্যাতন।

মনে পড়ে সেদিনই বাড়ি থেকে আমরা রওনা হয়েছিলাম প¦ার্শবর্তী দেশ ভারতের উদ্দেশ্যে। বাড়ি থেকে একটি গরুর গাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্য চাপিয়ে দিয়ে দূর্দাশাগ্রস্ত কাঁচা ও কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেটে হেটে অতিক্রম করে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আগত সন্ধ্যার আধারে পৌছালাম একেবারে সীমান্ত রেখার সন্নিকটে বাজিতপুর নামক গ্রামে। যে গ্রামটি আমার জীবনের অচেনা এক জগৎ ছিলো। সেই রাতের অচেনা অন্ধকারে সেই গ্রামের রুপ বর্ণনা করা আমার আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এমনকি আজ জীবনের এই সন্ধিক্ষনে এসেও বহুবার চেষ্টা করেও পারিনি মিল করতে। শুধু মনে পড়ে আমার বাবার দুর সম্পর্কের কোন আত্মিয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। তাদের বাড়ির স্বল্পপরিসরে যারপরনায় আন্তরিকতার সাথে তারা ঠায় করে দিয়েছিলো ক্লান্ত অবসাদ মাখা মানুষগুলোকে একটি রাত্রি যাপনের জন্য। আমার ফুপাদের পরিবারসহ আমাদের পরিবারের লোকজন এবং যথারিতি তাদের পরিজন মিলে এক নঙর খানার মতো সৃষ্টি হয়েছিলো সে রাতে।

শেষাবধি আমি এবং আমার এক ফুপাতো ভাই গরুর গাড়ির নিচে বিচালী বিছিয়ে শয়ন করেছিলাম, কিন্তু বিধিবাম দৈবাৎ শুরু হলো প্রকৃতির পাগলামি আকাশ জুড়ে মেঘ, শুরু হলো বৃষ্টি ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমাদের পাশেই ছিলো অপরিচ্ছন্ন খুঁদে একটি রান্না ঘর। আমার ফুপাতো ভাইটি আমার তুলনায় বয়সে বড় ছিলো সে কারনে বুদ্ধিও তার আমার চেয়ে বেশি থাকার কথা। তারই নির্দেশনায় শেষমেষ ঐ রান্নাঘর নামক জায়গাটিতে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু সেখানে ছিলো একটি কুকুর শুয়ে। মনে হলো আজন্ম ঐ জায়গাটি তারই। আমার ফুপাতো ভাইয়ের অত্যাধিক প্রচেষ্টায় কুকুরটিকে অপসারিত করা গিয়েছিলো জায়গা হতে। আমরা ও আমাদের অবসাদক্লিষ্ট শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলাম সেখানে। আবারো চোখের পাতায় ভর করেছিলো ঘুম। সকালে নিদ্রা ভঙ্গ হলে দেখি কুকুরটা আমাদের পাশেই শুয়েছিলো।

লেখক: কবি ও সাহিত্যিক




মানবমুক্তির সংগ্রামে লালন ও ভাসানী

ভূ-ভারতের অধিকাংশ মানুষ আসলে তাড়া-খাওয়া মানুষ। যুগে যুগে তাদের তাড়া করেছে দেশি-বিদেশি শাসক-শোষক এবং রঙ বেরঙের বিভাষী-বিধর্মীরা। সময় কখনও তাদের অনুকূলে ছিল না, এখনও নেই। উনিশ কিংবা বিশ শতকেও তাদের নিগৃহীত-উৎপীড়িত, রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে। এখনও অবস্থা থৈবচ। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রবল স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে সাঁতরে কূলে ভিড়তে চেয়েছিলেন। কেউ কেউ খানিকটা সফল হলেও অধিকাংশরা একেবারেই হননি। কারো জন্য বিপরীত স্রোতটা এত তীব্র ছিল যে তা উতরানো সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা সব সময় আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। অদৃষ্টের পরিহাসে যারা এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইতিহাস বদলাবার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন, তাদের সবাইকেই তাড়া খেতে হয়েছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, জিন্নাহ, নেহেরুর মতো লালন, কাঙাল হরিনাথ, নজরুল, ভাসানী, শেরে বাংলা, শেখ মুজিবকেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গোলকধাঁধাঁর ফ্যারে পড়ে তাড়া খেয়ে ফিরতে হয়েছে। ফকির লালন ছিলেন সর্বোতভাবে একজন তাড়া-খাওয়া মানুষ। ধর্মধ্বজি বজ্জাতদের তাড়া খেয়ে তাকে বেছে নিতে হয়েছিল আড়ালটানা মগ্ন সাধকের ব্যতিক্রমী জীবন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে গান লেখার অপরাধে তাঁকে হয়তো জেলে যেতে হত, যেমন নজরুলকে যেতে হয়েছিল। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় বেঁচে থাকলে তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে থাকতে পারতেন না, উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমাতে হত। তফসিলি-দলিত সম্প্রদায়ের নেতা যোগেন মণ্ডলকে পাকিস্তান ছাড়তে হয়েছিল। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র পূর্ববঙ্গে থাকতে পারেননি, রাষ্ট্রনৈতিক কারণে লালনও হয়তো থাকতে পারতেন না। পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী সমাজ তাঁকে মেনে নিত না। কারণ তাঁর গানে-জীবনাচরণে, আদব-কায়দায় হিন্দুয়ানির ছাপ ছিল। তিনি গৌরাঙ্গ, নিতাই, অদ্বৈত ঠাকুরকে নিয়ে গান বেঁধেছেন। তিনি শরা-শরিয়ত মানতেন না, শিরক-বেদাত সমর্থন করতেন। এখন প্রশ্ন, বিশ শতকের গোড়ায় কিংবা তারও দু দশক আগে জন্মগ্রহণ করে বিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত লালন যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনি কার মতো হতেন? এর উত্তর হতে পারে, তিনি মওলানা ভাসানীর মতো হতেন অথবা নজরুলের মতো। তবে কমরেড মোজাফফর আহমেদ কিংবা মনি সিং হতে পারতেন না, কারণ এরা ছিলেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট। এদের সহযাত্রীরা ছিলেন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত।

দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, ফকির লালন ছিলেন উনিশ শতকের পোড়-খাওয়া, লড়াকু মানুষ। মজলুম জননেতা ভাসানীর মতো লালনের লড়াই ছিল জমিদারতন্ত্র, নীলকর সাহেব, ধন-বৈষম্য, জাতপাত, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও শোষণ-বঞ্চণার বিরুদ্ধে। লালন ও ভাসানী দুজনেই ছিলেন সাদামাটা মানুষ। আচার-আচরণ, চাল-চলন, বেশভূষা, মুখের ভাষা সবদিক দিয়েই তাঁরা ছিলেন একেবারে সাধারণ মানুষ। যে-পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁরা জন্মেছিলেন, তাতে ওই রকম সাদামাটা, সরল-সহজ হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। বরং না-হওয়াই ছিল অস্বাভাবিক। সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে ভাসানীর জন্ম। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পর্ব চুকে যায়। যে-বালক খুব অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহীন অনাথ হয়, তিনি বড় হয়ে গভর্নর-মুখ্যমন্ত্রী-মন্ত্রী হবেন এমনটা আশা করা যায়! যায় না। ভাসানীও তেমন কিছু হননি বা হবার সুযোগ থাকলেও হতে চাননি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালন করলেও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেননি। ভাসানীর মতো লালনেরও কেউ ছিল না, বড় অসহায়, বড় নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের গল্পটা ছিল খুবই সাদামাটা, খুবই আটপৌরে। সেই গল্পের ভেতর কোনো জৌলুশ বা চাকচিক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তারপরও তিনি আমাদের লোকায়ত ইতিহাসের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। লালন এবং ভাসানী অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও দুজনেই অনেক বড়মাপের মানুষ হয়েছিলেন। অসাধারণ রকমের বড়মাপের মানুষ হয়েও আত্মম্ভরিতা, অহমিকা কিংবা উচ্চমন্যতায় ভোগেননি। আমৃত্যু মিশে থেকেছেন দীনহীন, নিঃস্ব, রিক্ত মানুষের সঙ্গে।

লালনের কালে কোনো দলীয় রাজনীতি ছিল না। তাঁর জীবৎকালে অক্টাভিয়ান হিউমের পৃষ্ঠপোষকতায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও এর শাখা-প্রশাখা তখনও গ্রাম-গঞ্জে বিস্তৃত হয়নি। রাজনীতি থাকলে তিনি হয়তো রাজনীতিতে হতেন। ইতিহাসকে বদলাতে চাইতেন—চাইতেন স্বাধীনতা ও মুক্তি। চাইতেন স্বশাসিত শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন সমাজ। তিনিও ক্ষমতা চাইতেন আর পাঁচজন সংগ্রামী-জননায়কের মতো। কিন্তু সেটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়। ক্ষমতা চাইতেন জাতপাত, শোষণ-বঞ্চণার অবসান ও সর্বজনের কল্যাণের জন্য। ক্ষমতা চাইতেন ধর্মের নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা রুখে দেওয়ার জন্য। মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন বলেই তিনি রাজনীতি করতেন, সেখানে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান প্রাধান্য পেত না। অন্যায়-অবিচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। প্রতিতুলনা না-করেও বলা যায়, লালন ও ভাসানী দুজনেই ছিলেন সর্বতোভাবে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী জননায়ক। লালনের লড়াই ছিল প্রচলিত সমাজের অন্ধ অনুশাসনের বিরুদ্ধে, বিদ্যাসাগরও লড়াই করেছেন। লালনের সমকালীন রাজা রামমোহনও সমাজ বদলের জন্য লড়াই করেছেন, তবে তা ছিল কলকাতা মহানগরের মধ্যেই পরিসীমিত। তাঁর লড়াইয়ের সহযোদ্ধারা ছিলেন কলকাতার সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত এলিটরা। ভাসানীর মতো মুজিবও লড়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্র ও আধ্যিপত্যবাদী শক্তির নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। মওলানা ভাসানী রাজনীতি করেছেন সমাজতান্ত্রিক ধারায় শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে, আর মুজিবের রাজনীতি ছিল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারায় কল্যাণমূলক ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। একাত্তরে দুজনেই ছিলেন দেশদ্রোহী।

মুজিব ছিলেন সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা না করলেও স্বাধীন দেশে তিনি নিহত হয়েছেন। ভাসানী প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হননি, কিন্তু বারবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। কলঙ্ক-অপবাদ নিতে হয়েছে। আসলে রাষ্ট্র কোন বিমূর্ত ধারণা নয়; কিংবা ধূলির ধরণীতে ঈশ্বরের জয়যাত্রাও নয়। এটা ক্ষমতাধর ও শক্তিমানদের স্বার্থরক্ষারী বৃহৎ মানবীয়-প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের মতো প্রচলিত সমাজও প্রাধান্যশালী শ্রেণি বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার কাজে লিপ্ত থাকে। ‘সমাজ’ চায় ধর্মের অনুশাসন, সংস্কার, প্রথা-পার্বণ, জাতপাতের দোহাই দিয়ে দুর্বলের উপর নিপীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে যেতে। রাষ্ট্র বা সমাজের কর্তারা বেশ নিষ্ঠুর ও নির্মম। তারা খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, লুণ্ঠন-ধর্ষণ সহ্য করে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের প্রথা, বিধি-বিধান ও অনুশাসনের বিরুদ্ধাচারণকারীকে ক্ষমা করে না। এ কারণে লালন, ভাসানী, মুজিবকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ক্ষমা করেনি। একাত্তরে ওসমানি, জিয়া, তাহেররাও দেশদ্রোহী ছিলেন, পাকিস্তান টিকে থাকলে তারাও ক্ষমা পেতেন না।

বিরূপ পরিবেশে বসবাস করেও লালন ও ভাসানী স্বপ্ন দেখেছেন এবং মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। লালনকে চলতে হয়েছে প্রতিহিংসাপরায়ণ, জাতপাত-কবলিত প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, আর ভাসানীকে রাজনীতি করতে হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির হুমকি-ধামকি আর পরোয়ানার বিরুদ্ধে লড়াই করে। রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তিনি অরবিন্দের মতো সিদ্ধপুরুষের জীবন বেছে নেননি। তাঁর রাজনীতি, লড়াই-সংগ্রাম আর অধ্যাত্মচর্চা ছিল একইসূত্রে গাঁথা। লালনের অধ্যাত্মচর্চার মধ্যেও সমাজবিচ্ছিন্নতা ছিল না। তিনিও সমাজে মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়নের অবসান চেয়ে লড়াই করেছেন।

লালনের সমকালে অবিভক্ত বঙ্গদেশের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন প্রান্তিক কৃষক ও রায়ত। তাদের ওপর জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার ছিল। কৃষকদের শত্রু যে জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবরা কেমন তা তিনি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি ছিলেন জমিদার ও নীলকরবিরোধী। ঠাকুর এস্টেটের জমিদারদের বিরুদ্ধে কাঙাল হরিনাথের সাথে একজোট হয়ে তিনি ও তাঁর শিষ্যরা লড়াই করেছেন। নিঃস্ব রিক্ত, দীনহীন মানুষের কাছাকাছি থেকে তিনি বুঝেছেন যে, গরিব মানুষের শত্রু কেবল বিদেশী বণিক আর রাজপুরুষরাই নন, ইংরেজদের অনুকম্পাপ্রাপ্ত দেশি জমিদার-মহাজন ও মধ্যস্বত্বভোগী বাবুরাও তাদের শত্রু।

ব্রিটিশ আমলে বঙ্গদেশ ছিল সাতসমুদ্র পারের সাদাচামড়ার রাজপুরুষদের অধীনে, তাদের সহযোগীরা ছিল দেশি জমিদার, সুদখোর মহাজন, মোল্লা-পুরুত আর রক্তচোষা চাঁড়াল নীলকর সাহেবরা। এজন্য লালন একই সঙ্গে ছিলেন সামন্তবাদ, নীলকর ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী। ছিলেন সম্প্রদায়-ঊর্ধ্ব অখণ্ডদৃষ্টিসম্পন্ন ধর্মনিরপেক্ষ-মানুষ। কোনো সম্প্রদায়-গোত্র, মাজহাব বা মোকামের ঘেরটোপে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি। ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে সমাজটা খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাক, এটা তিনি চাননি। অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চণার অবসানে হিন্দু-মুসলমানকে তিনি এক শামিয়ানার নিচে এনে পঙক্তি ভোজন করিয়েছেন। ভেদবুদ্ধিমুক্ত শোষণহীন সমাজ কায়েম করাই ছিল তার আরাধ্য। তিনি বলেছেন: ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে,/ যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতিগোত্র নাহি রবে।’ গানের মাধ্যমে তিনি আসলে জাতিগোত্রহীন, সমতাভিত্তিক সমাজের ভাবকল্পই সারা জীবন প্রচার করে গেছেন। শোকে-সুখে, হর্ষ-বিষাদে বাংলার কৃষকসমাজ যেমন শিরদাঁড়া টানটান করে মাটিলগ্ন হয়ে থাকে, লালনও তেমনই নিজের মাটি ও মানুষকে ছেড়ে আকাশবিহারী হতে চাননি। লালনের মতো মওলানা ভাসানীও ছিলেন মৃত্তিকালগ্ন সংগ্রামী পুরুষ। দীন-দরিদ্র মানুষকে ভালবেসে কৃষক সমাজকে নিয়ে সারাজীবন পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বক্তৃতামঞ্চ থেকে জালিম ও জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুম হয়ে আগুন ঝরিয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান সফর করেছেন, কিন্তু সর্বত্রই তিনি তার প্রতিবাদী-কৃপাণ শাণিত করেছেন জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে। ছিলেন অগ্রসর চিন্তার মানুষ, অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে দল ভেঙেছেন, নতুন দল ‘ন্যাপ’ গড়েছেন, তবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি কখনোই। লালনও ছিলেন তাই, তিনিও চেয়েছেন মানবমুক্তির নহবত শুনিয়ে সমাজের ভেদাভেদ ঘোঁচাতে।

লালন ও ভাসানী দু জনেই ছিলেন অধ্যত্মসাধক। একজন লোকায়ত ধারার মরমি ফকির, আরেকজন ইসলামি-সুফি প্রবর্তনার পির। দু জনই এসেছিলেন ধর্মীয় পরিমণ্ডল থেকে, লালনের শিক্ষা আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ তথা লোকায়ত অধ্যাত্মসাধকদের কাছ থেকে। ভাসানীর শিক্ষা মাদ্রাসা-মক্তব ও কামেল পির-মুর্শিদদের কাছে। লালনের ছিল শত শত শিষ্য-চ্যালা, যারা অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব-রিক্ত, সামাজিকভাবে অপাঙক্তেয়। ভাসানীরও ছিল লক্ষ লক্ষ মুরিদ, তাদের অধিকাংশই ছিল শোষিত-বঞ্চিত-ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। দুজনেই অধ্যাত্মসাধক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান থেকে চুল পরিমাণ পিছু হটেননি। হাল আমলে বেঁচে থাকলে, ফকির লালনও পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইয়ে সামনের কাতারের সেনানী হিসেবে সামিল হতেন। তিনিও শোষণহীন-মানবিক সমাজ কায়েমের লড়াইয়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কিংবা র‌্যাডিক্যাল বামপন্থীদের সহগামী হতেন। ভাসানীর মতো হয়তো-বা তাকেও জেলে যেতে হত কিংবা জেলে বসে অনশন-ধর্মঘট করতে হত।

লালন বেঁচে থাকলে জিন্নাহ-গান্ধীর ধারার রাজনীতি করতেন না বা করতে পারতেন না। তাঁর পূর্বসূরি হতেন সুভাষ বসু যিনি ছিলেন মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। পাকিস্তানি জাানায় বেঁচে থাকলে জিন্নাহর চালবাজির রাজনীতি লালন মানতে পারতেন না, যেমন পারেননি ভাসানী। গান্ধীর সঙ্গে খানিকটা মিল থাকলেও তাঁর ধর্মীয় আবরণে মোড়ানো রাজনীতিও লালনের কাছে গ্রহণযোগ্য হত না। গান্ধী অহিংসবাদী হলেও অর্থনৈতিক সমতায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু লালন ও ভাসানী দু জনেই সমতাভিত্তিক সমাজ-দর্শনে বিশ্বাস করতেন। জিন্নাহর মতো গান্ধীও ছিলেন সমাজের উঁচুতলার মানুষ। গরিবানা হালে, দীনদরিদ্র বেশে ঘোরাফেরা করলেও গান্ধীর পেছনে কংগ্রেস ও ভারতের জাতীয়তাবাদী অভিজাতদের যে প্রচুর খরচ হত সেটা আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। সাজপোশাকে, ফ্যাশান-স্টাইলে, বক্তৃতার ভাষাভঙ্গিতে হেরফের থাকলেও গান্ধী ও জিন্নাহ দুজনেই ছিলেন বড়লোকদেও নেতা। লালন ও ভাসানী দু জনেই ছিলেন নিচুতলার মানুষ ও খাঁটি বাঙালি। তারা নিজের মতো করে জীবনযাপন করে গেছেন। দুজনেই গরিব-দুঃখী, নিঃস্ব-রিক্ত তথা ব্রাত্যজনকে ক্ষমতায়িত করতে চেয়েছেন। লালন যে ভাসানীর মতো আপসহীনভাবে কৃষক-শ্রমিক তথা আমজনতার সামগ্রিক মুক্তির জন্য কাজ করে যেতেন তা বলাই বাহুল্য।

লালন ও ভাসানী দুজনেই মুক্তিপিয়াসি সংগ্রামী পুরুষ, কিন্তু তাদের সংগ্রামের কাফেলা শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয়ের শীর্ষবিন্দু ছুঁতে পারেনি, দেখে যেতে পারেননি রোদ-ঝলমলে মানবিক সমাজ । সুনির্দিষ্ট কোনো সাংগাঠনিক-পরিকাঠামো বা ব্যবস্থাপনাও রেখে যেতে পারেননি আগামী প্রজন্মের জন্য। তবে দুজনের মধ্যেই মানবমুক্তির স্বপ্ন ছিল। উঁচু-নিচু, আশরাফ-আতরাফের ভেদ ঘুঁচিয়ে জাতকূল-গোত্রহীন মুক্ত-মানবসমাজের বলে গেছেন লালন। তবে লালন-দর্শন বাস্তবায়নের জন্য যে-উচ্চায়ত চিন্তার মানুষ বা শিষ্যবর্গ প্রয়োজন ছিল সেটা লালন ও তার সাক্ষাৎ শিষ্যরা বানাতে পারেননি। লালন-উত্তর দুদ্দু শাহ, মনিরুদ্দীন শাহ, বেহাল শাহ, শুকচাঁদ ফকির, অমূল্য গোঁসাই, মহেন্দ্র ক্ষ্যাপারা আসর-মাতানো গায়ক ছিলেন, কিন্তু লালনীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ভক্ত-অনুরাগীদের উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার মতো মনস্তাত্ত্বিক ও সাংগাঠনিক শক্তি ছিল না। ভাসানীও বুঝেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি সমতাভিত্তিক স্বাধীন ভূখণ্ড প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর মুরিদ ও অনুসারীরা ভাসানীর লালিত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন করতে পারেননি। যদি পারতেন তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রূপ-চেহারা, রাজনীতির চালচিত্র অন্য রকম হতে পারত। ভাসানী ও লালনকে নিয়ে বিতর্ক আছে, আগামীতেও থাকবে, তারপরও দুজন জনমানস ও পরিসরে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন। যে কারণে রুমি-রবীন্দ্রনাথ, গালিব-ইকবাল থেকে নজরুল-সুকান্ত বেঁচে থাকবেন, ওই একই কারণে লালন ও ভাসানী মানব মুক্তির সুহৃদ-সারথি, গাইড-ফিলোসফার হিসেবে বেঁচে থাকবেন।

লেখক: অধ্যক্ষ (ভা.), মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ। ফোন: ০১৮১৬-৬৯৩৪




কুষ্টিয়ায় সেলাই মেশিন ও ঢেউটিন বিতরণ

আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কুষ্টিয়ায় নারীদের মাঝে সেলাই মেশিন এবং ঘর নির্মাণের জন্য ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে।

রবিবার বিকেলে শহরের হাজী শরীয়তুল্লাহ একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়া শহর জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে এসব সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

কুষ্টিয়া শহর জামায়াতের আমীর এনামুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক মাওলানা আবুল হাশেম।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হুসাইন, কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক মাজহারুল হক এবং কুষ্টিয়া শহর জামায়াতের আমীর এনামুল হক। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কুষ্টিয়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি শামীম হাসান।

অনুষ্ঠানে দুইটি পরিবারকে ঘর নির্মাণের জন্য তিন বান ঢেউটিন এবং আরও নয়টি পরিবারকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়।




কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নৈশপ্রহরীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নে স্বাধীন হোসেন (২৪) নামে এক নৈশপ্রহরীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

রোববার (২০ এপ্রিল) সকালে নন্দলালপুর এলাকায় একটি আমগাছের ডালে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্বাধীন হোসেন কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের মাঠপাড়া এলাকার আকমল হোসেনের ছেলে। তিনি পেশায় সোন্দাহ নন্দলালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী ছিলেন।

স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে এলাকার লোকজন সোন্দাহ নন্দলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে একটি আমগাছে স্বাধীন হোসেনের ঝুলন্ত মরদেহ দেখতে পান। পরে তারা কুমারখালী থানা পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।

কুমারখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সোলায়মান শেখ বলেন, “সকালে একজন নৈশপ্রহরীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।”

এ ঘটনায় কুমারখালী থানায় একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা দায়ের করা হয়েছে।




ঝিনাইদহে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা

জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামে ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলকারীরা ব্যবসায়ী ও তার পরিবারের সদস্যদের পিটিয়ে বাড়ি থেকে নগদ টাকা ও গহনা লুট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল সকালে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভুক্তভোগী মহারাজপুর গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী এনামুল হক অভিযোগ করেন বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারণে পারিবারিক সুত্রে পাওয়া আমার ৩৮ শতক জমি আমার ভাইয়েরা কৌশলে রেজিস্টি করে নেয়। আমার নিজের জমিও তারা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে। আমি দেশে ফিরে দিনের পর দিন জমি ফেরত চাইলে তারা নানা তালবাহানা শুরু করে। আমি চাপ দিলে সম্প্রতি তারা আমাকে মারধরের হুমকি দেয়।

এরই জের ধরে গতকাল সকালে আমার ভাই মুস্তাক, তক্কেল, মোফাজ্জেল তোজাম্মেলসহ আরও কয়েকজন আমার বাড়িতে এসে হামলা চালায়। আমি ও আমার পরিবারের সদস্য বেধড়ক মারপিট করে ঘরে থাকা জমি বিক্রির ৭ লাখ টাকা ও স্বর্ণের গহনা লুট করে নিয়ে যায়। পরে আশপাশের লোকজন ছুটে এলে তারা পালিয়ে যায়।

মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মুস্তাক আহম্মেদ বলেন, আমরা কিছু করিনি। উল্টো এনামুলই আমাদের মারধর করেছে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মহারাজপুরের ঘটনাটি শুনেছি। এ ঘটনায় অভিযোগ দিলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।




ঝিনাইদহে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ ঘোষণার বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন

ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ ঘোষণার বাস্তবায়নের দাবিতে ঝিনাইদহে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়েছে।

রোববার সকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচীর আয়োজন করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোট আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটি।

এতে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে সংগঠনটির জেলা শাখার নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা শিক্ষকরা অংশ নেয়। সেসময় সংগঠনটির জেলা শাখার আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন, সদস্য সচিব ফাতিমা ফারহানাসহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাখেন।

মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা জানান, গত ২৮ জানুয়ারি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের দ্রুত জাতীয়করণ করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়ায় শিক্ষকরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। বক্তারা দ্রুত জাতীয়করণের ঘোষণার বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন।