হযরত ইব্রাহীম (আ:) , পর্ব-৪

পর্ব-৩ এর পর থেকে

তিনি বাচ্চাদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সেই মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-একবার স্বপ্নে দেখলেন, একটি মনোরম বাগানে একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার সাথে অহরহ শিশু খেলা করছে আনন্দ করছে এবং সে মানুষ টি ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং সেই শিশুগুলো ছিল দুনিয়াতে যারা শৈশবে ইন্তেকাল করেছে এবং তিনি শিশুদের এতটা ভালোবাসতেন দেখে জান্নাতে সেই শিশুরা তার সাথী হবে এবং অনাবিল আনন্দে তার সাথে সময় কাটাবে। ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের বয়স তখন আনুমানিক ৮৫ মা সারাহ’র ও বয়স হয়েছে অনেক মা হওয়ার বয়স নিঃসন্দেহে পার হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি খেয়াল করলেন হাজেরা তখনও যুবতী এবং তার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব ছিল। তার স্বামীর প্রতি প্রবল ভালোবাসা থেকে মা সারাহ ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে বললেন তিনি যেন হাজেরাকে বিয়ে করে ফেলেন। একজন পুরুষের জন্য কখনোই বোঝা সম্ভব না একজন স্ত্রী নিজ থেকে এমন একটি প্রস্তাব দিতে হলে তাকে কতটা নিঃস্বার্থ হতে হবে কতটা বিসর্জন দিতে হবে। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম অবশেষে তার স্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং মা হাজেরাকে বিয়ে করলেন এবং আল্লাহর বিশেষ রহমতে কিছুদিনের মাথায় মা হাজেরা গর্ভবতী হলেন এবং ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের প্রথম সন্তান ইসমাইল আলাইহিস সালাম জন্ম গ্রহণ করলেন। একের পর এক ফিৎনার জীবনে এত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এত প্রতীক্ষার পর ৮৬ বছর বয়সে বাবা হওয়ার পর তার সন্তানের প্রতি তার স্নেহ কতটা প্রগার ছিল তা বর্ণনার উর্ধ্বে। কিন্তু মা সারাহ তার স্বামীর জন্য এতটা বিসর্জন দেওয়ার পর তার জন্য এসব কিছু আর নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি ইতিমধ্যেই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের খুশির জন্য যা করেছেন তা হয়তো কোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার স্বামীর দ্বিতীয় সংসারের আনন্দের নীরব প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকা তার জন্য সম্ভব ছিল না।

 

তিনি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে বললেন তুমি হাজেরা আর ইসমাইলকে অন্য কোথাও গিয়ে রেখে আসো। প্রিয়তমা স্ত্রীর এই অনুরোধ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। কিন্তু যার সাথে জীবনের এতটা পথ একসাথে পাড়ি দেয়া, যার বিসর্জনের কারণেই তার বাবা হওয়ার এত বছরের ইচ্ছা পূরণ হওয়া, সেই জীবনসঙ্গীর কথা তিনি উপেক্ষা করেন কি করে। তিনি হাজেরা এবং ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং আল্লাহর ওয়াহী অনুযায়ী পাড়ি দেন বহুদূর পথ। তিনি তার গন্তব্য স¤পর্কে অবগত ছিলেন না জীবনের সব পরীক্ষার মতো এই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও ইব্রাহিম আলাইহিসালাম পুরোপুরি ভরসা রাখলেন আল্লাহর উপর। আল্লাহ তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে পথ দেখিয়ে দিলেন এক ধুধু মরুভূমির মাঝখানে। সেই জনমানবহীন অঞ্চলের নাম তখন ছিল বাক্কাহ যা পরবর্তীতে মক্কা নামে পরিচিত হয়। আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তিনি মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে কর্কশ সেই মরুভূমির মাঝে রেখে কোনো কথা না বলে ফিরে যেতে লাগলেন। পুরুষের প্রকৃতি হল সে সব সময় তার পরিবারকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, তাদের নিরাপদে রাখার জন্য সে ব্যক্তিগত ভাবে সকল প্রকার সম্মুখীন হতে প্রস্তুত।

 

সেই জায়গায় তার প্রকৃতির ঠিক বিপরীতে গিয়ে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তার স্ত্রী ও সন্তানকে এক অচীন মরুভূমির মাঝখান দিয়ে স্বেচ্ছায় রেখে আসা যে কত বড় পরীক্ষা ছিল, তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। তাকে ফিরে যেতে দেখে মা হাজেরা বললেন আপনি কোথায় যাচ্ছেন, আমাদের কিভাবে রেখে যাচ্ছেন কেন? গভীর শোকে হোক বা আল্লাহর আদেশক্রমেই হোক ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে কোন উত্তর দিতে পারলেন না। মা হাজেরার উপলব্ধি হলো আল্লাহর ওয়াহী ছাড়া ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কখনই এমনটা করার কথা না। তিনি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন আল্লাহ কি আপনাকে আমাদের এখানে রেখে যাওয়ার আদেশ করেছেন, এবার ইব্রাহিম আলাইহিসালাম উত্তরে বললেন হ্যা, ব্যাস এতটুকুই তাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট ছিল।

 

আশপাশে পানি নেই, কোন প্রকার আশ্রয় নেই, কিন্তু এটা আল্লাহর আদেশ ছিল এতটুকু জেনেই মা হাজেরা তার এই সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবেই মেনে নিলেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অল্প কিছু রেখে যাওয়া খাবার দাবার ফুরিয়ে যেতেই ক্ষুদার্ত তৃষ্ণার্ত ইসমাইল কান্না আরম্ভ করল। মা হাজেরা দুই পহাড়ের মধ্যে ছোটাছুটি করতে আরম্ভ করলেন যদি কোন আশ্রয় পাওয়া যায়, যদি কোন পানীর সন্ধান পাওয়া যায়। সাফা আর মারওয়া পাহাড়ে সাতবার তিনি এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছুটলেন একটি মানুষের সন্ধান পাওয়া গেল না। কোন মানুষের সন্ধান পাওয়া না গেলেও সাধারণ কোন মানুষের চেয়েও অনেক মর্যাদাবান কাউকে আল্লাহ মা হাজেরার কাছে পাঠিয়ে দিলেন, স্বয়ং জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তার সামনে দেখা দিলেন এবং তিনি তার পায়ে গোড়ালি দিয়ে মাটিতে এমন ভাবে আঘাত করলেন যে সেখান থেকে অঝোরে পানি বের হতে লাগল এবং এমন ভাবে পানি বের হতে লাগল যেন গোটা উপত্যকায় পানি দিয়ে ভরে যাবে। মা হাজেরা তখন জম জম থাম থাম বলে মাটি উঁচু করে সেখানে কুয়োর মত বানিয়ে দিলেন এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমরা সেই অলৌকিক জমজমের পানি খাই। তিনি যেভাবে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তার তাকদীর মেনে নিয়েছেন আমাদেরকেও আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমাদের তাকদীর মেনে নিতে হবে।

আমরা যে যেই সামাজিক অবস্থাতে জন্ম নেই না কেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যারা আর্থিক সংকটে জন্ম নেন তাদের জীবনের চ্যালেঞ্জ একরকম, যারা যুদ্ধের মাঝে জন্ম নেন তাদের চ্যানেলগুলো আরেকরকম, মা হাজেরার মতো আমরা যদি আমাদের পরিস্থিতি মেনে নেই এবং আল্লাহর উপর ভরসা করি তাহলে আল্লাহ আমাদের অবশ্যই সাহায্য করবেন। কিন্তু শুধু তাই নয় প্রতিবছর পবিত্র হজ্জে মানুষ মা হাজেরার মতো সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ে সাতবার সায়ী করে বা ছুটে চলে, নিজেকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকলেই হবে না আমাদেরকে নিজ উদ্যোগে সমাধান খুজতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে কোন পথ কোন উপায় না থাকলেও সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে বাধা অতিক্রম করার জন্য। আমরা যদি আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাহলে অলৌকিক ভাবে ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও আলোর পথ পেরিয়ে আসবে।

ঠিক যেমন মা হাজেরার কাছে জিবরাঈল আলাইহিস সাল্লাম এসেছিলেন, তবে তিনি সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ে ছুটে চলার পর তার আগে নয়। অলৌকিক জমজমের পানি দেখা দেয়ার পর সে অঞ্চলে পাখিরা ঘোরাফেরা করা শুরু করলো। কিছুদিন পর বনু জুরহুম গোত্রের এক ব্যবসায়ী কাফেলা সেখান দিয়ে ভ্রমণ করছিল। ধুধু মরুভূমির মাঝখানে এত পাখির আনাগোনা দেখে তারা সেদিকে কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেল। মা হাজেরাকে সেখানে দেখে বুঝতে পারলো তার উপরে নিশ্চয়ই আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে। তারা জমজমের পানি খাওয়ার জন্য তার কাছে অনুমতি চাইল এবং তার অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলো। মা হাজেরা একটি শর্ত প্রদান করলেন, যে তাদেরকে সেই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে হবে এবং তারা সে শর্ত মেনে নিল। জমজমের কুয়া কে ঘিরে একটি নতুন জনবসতি গড়ে উঠলো যেখান থেকে প্রাচীন আদনানী আরব জাতির শুরু এবং যে গোষ্ঠী থেকেই পরবর্তীতে কুরাইশ বংশের উৎপত্তি। ইসমাইল আলাইহিস সালাম বনু জুরহুম গোত্রের লোকদের সাথে আনন্দে বেড়ে উঠতে লাগল এবং তারাও ছোট্ট ইসমাইলকে অত্যন্ত ভালোবাসতো।

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মাঝে মাঝে তাদের দেখতে আসতেন, কিন্তু ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর জীবন মানেই যেন একের পর এক পরীক্ষা। জীবনের এই পর্যায়ে এসে ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম একটি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন এবং বারংবার এই স্বপ্ন দেখার ফলে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। একটা পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারলেন তিনি স্বপ্নে দেখেছেন তা আসলে আল্লাহর তরফ থেকে তার প্রতি একটি আদেশ। তিনি তার আদরের সন্তান ইসমাইলকে নিয়ে স্বপ্নটা দেখলেন, তাই তার সাথেই শেয়ার করলেন। তিনি ইসমাইলকে ডেকে বললেন বাবা আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমাকে কুরবানী করছি। তোমার কি মনে হয় এর মানে কি? ছোট্ট ইসমাইল আলাইহিস সালাম তার বাবাকে বললেন, হে আমার আদরের বাবা আল্লাহ যা হুকুম করেছে আপনি তাই করুন ইনশাআল্লাহ আমি সবর করব।

নিজের সন্তানের কাছ থেকে এমন উত্তর পেয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মনের অবস্থা কেমন ছিল তা আমাদের জন্য বোঝা অসম্ভব। একদিকে এমন কঠিন পরীক্ষার মুখে নিজের সন্তান এতটা দৃঢ় ঈমানের পরিচয় দিয়েছে, তা দেখে নিশ্চয়ই গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল। সেইসাথে তিনি নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন এখন আর পিছু হটার সুযোগ নেই এখন সময় এসেছে আল্লাহর হুকুম পালনের সন্তানকে কোরবানি করার। নিজের মনকে শক্ত করে ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম তাঁর প্রিয় সন্তানকে নিয়ে হেঁটে চললেন তাকে কোরবানি করার জন্য। এরকম নাজুক মুহূর্তে শয়তান এসে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর সামনে হাজির হয় মানুষের রূপ নিয়ে তার মনে সন্দেহ তৈরি করার চেষ্টা করে, ইব্রাহিম আলাইহিসালাম তখন শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর মারেন তিনবার শয়তান তার সামনে হাজির হয় তিনবার তিনি তাকে পাথর মেরে সরিয়ে দেন। অবশেষে ইসমাইল আলাইহিস সালাম মাথা নিচু করে কোরবানি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য নিজ সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার জন্য ছুরি তুলে ধরেন এবং সেই মুহূর্তেই আল্লাহর ওয়াহী নাযিল হয়, আল্লাহর হুকুমে শেষ মুহূর্তে ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। বাবা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালাম ঘরে ফেরেন আল্লাহর পূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জন করে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন মা সারাহ (আ.) কাছে ফিরে গেলেন এবং স্বাভাবিক ভাবে জীবন-যাপন করতে লাগলেন।

একদিন তার বাসায় কিছু মেহমান আসলো, তিনজন অত্যন্ত সুদর্শন ব্যক্তি তার দরজায় এসে টোকা দিল, ইব্রাহিম আলাইহিসালাম তাদের চিনতে পারলেন না। কিন্তু তার মন এতটাই উদার ছিল যে তিনি তাদের সালাম দিয়ে হাসিমুখে ঘরের ভেতর আমন্ত্রণ করে নিলেন, ভাবলেন হয়তো তারা মুসাফির একটু বিশ্রামের জন্য তার ঘরে এসেছে, তাই তিনি তাদের ভেতরে বসিয়ে খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঘরে কি কোন খাবার আছে মা সারাহ বললেন এই যে অল্প কিছু মাংস আছে। ইব্রাহিম আলাইহিসালাম এর লজ্জা হলো মেহমানদেরকে আগের রয়ে যাওয়া মাংস পরিবেশন করতে।

পুরোপুরি অজানা এ মেহমানদেরকে খেদমত করার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর একটি গরু জবেহ করবেন। একটা গরু এখন যেমন দামী তখনও তেমনি দামী ছিল, পার্থক্য এতটুকুই বর্তমান সময়ে একটা মাঝারি সাইজের গরু ৪০ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয় তখন হয়তো স্বর্ণের বিনিময়ে কেনা হতো। কিন্তু অপরিচিত মেহমানের জন্য একটা গরু জবাই দিয়ে তাদের খেদমত করা হবে। এমন উদারতার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না এবং হয়তো তারই আশ্চর্য মেহমানদারীর জন্য ইব্রাহিম আলাইহিসালাম কে লোকেরা আবু দইফান বলে ডাকতেন যার অর্থ মেহমানদের পিতা বা আধুনিক বাংলায় অনুবাদ করলে মেহমানদারীর গুরু।

(চলবে…)

সংকলনে: প্রকাশক,মেহেরপুর প্রতিদিন।