বাংলাদেশের প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুরের গাড়াবাড়িয়া গ্রামের এক তরুণ আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের পতাকা উঁচু করে ধরেছেন। জীবন শুরু করেছিলেন মাঠের ধুলো, নদীর জলের মধ্যে; আজ তার গায়ে বয়ে যায় চ্যাম্পিয়নের ঘাম। তিনি মুনজুর আলম, যিনি ‘দ্য হান্টার’ নামে পরিচিত একজন মার্শাল আর্ট যোদ্ধা।
মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার মিক্সড মার্শাল আর্টস (এম এম এ) অঙ্গনের একজন উদীয়মান ফাইটার হিসেবে তুলে ধরেছেন। তার লড়াইয়ের দক্ষতা, মানসিক দৃঢ়তা ও দেশের প্রতি ভালোবাসা আজ অনেক তরুণের জন্য এক প্রেরণার নাম।
২০১৪ সালে ইউটিউবে কনর ম্যাকগ্রেগর, খাবিব নুরমাগোমেদভদের লড়াই দেখে মুগ্ধ হয়ে নিজেই শুরু করেন অনুশীলন। তখন কোনো প্রশিক্ষক ছিলেন না, বন্ধুরাই ছিল সঙ্গী। খেলার মাঠ, নদীর পাড়, বাড়ির উঠান, যেখানে সুযোগ পেতেন সেখানেই চলত ছায়া অনুশীলন।
স্কুল থেকে ফিরে বসে যেতেন ইউটিউবে প্রতিটি ঘুষি, প্রতিটি কৌশল তার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিত। বিকেলে বেরিয়ে পড়তেন বন্ধুদের নিয়ে প্র্যাকটিসে। তখনই বুঝেছিলেন এটাই তার ভবিষ্যৎ।
মুনজুরের পরিবার তখনও জানতো না, তাদের ছেলেটা আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে একজন লড়াকু যোদ্ধা। বন্ধুদের পেলেই শুরু করতেন ছায়াযুদ্ধ। নদীতে গোসল, মাঠে খেলা, বাড়ির উঠানে অনুশীলন সবই ছিল তার রুটিনের অংশ।
পরবর্তীতে তার এই প্যাশনকে রূপ দিতে পাশে দাঁড়ান প্রশিক্ষক রাজন হালদার লিটন। এরপর শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। প্রথম ক্লাব ছিল ‘কেজ রিউ এম এম এ’, বর্তমানে তিনি যুক্ত আছেন ঢাকার ‘হাবিব’স এম এম এ একাডেমি’ তে।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মুনজুর অংশ নিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায়। আর জিতেছেন একের পর এক পদক ও স্বীকৃতি তার মধ্যে অন্যতম নকআউট নাইট আন্তর্জাতিক এম এম এ চ্যাম্পিয়নশিপ (২০১৮) স্বর্ণপদক, বুম আইপিএফএল ফাইট নাইট ১০ ও ১১ স্বর্ণপদক ,লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং ফাইট নাইট ২ স্বর্ণপদক, ওপেন এশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ রৌপ্যপদক, ডাবল হর্স নকআউট ০০১ ডব্লিউ এম সি টাইটেল ফাইট বিজয়ী।
সবচেয়ে সাম্প্রতিকভাবে, ‘ডাবল হর্স নকআউট ০০১’ এ ভারতের অভিজ্ঞ যোদ্ধা আজহারউদ্দীন সুধীরকে পরাজিত করে জাজদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে শিরোপা জিতেছেন তিনি।
মুনজুর বলেন, “আমার এই পথচলায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমার পরিবার। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহস আর সমর্থন দিয়েছেন আমার ফুফু মোছাঃ নারগিস খাতুন। কেউ যখন বলতো ‘তুই কী করবি এসব দিয়ে’, তখন তিনি বলতেন তুই মন থেকে কর, আমরা আছি তোর পাশে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার বন্ধুদের কথাও না বললেই নয়। তারাই ছিল আমার প্রথম ফাইটিং পার্টনার। মাঠে, নদীতে, বাড়ির উঠানে, এমনকি স্কুল শেষে এক পাশে দাঁড়িয়ে আমরা প্র্যাকটিস করতাম। তারা যদি না থাকত, আমি হয়তো আজ এতদূর আসতে পারতাম না।”
মুনজুরের অনুপ্রেরণা এসেছিল কনর ম্যাকগ্রেগর, খাবিব নুরমাগোমেদভ এবং মোহাম্মদ আলীর মতো কিংবদন্তিদের কাছ থেকে। তবে এখন তার চোখ আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে।
“আমি চাই, একদিন বাংলাদেশের পতাকা আন্তর্জাতিক মঞ্চে উড়ুক। এটা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। একজন তরুণের ইচ্ছা যদি দৃঢ় হয়, সে পাহাড়ও সরাতে পারে।” বলেন মুনজুর।
মুনজুর আলমের স্বপ্ন একটাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া। শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য, মেহেরপুরের জন্য। তার চোখে ভাসে একটাই লক্ষ্য বাংলাদেশকে মার্শাল আর্ট দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করা।
মেহেরপুরের একটি অজপাড়া গ্রাম গাড়াবাড়িয়া থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক রিংয়ে লড়ছেন একজন তরুণ এটাই প্রমাণ করে, স্বপ্ন কখনও সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকে না।
মুনজুর আলম এখন শুধুই একজন ফাইটার নন তিনি একজন যুব অনুপ্রেরণা। তার লড়াই, তার সাহস, তার অদম্য মনোবল প্রতিটি তরুণকে শেখায় “তুমিও পারো!”
প্রথম কোচ রাজন হালদার লিটনের স্মৃতিতে এখনো ভাসে সেই শুরুর দিনগুলো। তিনি বলেন, “আমি যখন মুনজুরকে প্রথম দেখি, তখনই বুঝেছিলাম এই ছেলেটা একদিন কিছু করে দেখাবে। আমি শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত তার ওপর গর্ব করি।”
বর্তমান কোচ হাবিব পারভেজ বলেন, “কোনো সন্দেহ ছাড়াই মুনজুর আলম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ফাইটার। বাংলাদেশ এখন তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে পারে। আমরা আশা করি, তাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে পাব।”
মুনজুরের মা বলেন, “আমি অনেক খুশি আমার ছেলের এমন অর্জনের জন্য। তবে কখনো ভাবিনি, আমার ছেলেটা একদিন দেশের নাম উঁচু করবে। ছোটবেলায় পড়ালেখা না করে সারাদিন শুধু ঝাঁপাঝাঁপি করত। তখন বুঝিনি, ওর ভেতরে লুকিয়ে আছে এত বড় প্রতিভা। সকলে আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন, যেন আরও বড় হতে পারে।”
বন্ধু ও সহযোদ্ধা হুসাইন কবির বলেন, “সে এখন বাংলাদেশের সেরা ফাইটার, এবং আমি বিশ্বাস করি, সে-ই হবে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আমাদের দেশ থেকে। সে শুধু আমার বন্ধু নয়, সে আমার অনুপ্রেরণা।”
ফুফু নারগিস আক্তার বলেন, “ছোটবেলা থেকেই মার্শাল আর্টে ভীষণ আগ্রহী ছিল মুনজুর। আমি বুঝেছিলাম, এই ছেলে একদিন অনেক দূর যাবে। আজ সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে এটা ভাবলেই চোখে পানি চলে আসে।”
দুই প্রজন্মের দুই কোচ, মা, ফুফু ও বন্ধুর মুখে উচ্চারিত একটিই নাম মুনজুর আলম। দেশের গর্ব হয়ে ওঠা এই তরুণের গল্প শুধু ক্রীড়ার নয়, এটা স্বপ্ন দেখা এবং তা অর্জনের এক অনন্য উদাহরণ।